আজ ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ। বাঙালি জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক উত্তাল জনসমুদ্রে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণে বাংলার স্বাধীনতার রূপরেখা ঘোষণা করেন। অগ্নিঝরা এই ভাষণের মাধ্যমেই সূচিত হয়েছিলো বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের অধ্যায়। দেশের মুক্তিকামী মানুষ নতুন শপথে উদ্দীপ্ত হয়ে তত্কালীন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু সেদিন শোষিত বঞ্চিত মানুষের মনের অব্যক্ত কথাই তুলে ধরেছিলেন তার ভাষণে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি উচ্চারণ প্রতিধ্বনিত হতে থাকে লক্ষ প্রাণে। গগনবিদারী আওয়াজে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সমর্থন জানাতে থাকে উপস্থিত আমজনতা।

সত্তরের নির্বাচনে তত্কালীন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরই গণতান্ত্রিক উপায়ে সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় ছিল। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়ার দাবিতে ৬ মার্চ পর্যন্ত ঘোষিত হরতাল, অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি পালিত হয়। ৩রা মার্চ পল্টনের বিশাল জনসমাবেশে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ৬ মার্চের মধ্যে যদি সরকার তার অবস্থান পরিবর্তন না করে তাহলে ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। আর সেই অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের জনসভা। মার্চের প্রথম সপ্তাহের ৪/৫ দিনের ঘটনাবলীতে বিক্ষুব্ধ মানুষ নতুন কর্মসূচির অপেক্ষায় ছিল। সেদিন সকাল থেকেই মানুষের ঢল নামে রেসকোর্স ময়দানে। অগণিত মানুষের পদভারে ঢাকা পরিণত হয় উদ্বেলিত নগরীতে। সমস্ত অলি-গলি থেকে দলে দলে মানুষ রাজপথ ধরে রেসকোর্স ময়দানের দিকে আসতে থাকে। ‘ তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ- বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর- বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ প্রভৃতি আগুনঝরা শ্লোগানে রাজপথ মুখরিত করে এগোতে থাকে মিছিলগুলো। শ্লোগানে শ্লোগানে প্রকম্পিত হয় রেসকোর্স ময়দান।

বঙ্গবন্ধু জনসভায় আসতে একটু বিলম্ব করেন। স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হবে কি হবে না- এ নিয়ে তখনো রুদ্ধদ্বার বৈঠক এবং বিতর্ক চলছিল নেতৃবৃন্দের মধ্যে। পরে বঙ্গবন্ধু ২২ মিনিট ধরে তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম এবং ঐতিহাসিক ভাষণ শুরু করেন এভাবে-‘আজ দু:খ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সকলে জানেন এবং বুঝেন, আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কি অন্যায় করেছিলাম, নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো এবং এই দেশকে আমরা গড়ে তুলবো, এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। তেইশ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস, এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি।

বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেন, আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেছি, তখনই তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার (ইয়াহিয়ার) কথা হয়। তাকে আমি বলেছিলাম, ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরিবের উপরে, আমার বাংলার মানুষের উপরে গুলি করা হয়েছে, কি করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ১০ তারিখে রাউন্ডটেবিল ডাকবো।
আমি বলেছি, কিসের বৈঠক বসবে, কার সঙ্গে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে তাদের সঙ্গে বসবো? হঠাত্ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে ৫ ঘণ্ট গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি (ইয়াহিয়া খান) করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার ওপরে দিয়েছেন, বাংলার মানুষের ওপরে দিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু বলেন, ২৫ তারিখে এসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি যে, ঐ শহীদের রক্তের ওপর পা দিয়ে কিছুতেই মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। এসেম্বিল কল করেছে, আমার দাবি মানতে হবে। প্রথম, মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে, সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে, যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে, আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো, আমরা এসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারবো না। তিনি বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই।

বঙ্গবন্ধুর বজ নির্ঘোষে, থরথর করে কেঁপে ওঠে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার মসনদ। তিনি বলেন, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো-প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না। ভাষণের শেষ অংশে চূড়ান্ত ঘোষণা দেন তিনি, প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।

এদিন বঙ্গবন্ধুই ছিলেন একমাত্র বক্তা। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্বে আ স ম আব্দুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখ মঞ্চ থেকে মাইকে নানা ধরনের শ্লোগান দিয়ে উপস্থিত জনতাকে উজ্জীবিত রাখেন। এদিকে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে যখন এই ঐতিহাসিক ভাষণ দিচ্ছিলেন ঠিক ঐদিনই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছান জেনারেল টিক্কা খান ও রাও ফরমান আলী। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী আলোচনার অন্তরালে সামরিক অভিযানের গোপন প্রস্তুতি নিতে থাকে। আর এটা আঁচ করতে পেরেছিলেন মুক্তিকামী বাঙ্গালির কান্ডারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এজন্যই হয়তো রেসকোর্সের ভাষণে তিনি বলেই রেখেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’

ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান তার বাণীতে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। এ ভাষণে তিনি পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরের শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস তুলে ধরে ভবিষ্যত্ করণীয়, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত আহ্বান জানান। রাষ্ট্রপতি বলেন, ঐ ভাষণে বজ কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম—এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ঐতিহাসিক সেই ভাষণ এদেশের জনগণকে বিপুল শক্তি ও সাহস যোগায় এবং মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। এই ভাষণের ধারাবাহিকতায় ২৬ শে মার্চ ১৯৭১ জাতির পিতা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ মহান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ কেবল বাঙালি জাতিকে নয়, পৃথিবীর স্বাধীনতাকামী নিপীড়িত ও বঞ্চিত জনগণের আশার দিশারি হিসেবে পথ দেখাবে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ আমাদের প্রেরণার চিরন্তন উত্স হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, বাঙালি জাতির ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের লালিত স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশকে ‘সোনার বাংলা’য় রূপান্তর করা। জাতির পিতার স্বপ্ন আজো পূরণ হয়নি। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, কুসংস্কারসহ বৈশ্বিক জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাবের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত আমাদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে। এ সংগ্রামে আমাদের জিততে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাণীতে বলেন, ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক অনন্য দিন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের এ দিনে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে সমগ্র জাতিকে মুক্ত করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদাত্ত আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতি যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, তেমনি আরেকবার ঐক্যবদ্ধ হয়ে দিন বদলের সনদ বাস্তবায়ন করে আমরা আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে উপনীত হব। একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত বর্তমান সরকার দেশ থেকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা ও সন্ত্রাস চিরতের দূর করতে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নে তিনি সকল শ্রেণী পেশার মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ওপর জোর দেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাণীতে বলেন, রাজনৈতিক বিশ্লে¬ষকদের মতে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বিশ্বে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ। বাঙালির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতার ওই ভাষণের দিক নির্দেশনাই ছিল সে সময় বজ কঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র। অসীম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমিত শক্তির উত্স ছিল এ ঐতিহাসিক ভাষণ। যার আবেদন আজো অটুট।