বন্যানিয়ন্ত্রণ কিংবা সস্তা পানিবিদু্যৎ উৎপাদনের জন্য বাঁধ নির্মাণ কর্মসূচি সামপ্রতিক কালে আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদু্যতের কথাই ধরা যাক। অনেক আগে থেকে প্রচলিত ব্যবস্থায় বাঁধ নির্মাণ করে বাঁধের পেছনের এলাকায় পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে উঁচু ঢাল থেকে টারবাইনের ওপর পানি ফেলে বিদু্যৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। এতে কম বিনিয়োগে বিদু্যৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা অনেকটা প্রকৃতির দান বলে মনে করার ব্যাপারে কারও কোনও সংশয় নেই। এতে পরিবেশকলুষিত হয় না; এই বিদ্যুৎ পাওয়ার বিপরীতে কোনও খরচ নেই এবং বছরের পর বছর বিনা খরচায় ও বিনা আয়াসে প্রকৃতির অফুরন্ত দান ‘পানি’র মাধ্যমে এই বিদু্যৎপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা সম্ভব। আরও আকর্ষণীয় ব্যাপার হলো, বাঁধের পেছনে যে বিরাট কৃত্রিম হ্র্রদ তৈরি হয়, সেটা পর্যটনের আকর্ষণ ছাড়াও মাছের খামার হিসেবে গড়ে তোলা যায়। এই বিশাল পানি সংরক্ষণাগার থেকে গ্রীষ্ম ও খরার মৌসুমে প্রয়োজনমতো পানি ছেড়ে বাঁধের পাদদেশে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কৃষি উৎপাদন চালানো সম্ভব।

কিন্তু প্রকৃতি, পরিবেশ, জনগোষ্ঠী ও সমাজকাঠামোর ওপর এই বাঁধ নির্মাণের বিরূপ প্রতিক্রিয়া এখন মানুষের নজরে আসছে। প্রাকৃতিক নিয়মে প্রবহমান নদীর স্রোত ও বন্যার ঢল কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা বাঁধ দিয়ে আটকানোর ফলে বাঁধের পাশের অঞ্চলের পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। ১৯৯৪ সালের বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় জানা গেছে, এ পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ১৫ মিটার (৫০ ফুট) থেকে১৫০ মিটার উচ্চতার প্রায় ৩০০ বৃহৎ আকারের বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এ ধরনের বাঁধ নির্মাণের কারণে সারা দুনিয়ায় প্রতিবছর প্রায় ৪০ লাখ মানুষ তাঁদের পৈতৃক বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে এসব ঘরছাড়া মানুষের জীবনে কঠিন দুর্ভোগ নেমে এসেছে।

আমেরিকা ও জাপানের কথা বাদ দিলেও এশিয়া ভূখণ্ডে ভারত ও চীন এ পর্যন্ত প্রায় ২৬ হাজার ২৯১টি বাঁধ নির্মাণ করেছে। এরমধ্যে পৃথিবীর মোট বাঁধ নির্মাণের সংখ্যার হিসাবে একমাত্র চীনেই প্রায় ২২ হাজার বাঁধ নির্মিত হয়েছে। এ ধরনের ব্যাপকভিত্তিক বাঁধ নির্মাণের ফলে এ পর্যন্ত চীনে প্রায় ১২ মিলিয়ন জনগোষ্ঠী বাস্তুচু্যত হয়েছে। যেখানে বাঁধ দেওয়া হয়েছে, সেখানেই শুরু হয়েছে নদীর সঙ্গে মানুষের এক অসম লড়াই। নদীবিজ্ঞানীরা এখন বুঝতে পেরেছেন, নদীতে বাঁধ দিলে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ওই বাঁধের বিরুদ্ধে নদীর আক্রোশ কালক্রমে এমন রূপ নেয় যে, নদী অববাহিকার বিস্তীর্ণ অংশে বসবাসকারী মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে ওঠে।

এ ধরনের বাঁধ নির্মাণে খোদ ভারতে কি ধরনের অনর্থ সৃষ্টি হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর তথাকথিত উন্নয়নের লক্ষ্যে পুরো ভারতে সর্বমোট তিন হাজার ৩০০ বাঁধ নির্মিত হয়েছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, বড় জলাধারগুলো বহু গ্রাম স্থায়ীভাবে প্লাবিত করেছে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের এক সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, প্রতিটি জলাধারের জন্য গড়ে প্রায় ৪৪ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে শুরু হয়েছে সেদেশে বড় বাঁধের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন। নর্মদা নিয়ে মেধা পাটকারের আন্দোলনের ফলে বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পে সাহায্য দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। অভিযোগের আঙুল উঠেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কা ব্যারাজের দিকেও। ১৯৭৫ সালে চালু হয় ফারাক্কা প্রকল্প। জানা গেছে, ফারাক্কা থেকে জঙ্গিপুর পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি খাল কেটে ৪০ হাজার কিউসেক পানি ভাগীরথীতে ফেলার জন্য এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, অর্থাৎ ভাগীরথীর ওপর বাঁধ দিয়ে প্রাকৃতিক যোগসূত্রটি রুদ্ধ করে দেওয়া হয়। বিষয়টি গিয়ে দাঁড়াল কৃত্রিম উপায়ে নদীকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা এবং তার বিপরীতে নদীর প্রতিক্রিয়া। ফারাক্কা তৈরির পর থেকে এ পর্যন্ত পাওয়া ভারতের নদীবিজ্ঞানীদের অনুসন্ধানী রিপোর্টে জানা গেছে, দুর্বল জলপ্রবাহের জন্য এখন হুগলি নদীর মোহনায় প্রতিবছর প্রায় ৪১ টন পলি সঞ্চিত হচ্ছে। আরও যেটা ঘটেছে, জোয়ারের সময় উত্তরমুখী স্রোত এই পলি সঞ্চয়-প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত করেছে। ভারতীয় বিজ্ঞানীরা বলছেন, অতীতে বর্ষার প্রবল স্রোত পলি ধুয়ে সাগরে নিয়ে যেত। কিন্তু ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ডিভিসি, মশানজোড়, কংসাবতী, হিংলো প্রভৃতি জলাধার তৈরির পর সে প্রবাহও অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। জানা গেছে, এখন কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট প্রতিবছর প্রায় ১ দশমিক ৪০ ঘনমিটার পলি ড্রেজিং করছে। গতিশীল বিপুল জলধারা রুদ্ধ হওয়ার ফলে নদীতে দেখা দেয় নানা প্রতিক্রিয়া। গঙ্গা প্রতিবছর প্রায় ৮০ টন পলি বহন করে আনে। ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণের পর উজানে ও বাংলাদেশ অঞ্চলে নদীগুলোতে যে বিপুল পরিমাণ পলি সঞ্চিত হয়েছে, তার ফলে নদীর গভীরতা ও ঢাল হ্রাস পেয়েছে। সে জন্যই শুরু হয়েছে গঙ্গা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নদীগুলোর পরিবর্তন ও ভাঙন।

বাঁধ নির্মাণের ফলে এ ধরনের অশনিসংকেত এবং বিপত্তির কথা জানা সত্ত্বেও ভারত মণিপুর রাজ্যের চূড়াচাঁদপুর জেলার টুইভাই ও বরাক নদের সঙ্গমস্থলে ১৬২ দশমিক ৮০ মিটার উঁচু পাথরের বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত একতরফাভাবে নিয়ে ফেলেছে। যেখানে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট থেকে নর্মদা বাঁধের সর্বোচ্চ উচ্চতা ৯০ মিটার বেঁধে দেওয়া হয়েছে, সেখানে এই টিপাইমুখ বাঁধের উচ্চতা করা হচ্ছে ১৬২ দশমিক ৮০ মিটার। এই বাঁধের পাশাপাশি এ প্রকল্পে থাকবে পাঁচটি বিদু্যৎ উৎপাদনকেন্দ্র, যার প্রতিটির বিদু্যৎ উৎপাদন ক্ষমতা হবে ২৫০ মেগাওয়াট। অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বাঁধের নির্মাণকাজ শেষ হলে বাংলাদেশ মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। উল্লেখ্য, বরাক নদ হচ্ছে সুরমা ও কুশিয়ারার মূলধারা। বরাক নদ পাহাড় থেকে নেমেই সুরমা ও কুশিয়ারায় বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বিশেষজ্ঞের গবেষণাকর্ম থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ অংশে এ দুই নদীর স্রোতের গতি ও বালু বহনের ক্ষমতা পদ্মার চেয়ে বেশি। ফলে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মিত হলে নদীগর্ভে বেড়ে যাবে বালি কিংবা পলি সঞ্চালনের পরিমাণ। কয়েক বছরের মধ্যে সিলেট অঞ্চলের হাওড়-বাঁওড়, নদীনালা ভরাট হয়ে যাবে বালুর স্তর জমে। ধ্বংস হবে কৃষি, ব্যাহত হবে শস্য উৎপাদন। সুরমা ও কুশিয়ারা ধ্বংস হলে বিপন্ন হবে মেঘনার অস্তিত্ব। মহাবিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে মেঘনা নদীর জনপদে অধ্যুষিত বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী।

সামপ্রতিক কালে যত্রতত্র কিংবা তড়িঘড়ি করে বাঁধ নির্মাণের ফলে পরিবেশের ওপর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া নজরে আসছে। যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সামনে রেখে বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে, প্রায়ই সেটা ব্যাহত হচ্ছে। বাঁধের পেছনে জলাধারে ধরে রাখা পানির দ্বারা কৃষিজমি ও সেচের বিশাল এলাকা জলমগ্ন হচ্ছে। সাধারণত বর্ষা মৌসুমে প্রবল স্রোত ও পানি প্রবাহের ফলে মাটির তলদেশের লবণাক্ততা পানির উপরে চলে আসছে। এটা আবার বাষ্পীভূত হয়ে লবণের স্তর জমির ওপর থিতানো অবস্থায় জমে থাকছে। বাঁধ নির্মাণের আগে নদীর স্রোতধারা, বন্যার ঢল ও বৃষ্টির পানির বেগ সব ধরনের জঞ্জাল, লবণাক্ততা ও বজর্্য তুমুল বেগে সমুদ্রে পতিত হওয়ার পথে কোনও প্রতিবন্ধক থাকে না। ফলে কৃষিকাজের জমির লবণাক্ততা সরে যেত এবং জমির ওপর নতুন পলি পড়ে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পেত। কিন্তু বাঁধ নির্মাণের ফলে পানিপ্রবাহ আটকে যাওয়ায় লবণাক্ততা নিকাশের পথ থাকছে না।

প্রবহমান নদীর স্রোতধারা বাঁধ দিয়ে আটকে বাঁধের মুখে টারবাইন বসিয়ে বিদ্যুত উৎপাদনের ব্যবস্থা কয়লা কিংবা জীবাশ্ম, যেমন: তেল, গ্যাস জ্বালিয়ে বিদু্যৎ উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে পুরোপুরি দূষণমুক্ত বিবেচিত হলেও প্রানত্দিক পর্যায়ে আরও কিছু বিভ্রাটের কারণে পৃথিবীর উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা এখন ধারণা করছেন। তাঁদের এই সংশয়ের পথ ধরে ১৯৯৮ সালে বাঁধ নির্মাণের উপযোগিতা এবং এরসঙ্গে ত্রুটি-বিচু্যতি বিশ্লেষণের লক্ষ্যে পৃথিবীব্যাপী বিশাল বাঁধগুলোর ওপর সমীক্ষা তৈরি করার জন্য ‘বিশ্ব বাঁধ কমিশন’ নামের একটি সংস্থা গঠন করা হয়। ওই সংস্থার উদ্যোগে দীর্ঘ দুই বছর বিশ্বব্যাপী নির্মিত ৪৫ হাজার বাঁধের মধ্যে এক হাজারটির নিকটবর্তী অঞ্চলে সংশ্লিষ্ট জনগণ ও পাশের এলাকা থেকে উপাত্ত নিয়ে একটি ব্যাপক রিপোর্ট তৈরি করা হয়। এই সমীক্ষা রিপোর্ট নেতিবাচক হওয়ায় বিশ্বব্যাংক বিশাল বাঁধ নির্মাণ কর্মসূচিতে অর্থ সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছে।

বাঁধ নির্মাণ একটি দেশের অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে, এটা স্বীকৃত হলেও এ উদ্যোগ সামগ্রিককভাবে ভালো ফল বয়ে আনেনি। নদীর স্রোতধারার সঙ্গে প্রবাহিত হয়ে আসা লতা, গুল্ম, পাতা, গাছপালা এবং প্রাণীদেহ পচে লাখ লাখ টন মিথেন ও কার্বন ডাই-অঙ্াইড গ্যাস বায়ুমণ্ডলে উৎক্ষিপ্ত হয়। আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা এখন সংশয়মুক্ত যে, এই গ্রিনহাউস গ্যাস বা কার্বন ডাই-অঙ্াইড পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। এছাড়া বিশাল বাঁধগুলো বন্যার পানির স্রোত কিংবা বন্যাচক্র বদলে দেয়, যেমনটি ঘটেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে। উজানে বাঁধ দেওয়া এবং বিভিন্ন নদীমুখে অপরিকল্পিতভাবে স্লুইসগেট নির্মাণের ফলে উত্তরাঞ্চলের অনেক নদী শুকিয়ে গেছে। যশোর ও খুলনা জেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত কপোতাক্ষ নদের চিহ্ন এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। নদীতে বালু জমে যশোরের ভবদহ ও সাতক্ষীরার বিস্তীর্ণ এলাকায় স্থায়ীভাবে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।

তারিখ: ২২-১২-২০১১
আসাদউল্লাহ খান: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক