জেলার কটিয়াদী উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার দূরে লোহাজুরি ইউনিয়নের একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত কুঁড়েরপাড় গ্রাম। আঁকাবাঁকা পথ ধরে, কখনো বা মেঠো আবার কখনো বা পাকা সড়ক পার হয়ে কুঁড়েরপাড় গ্রামে পৌঁছতে হয়। এই অজপাড়াগাঁটি আজ প্রায় সকল জেলাবাসীর নিকট একটি পরিচিত নাম। এমন কি বাইরে থেকে কেউ কটিয়াদীতে বেড়াতে আসলেও কুঁড়েরপাড় গ্রামটি ঘুরে আসতে ভুল করেন না।

তরুণ প্রজন্মের নিকট মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার জন্য গ্রামের বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি যাদুঘর ‘মরুদ্বীপ’ এলাকার তরুণ আইনজীবী নূরুজ্জামান ইকবাল সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগেই এই যাদুঘরটি গড়ে তুলেছেন। ২০০৮ সালে নূরুজ্জামান ইকবালের আমন্ত্রণে এ গ্রামে এসেছিলেন ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি বীরপ্রতীক। ভাষাসৈনিক মতিন কুঁড়েরপাড় গ্রামে এসে সেখানে একটি মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেন। তখন থেকেই এর পরিকল্পনা শুরু করেন ইকবাল। ২০১০ সালের ৩০ মার্চ বিচারপতি হাবিবুর রহমান খান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ. স. ম আরেফিন সিদ্দিকী মরুদ্বীপের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। একই দিন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী মরুদ্বীপে স্থাপিত স্বাধীনতা সংগ্রামে বীর শহীদদের স্মরণে ‘দুর্বার’ নামক স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন করেন। ২০১১ সালের ৩০ মার্চ মূল ফটকের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়স্থ প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের চেয়ারম্যান ও প্রতিমন্ত্রী ড. মির্জা জলিল। মরুদ্বীপে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর একটি ম্যুরাল উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক কবি আবু জাফর সিদ্দিকী।

মরুদ্বীপে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর একটি বিশাল প্রতিকৃতি, মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতি নিদর্শন এবং বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের নামে উত্সর্গীকৃত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসম্বলিত একটি সেতু ‘বিজয়ের পথ’  পানির ওপর স্থাপিত হয়েছে একটি গোলাকার আকৃতির দোতলা ভবন, যা দূর থেকে দেখলে পানির ওপর ভাসমান মনে হয়। এই ভবনের নিচ তলায় থাকবে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতি নিদর্শন এবং দোতলায় অতিথিদের জন্য একটি রেস্ট হাউজ। ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ও দর্শনার্থীদের জন্য মরুদ্বীপ প্রাঙ্গণে স্থাপিত হয়েছে বিভিন্ন বিশ্রামাগার। দর্শনার্থীদের বসার জন্য অসংখ্য বেঞ্চ স্থাপন করা হয়েছে। পরিকল্পনামাফিক এখানে ভবিষ্যতে নির্মাণ করা হবে একটি বিনোদন পার্ক ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সম্বলিত নিঝুম দ্বীপ। মরুদ্বীপের পাশেই রয়েছে একটি বিশাল আকৃতির পুকুর। এখানে রয়েছে বোট ও দেশি নৌকা। ইচ্ছা করলে নৌকায় চড়ার আনন্দও উপভোগ করা যায়।

প্রকল্পের কাজ এখনো পুরোপুরি শেষ না হলেও এখনই প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে প্রচুর দর্শনার্থী এখানে আসেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে এখান থেকে ফিরে যান তারা। আসে স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরাও। কেউ খাবার সঙ্গে করে নিয়ে এসে সারাদিন এখানে কাটান। মরুদ্বীপ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি রক্ষা ফাউন্ডেশনের মহাসচিব অ্যাডভোকেট নূরুজ্জামান ইকবাল জানান, ভাস্কর মৃণাল হকের তত্ত্বাবধানে এখানে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম. এ. জি ওসমানীর প্রতিকৃতিসহ ১১ সেক্টর কমান্ডারদের ভাস্কর্য বর্তমানে নির্মাণাধীন রয়েছে। ভবিষ্যতে এখানে মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি পর্যটন নগরী গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে তার।

লেখকঃ সুবীর বসাক, ইত্তেফাক