বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী ১৩ ডিসেম্বর টিপাইমুখ ড্যাম নিয়ে প্রথম আলো পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখেছেন এবং নিবেদন করেছেন বিষয়টির ওপর আবেগ ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ঊধের্্ব থেকে যুক্তিপূর্ণ ও বৈজ্ঞানিক আলোচনা হওয়া দরকার। তিনি লিখেছেন, তিনি দিল্লী যাওয়ার আগে বহু বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিজ্ঞানী, নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিবিদের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি বুঝতে চেয়েছেন এবং যেসব বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশিত হচ্ছে, সেসব বিষয়ে ব্যাখ্যা পেয়ে আশ্বস্ত হতে চেয়েছেন। ভারতে যাওয়ার পর তিনি সেখানকার নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে এবং সেদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে ওই সব উদ্বেগ তুলে ধরেন। শেষে তিনি তাঁর লেখায় ১৫টি পয়েন্টে পাওয়া তথ্য ও সত্য ঘটনা তুলে ধরেছেন।

টিপাইমুখ স্থানটি ভারতের মিজোরাম রাজ্যের কোলাশিব জেলা এবং মণিপুর রাজ্যের চূড়াচাঁদপুর জেলার সীমানায় অবস্থিত, যেখানে টিপাই নদী বরাক নদে এসে মিশেছে। এখানে বরাক নদ উত্তর-পূর্বের কালানাগা এলাকার ভেতর দিয়ে এসে একটি উল্টো বাঁক নিয়েছে। টিপাই নদীর উৎপত্তি মিয়ানমারে, যা দক্ষিণ দিক থেকে এসে এই বাঁকে এসে পড়েছে। বরাক এরপর ভুবন পাহাড় উপত্যকার ভেতর দিয়ে আসামের কাছাড় জেলার দিকে প্রবাহিত হয়েছে। পাহাড় ও সমতলের ভেতর দিয়ে এ নদটি আরও ১৮০ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে অমলশিদের কাছে বাংলাদেশের সীমানা স্পর্শ করেছে। এখানে নদটি সুরমা ও কুশিয়ারা নামের দুটি নদীতে ভাগ হয়ে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করেছে। টিপাইমুখ ড্যাম বিষয়ে উপদেষ্টার প্রবন্ধের ওপর প্রতিক্রিয়া করে আমি তাঁর পয়েন্টগুলোর ধারাবাহিকতায় আমার মতামত তুলে ধরছি:

টিপাইমুখ ড্যামের মাধ্যমে একহাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদু্যৎ উৎপাদন করার কথা বলা হচ্ছে, যা একটি অতি আশাবাদী হিসাব। বরাক নদটির জলসংগ্রহ এলাকা ১২ হাজার বর্গকিলোমিটার, যার বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত একহাজার ৫০০ মিলিমিটার। বাংলাদেশের কাপ্তাই ড্যামের দ্বিগুণ জলসংগ্রহ এলাকা আছে, যার গড় বৃষ্টিপাত দ্বিগুণ এবং জলাধার এলাকাও দ্বিগুণ; কিন্তু এই ড্যামের মাধ্যমে ৪৫০ মেগাওয়াটের বেশি জলবিদু্যৎ উৎপাদন সম্ভব নয়। টিপাইমুখে ড্যাম নির্মিত হলে তা গ্রীষ্মকালে কিছু আগাম বন্যার পানি রোধ করতে পারবে, কিন্তু বর্ষাকালে জলাধার পূর্ণ থাকায় বন্যাপ্রবাহ রোধ করতে পারবে না। যাই হোক, ড্যামের জলাধারের জল দিয়ে বরাক নদের ভাটিতে হেমন্ত, শীত ও বসন্তের শুকনা মাসগুলোতে পানি বাড়ানো যাবে। কিন্তু এই পানি বাড়ানোর ফলে এলাকাগুলো নিষ্কাশিত না হয়ে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পানিতে ডুবে থাকবে।

বিজ্ঞানী ও পানি বিশেষজ্ঞরা যাই যুক্তি দিক না কেন, একটি জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নির্মিত ড্যাম সবসময় পূর্ণ করে রাখার চেষ্টা থাকে, যাতে সর্বোচ্চ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। ড্যামের ডিজাইন অনুযায়ী অতি বৃষ্টিতে পানি স্পিলওয়ের মাধ্যমেই কেবল উপচে ভাটিতে যায়। তাই বর্ষার বন্যা কোনওভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। উল্লেখ্য, এ বছর দামোদর উপত্যকার বর্ধমান, বাঁকুড়া, হুগলি ও হাওড়া জেলায় ভয়াবহ বন্যা হয়েছে, যার পানি ওই উপত্যকার পাঞ্চেত, বরাক, মাইথন ও তিলাইয়া ড্যাম উপচে এসে ভাসিয়ে দিয়েছে। গওহর রিজভী ঠিকই জেনেছেন, একটি ড্যাম শুকনার সময় নদীর পানি বাড়াতে পারে এবং বর্ষার সময় কমাতে পারে। এ ধরনের ব্যবস্থাপনা রংপুর বিভাগের জেলাগুলোর জন্য সুখবর হতে পারত। কিন্তু সিলেট বিভাগের জেলাগুলোর জন্য তা বিপদ সংবাদ।

সুরমা ও কুশিয়ারা নদী দুটি সিলেট বিভাগের হাওড়গুলোর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এরা বর্ষার সময় হাওড়গুলো জলপূর্ণ করে, শীতে নিষ্কাশন করে। এই বিভাগের ভূমির উচ্চতা টাঙ্গুয়ার হাওরের দিকে ক্রমশ নেমে গেছে, যার চারপাশে ভূমি গড়ে সমুদ্রতল থেকে মাত্র তিন মিটার উঁচু। সুরমা নদী গারো, খাসিয়া ও জৈন্তিয়া পাহাড় এলাকা থেকে ও জলসংগ্রহ করে। আগাম বন্যা আসে এপ্রিল মাসে, যখন বরাক উপত্যকায় আগাম বৃষ্টিপাত হয়। কিন্তু টিপাইমুখ ড্যাম জলবিদু্যৎ উৎপাদন করবে ও হেমন্ত, শীত ও বসন্তের মাঝামাঝি পর্যন্ত নদীতে জল ছাড়বে। এরফলে এলাকার একফসলি জমিগুলো ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত জলে ডুবে থেকে জাগতে পারবে না ও বোরো ধান লাগানো যাবে না। এ কারণে প্রতিবছর একহাজার কোটি টাকার ধান থেকে বঞ্চিত হবে।

কাছাড় জেলার ফুলেরতলে যে ব্যারেজ নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল তা প্রমোটারদের চুক্তির আওতায় আসে না। ভারত এটা হয়তো নির্মাণ করবে না, যাতে বরাক নদের নৌপথ আরও ৮০ কিলোমিটার উজান পর্যন্ত টিপাইমুখ ড্যামের ভাটি পর্যন্ত বহাল রাখা যায়। নাগাল্যান্ড টিপাইমুখ ড্যাম পয়েন্টের ভাটিতে নয় বরং উজানে অবস্থিত। আমি গওহর রিজভীর সঙ্গে একমত যে, চুক্তিটি শুধুই অর্থলগি্নর ইচ্ছা প্রকাশমাত্র। বিশ্বব্যাংক এটা করবে, কিন্তু এখনও আসেনি। আমি তাঁর পরিবেশ সংক্রান্ত উদ্বেগের সঙ্গেও একমত। ড্যামটির ফলে যে বন্যা হবে, এলাকা ডুবে যাবে, লোকজন বাস্তুচু্যৎ হবে, জনগণের জীবিকার মাধ্যম ক্ষতিগ্রসত্দ হবে এবং বন্য প্রাণী তাদের বসবাস এলাকা হারাবে ইত্যাদি বিষয়ে তার উদ্বেগের প্রশংসা করি; যা কি-না ভারতের ভূমিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশে হবে অন্য ধরনের ক্ষতি, হাওড়ের শস্য থেকে বঞ্চিত হওয়া ছাড়াও ভারত টিপাইমুখ ড্যামের মাধ্যমে মধ্যবসন্ত থেকে গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত নদীর তলানি প্রবাহ আটকে রাখবে। এরফলে বাংলাদেশের ভেতরে কুশিয়ারা নদীর তলানি প্রবাহের পরিমাণ কমে গিয়ে জল পরিবেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে।

আমি গওহর রিজভীর সঙ্গে একমত, ভারত তার নাগরিকদের ভূমিকম্পের বিপদের মধ্যে রাখতে চাইবে না। তাই তারা ড্যামটি ভূমিকম্পের ধাক্কা সহ্য করার ক্ষমতাসম্পন্ন করেই নির্মাণ করবে। বরাক একটি আন্তর্জাতিক নদী, তাই বাংলাদেশের স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনায় রাখাটা আন্তর্জাতিক নিয়মে সিদ্ধ। কিন্তু ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা তাঁর শেষকথা ভাবা যায় না। শারম আল-শেখ (২০০৯), দিলি্ল (২০১০) এবং ঢাকার (২০১১) বৈঠকে তাঁর দেওয়া বাংলাদেশকে ক্ষতি না করার প্রতিশ্রুতিগুলো খুবই ভালো শোনায়। এটাই আন্তর্জাতিক কূটনীতি। বাংলাদেশের সঙ্গে টিপাইমুখ ড্যাম বিষয়ে তথ্য বিনিময় ও বাংলাদেশে সঙ্গে যৌথ সমীক্ষা দল গঠনের জন্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রসত্দাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ এবং বিজ্ঞানীদের অবশ্যই এর সুযোগ নেওয়া দরকার।

টিপাইমুখ ড্যামের মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা ও শুকনো মৌসুমে পানি ছাড়ার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস অনেক সুখবর হতো, যদি তা তিস্তা নদীর বেলায় হতো। সিকিমে যদিও পানি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে না, কিন্তু সেখানে নির্মিত ‘লো ফ্লো ড্যাম’গুলোর মাধ্যমে শুকনো মৌসুমের পানি আটকে রাখা হচ্ছে; যার ফলে গজলডোবা ব্যারেজের উজানে তিস্তা নদীর পানি কমে গেছে। একই রকম পরিস্থিতি গ্রীষ্মকালে বরাক নদের বেলায়ও হবে, যদিও ভারত হয়তো একটি ব্যারেজ নির্মাণ করে সেচ বা অন্য কাজে পানি সরিয়ে নেবে না। বাংলাদেশকে টিপাইমুখ প্রকল্পে লগি্ন করে অংশীদার করা ও তাদের উৎপাদিত বিদু্যতের ভাগ নেওয়ার ভারতীয় প্রসত্দাব মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এরফলে ভবিষ্যতে টিপাইমুখ ড্যামের ক্ষতিকর প্রভাবের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আর কিছুই বলার থাকবে না।

ড্যাম নির্মাণ করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা বা এর অন্য কোনও ব্যবহারের বিষয়টি ১৯৫০ ও ১৯৬০ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিশাল কৃতিত্ব বলে গণ্য হতো। কিন্তু ১৯৭০ সাল নাগাদ ড্যামজনিত মানুষকে বাস্তুচু্যৎ করা, কৃষিভূমি হারানো এবং বাস্তু পরিবেশের ক্ষতির পরিমাণ ড্যামের লাভের চেয়ে অনেক গুণ বেশি বলে সমীক্ষায় পাওয়া যায়। আশির দশকে ড্যামের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে এবং ১৯৯০ সালের পর থেকে সারা বিশ্বের সচেতন মানুষেরা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। ড্যাম কোনও কোনও দেশে মানুষকে কিছু সুবিধা দিতে পারে, যেখানে বাস্তুচু্যৎ মানুষকে যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। কিন্তু এশিয়ার অনুন্নত দেশগুলোতে বাস্তুচু্যৎ হওয়ার অর্থ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া বা দাসত্ব। যখন ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণ করা হয়, তখন আমাদের দেশের অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, নেপালে ড্যাম নির্মাণ করে জলাধারে পানি আটকে রেখে গঙ্গার পানি বৃদ্ধি করা হোক। সিকিমের ড্যামগুলো পানি ছাড়ছে না বরং তিস্তার তলানি প্রবাহ খেয়ে ফেলছে, যার ফলে ভাটিতে, বঙ্গীয় সমতলে এর প্রবাহ কমে গেছে।