উপেন্দ্র কিশোর রায়

উপমহাদেশে যে কজন ব্যক্তি স্ব-স্ব কর্মজ্ঞানে বিশ্ববরণ্য হয়েছেন বিশ্ববিখ্যাত চলচিত্রকার অস্কার পুরষ্কার বিজয়ী সত্যজিত রায় এদের মধ্যে একজন। তিনি ভারতীয় চলচিত্র জগতে এক উজ্জল নক্ষত্র। তার পিতামহ উপেন্দ্র কিশোর রায় বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা বর্তমানে কিশোরগঞ্জ জেলাধীন কটিয়াদী উপজেলার ৭নং মসূয়া ইউনিয়নের, মসূয়া গ্রামে ১৮৬৩ সালের ১০মে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম কালীনাথ দেব ওরফে শ্যাম সুন্দর দেব, মাতার নাম জয়তারা দেবী। পিতা মাতা আদর করে কার নাম রাখলেন কামদারঞ্জন।

উপেন্দ্র কিশোরের এক কাকা ছিলেন মসূয়ার বড় জমিদার নাম তার হরি কিশোর রায়। বিশাল জমিদারি, দাস-দাসি,পাইক-পেয়াদা থাকলেও তার অন্তরে কোন শান্তি ছিল না। কারণ তিনি ছিলেন নিঃসন্তান, সন্তানের অভাব পূরেন করতে তিনি কামদারঞ্জনকে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহন করেন। তখন কামদা রঞ্জনের বয়স ছিল ৫ ব‍ৎসর।

দত্তক নেওয়ার পর জমিদার হরি কিশোর রায় কামদা রঞ্জনের নাম পরিবর্তন করেন এবং নিজের নামের সাথে মিল রেখে তার নাম রাখলেন উপেন্দ্র কিশোর রায়। পরবর্তীতে হরি কিশোররায়ের এক পুত্র সন্তান জন্ম লাভ করে তার নরেন্দ্র কিশোর রায়। উপেন্দ্র কিশোররায়ের লেখাপড়া আরম্ভ হয় ময়মনসিংহ শহরে।হরি কিশোররায়ের নিজ বাসা দুর্লভ ভবন থেকে ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে লেখা পড়া করতেন। ময়মনসিংহ শহরে হরি কিশোর রায়ের খুব প্রভাব ছিল। ময়মনসিংহ শহরে তার নামানুসারে হরি কিশোর রায়ের নামে একটি রোড আজ্ও তার স্মৃতি বহন করছে।

ছাত্রাবস্থায় উপেন্দ্র কিশোর রায়ের গান বাজনায় ও ছবি আঁকায় প্রবল আগ্রহ ছিল। সময় পেলেই তিনি গান গাইতেন। আপন মনে বিভিন্ন ধরণের ছবি আঁকতেন। এসময়  তিনি সহপাঠী গগন চন্দ্র হোম এর সান্নিধ্যে আসেন এবং তাঁর কাছে ব্রাহ্ম ধর্মের উদারতা ও রীতিনীতির কথা শুনে ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। কিন্তু তাঁর পালক পিতা হরি কিশোর রায় ছিলেন গোঁড়া হিন্দু। তিনি এসব পছন্দ করতেন না। তবু গোপনে তিনি গগনের সাথে দেখা করতেন ও ব্রাহ্ম ধর্মের কথা শুনতেন। ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে তিনি প্রথম বিভাগে স্কলার শিপ নিয়ে এন্ট্রাস পরীক্ষা পাশ করেন। তারপর উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য ভর্তি হন কলকাতার   প্রেসিডেন্সি কলেজে। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র সতের বৎসর। কলেজে অধ্যয়ন কালেই কলকাতার শিল্পী সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের সাথে পরিচিত হয়ে উঠেন। এভাবেই একদিন তিনি জোড়া সাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সাথে আন্তরিকতা সৃষ্টি করে ফেলেন।শুধূ ঠাকুর পরিবারেই নয়, তিনি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত  করতেন। এক সময় তাঁর সাথে পরিচিত হয় সেকালের খ্যাতিমান ও সংস্কারমুক্ত মনের মানুষ ব্রাহ্মনদ্ধ কেশব চন্দ্র সেনের। কেশব চন্দ্র ছিলেন ব্রাহ্ম। তাঁরই প্রভাবে তিনি একদিন হিন্দু ধর্ম ছেড়ে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা নেন। এ সময় তিনি কয়েক বার ময়মনসিংহ ও  মসূয়াতে বেড়াতে আসেন।

উপেন্দ্র কিশোর রায় ২১ বৎসর বয়সে বি.এ পাশ করেন। তিনি চাকুরি না নিয়ে সাহিত্য সাধনায় আত্ননিয়োগ করেন। ব্রাহ্ম সমাজে আসা যাওয়ার ফলে পরিচয় হয় দ্বারকানাথ গঙ্গোপধ্যায়ের সাথে। উপেন্দ্র কিশোর প্রায়ই তাঁর বাড়িতে  যাতায়াত করতেন। দ্বারকানাথ ও তাঁর স্ত্রী কাদম্বিনী, যিনি প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট এবং প্রথম মহিলা ডাক্তার ছিলেন, উভয়ই তাকে খুব স্নেহ করতেন।

বিধুমুখী নামে তাঁদের এক কন্যা ছিল। উপেন্দ্র কিশোর বিধুমুখীর আচেরনে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ভালবেসে ফেলেন। ১৮৮৩ সালে তিনি বিধুমুখীর সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। এ নব দম্পতি কলকাতার ১৩ নম্বর কর্ণওয়ালিশ ষ্ট্রিটে এক ভাড়া করা বাসায় দাম্পত্য জীবন শুরু করেন। এ সময় তিনি সাহিত্য সাধনায় গভীরভাবে আত্ন নিয়োগ করেন। ছোটদের রামায়ন, সেকালের কথা, ছোটদের মহাভারত, এবং টুনটুনির বই।

সাহিত্য কর্মের পাশাপাশি তিনি ছাপা ও ব্লক তৈরির কলা কৌশল শিখেছিলেন। যার ফলে তিনি নিজেই একটি  ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ছাপাখানার নাম দেন “ইউ রায় এন্ড সন্স” (U.RAY & SONS)। এ ছাপা খানা হতে ১৯১৩ সালে প্রকাশ করেন বিখ্যাত শিশু পত্রিকা “সন্দেশ”।

ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী। অতিরিক্ত পরিশ্রম ও মহুমূত্র রোগের আক্রমনে তাঁর স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙ্গে পরেবহু চিকি‍ৎসার পরেও তিনি আরোগ্য লাভ করতে পারেন নি। ১৯১৫ সালে ২০ ডিসেম্বর ৫৩ বছর বয়সে তিনি পরলোক গমন করেন।

কলকাতার ১৩নং কর্ণওয়ালিশ ষ্ট্রিটে অবস্থানকালে ১২৯৪ সনে ১৩ কার্তিক (১৮৮৭) সুকুমার রায়ের জন্ম হয়। ভাই বোনদের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়।পিতার সুযোগ্য উত্তরসুরী হিসাবে উপেন্দ্র কিশোর রায়ের সমস্ত গুনাবলি তিনি পেয়েছিলেন। তাই শিশুকাল থেকেই অতি সহজে চিত্রাংকন, গান বাজনা ও অভিনয়ে পারদর্শিতা অর্জন করেন।

সুকুমার রায় ১৯১১ সালে অক্টোবর মাসে ফিজিস্ক ও কেমিস্ট্রিতে ডবল অর্নাস নিয়ে বি.এসসি পাশ করেন, লাভ করেন গুরু পসন্ন বৃত্তি তারপর আলোকচিত্র ও ছাপাখানা প্রযুক্তি বিদ্যা উচ্চতর ডিগ্রী লাভের জন্য লন্ডন যাত্রা করেন। ১৯১৩ সালে দেশে ফিরে এসে তিনি পিতার ছাপা খানা ইউ রায় এন্ড সন্সের (U.RAY & SONS)এর উন্নতি সাধন ও সাহিত্য সাধনায় মনোনিবেশ করেন। এসময়েই তিনি ঢাকার খ্যাতনামা সমাজ সেবক কালী নারায়ণ গুপ্তের দৈৗহিত্রী সুপ্রভার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর কণ্যাকে আর্শিবাদের জন্য শিলাইদহ হতে বিবাহ অনুষ্ঠানে যোগদেন।

– সংগ্রহিত