ময়মনসিংহের লোকসাহিত্য মানব-মানবীর স্বাধীন প্রণয়সাধনা তথা মুক্ত জীবনাকাক্সক্ষা চরিতার্থ করার সহজাত প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ময়মনসিংহ লোকসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশে রয়েছে কবিগান, যাত্রা, লাঠিখেলা, পুতুল নাচ, নৌকা বাইচ, বাহন্যার গীত, গীতিকা, মেয়েলী গীত, ছড়া, জারীগান, হাইর বা মারফতী গান, পুঁথি পাঠ, মুর্শিদী গান, শোকগাথা সারিগান, গাডু বা ঘাটু গান, বারমাস্য বা বারমাসী, বাউলগান, লোকায়ত শিল্পকলা ইত্যাদি। ময়মনসিংহ গীতিসমূহে স্বাভাবিকভাবেই ময়মনসিংহ অঞ্চলের নৈসর্গিক, ভৌগলিক, মৃতাত্ত্বিক পরিবেশ উম্মোচিত হওয়ার পাশাপাশি উহার উদ্ভব-কাল, ভাষা, কাহিনী নির্বাচন, ঘটনা বিন্যাস উন্নত শিল্পমান সমৃদ্ধ।ড. দীনেশ চন্দ্র সেন সম্পাদিত মৈয়মনসিংহ গীতিকাসমূহ ময়মনসিংহের লোক সাহিত্যের স্বর্ণখনি হিসেবে বিবেচিত। বাংলাগাথা বা গীতিকা ষোড়শ থেকে উনবিংশ শতকের সৃষ্টি বলে এগুলো মোটামুটি সমাজ সচেতন কবিদের সৃষ্টি। গীতিকা হবে সংক্ষিপ্ত, তা বিস্তৃতি লাভ করবে তার নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি ও শব্দ ভাণ্ডারের মাধ্যমে। আমাদের মৈয়মনসিংহ গীতিকা-এর কোন স্থলেই এই অযথা অতিশায়োক্তির বাহুল্য নেই।

গীতিকা যা বলার নাটকয়িভাবে দ্বন্ধ-সংঘাতের মধ্য দিয়ে বলে যাবে। গীতিকা বংশানুক্রমে চলে আসা লোক ভাষা নিয়ে গড়ে উঠে। গীতিকাসমূহে যে জীবনবোধের প্রতিফলন ঘটেছে এক কথায় তা অভূতপূর্ব। জীবান্ত পরমাত্মার সম্মিলন-সন্ধান গীতিকাসমূহের আত্মার ধ্বনিপুঞ্জ হয়ে উঠেছে। এতে ব্যক্তি-আশ্রয়ী ধর্মবোধ বিচ্ছিন্ন প্রণয়ালকাক্সক্ষা এবং সে আকাক্সক্ষা চরিতার্থ করার জন্যে যে জীবন সংগ্রাম সেই জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রণয়ের শক্তিই প্রমাণিত হয়েছে। সামাজিক সাম্যের অনুপস্থিতি প্রণয়ের ক্ষেত্রে যে সমস্যাও সংকট তৈরী করে, সেই সমস্যা ও সংকাটের পার্শ্বচিত্র যেনো গীতিকাসমূহ। ময়মনসিংহ গীতিকায় যে চিত্রিত জনজীবন, তাদের চাওয়া-পাওয়া আশা- আকাক্সক্ষা যে ছবি মূর্ত হয়ে উঠেছে তা একান্তভাবেই গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের। মৈয়মনসিংহ গীতিকার বিভিন্ন পালার চরিত্র সমূহের মধ্যে রয়েছে জীবন-তৃষ্ণা ও জীবন আকাক্সক্ষার ব্যাকুলতা। চরিত্র সমূহের আত্মবিসর্জন বা আত্মত্যাগের পিছনেও কাজ করে পারলৌকিক মিলনাকাক্সক্ষা বা পূর্ণ প্রত্যাশা। বিভিন্ন চরিত্র আত্মবিসর্জন করলেও সব কিছুর মূলে রয়েছে জীবনের প্রতি তৃষ্ণা, অতৃপ্ত বাসনা ও বেঁচে থাকার আকাংক্ষা । মহুয়া, মলুয়া, মদিনা, লীলা- তাদের কেউই প্রেমাস্পদকে মর্ত্যজীবনের বাইরে প্রত্যাশা করেনি। পরলোকে কিংবা অন্য কোনো জগতে তারা মিলনাকাক্সক্ষা নয়। এ থেকেই বোঝা যায় যে, তাদের জীবন তৃষ্ণা বিপুল।

মানবিক চেতনায় সচেতন থেকেই পালাকারগণ চরিত্র চিত্রণ করেছেন। মানবীয় বৃত্তি ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গীতিকার বিভিন্ন পালায় ব্যক্তিক জীবন ও ব্যক্তি-অনুভূতি সমৃদ্ধ পালাগুলোর সার্থক রূপকার গীতিকার কবিগন। পালাকারদের গভীর পর্যবেক্ষণ, শক্তি, জীবনবোধ, গভীর জীবনদৃষ্টি ও জীবনোপলদ্ধিজাত মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে সৃষ্ট চরিত্র নিয়েই মৈয়মনসিংহ গীতিকার জনজীবন গড়ে উঠেছে। গীতিকার বিভিন্ন চরিত্রের জীবন তৃষ্ণ, জীবনাগ্রহ, জীবনচারণ একেবারেই প্রত্যাহিক এবং ইহলৌকিক। ঘটনা বিন্যাসের ক্ষেত্রে মৈয়মনসিংহ গীতিকাসমূহের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর নাটকীয়তা, গীতিধর্মীতা, সংলাপ, দৃশ্য ও চিত্রসয়তা। গাঁথা সমূহে আমরা লক্ষ্য করি উচ্চাকাঙ্খা, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা, ঘড়যন্ত্র প্রয়াস, নির্জন প্রিয়তা, মানবীয় উদার্থ, উন্নত চরিত্রগুণ আতœরিক প্রণয়াবেগ, সংবেদনশীলতা দারুণভাবে সক্রিয়।

মৈয়মনসিংহ গীতিকাগুলোতে সমাজের শাসক ও শোষকের ভূমিকা বিধৃত হয়েছে। আন্তরিক প্রণয়াবেগ, মানবীয় উদার্য, সংবেদনশীলতা, উন্নত চরিত্র গীতিকাসমূহে ভাষা পেয়েছে। ‘মহুয়া’, ‘দেওয়ানা ভাবনা’, ‘মলুয়া’, ‘দেওয়ানা মদিনা’, ‘রূপবতী’, ‘কমল’, ‘মৈষাল বন্ধু’, ‘দস্যু কেনারামের পালা’, ‘ফিরোজ খাঁ দেওয়ান’, ‘দেওয়ান ঈশা খাঁ মসনদালি’, ‘ভেলুয়া’, ‘আন্ধা বন্ধু’, ‘বীর নারায়নের পালা’, ‘কাজল রেখা’, ‘বারতীর্থের গান’, ‘মুকুট রায়’, ‘রতন ঠাকুরের পালা’, ‘রাজা রঘুর পালা’, ‘ভারইয়া রাজার কাহিনী’, ‘শ্যাম রায়’, ‘জীবলেনী’, ইত্যাদি গাথায় আত্মত্যাগ, প্রণয়াবেগ, সংবেদনশীলতার পাশাপাশি শাসক- শোষকের ঘৃণা চরিত্র প্রতিফলিত ঘটেছে।

মৈনমনসিংহ গীতিকায় চন্দ্রাবতী, মলুয়া ও দস্যু কেনারাম নামের যে তিনটি পালা রয়েছে তা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম মধ্যযুগীয় মহিলা কবি চন্দ্রাবতী সংশ্লিষ্ট। চন্দ্রাবতী পালাটি কবি নয়ানচাঁদ ঘোষ রচনা করেন, যার মাধ্যমে আমরা কবি চন্দ্রাবতী বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া প্রেমের বিয়োগাত্মক ঘটনা জানতে পারি। আবার মলুয়া ও দস্যু কেনারাম নামক পালা দুটি রচনা করেন কবি চন্দ্রাবতী। তাছাড়া মহিলা কবি হিসেবে চন্দ্রাবতী প্রথম বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করেন। ড. দীনেশ চন্দ্র সেন তাঁর সম্পাদিত ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ চতুর্থ খন্ডে কবি চন্দ্রাবতী বিরচিত রামায়ণ প্রকাশ করেন।

নয়ানচাঁদ ঘোষ বিরচিত মৈয়মনসিংহ গীতিকার চন্দ্রাবতী নামক পালাটিই বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম মধ্যযুগীয় মহিলা কবি চন্দ্রাবতীর জীবনীর তথ্যভিত্তিক লিখিত প্রমান্য দলিল। এই চন্দ্রাবতী গাথার মাধ্যমে কবি চন্দ্রাবতীর বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া প্রেমের বিয়োগত্তক ঘটনা জানতে পারি। বাংলার প্রথম মহিল কবি চন্দ্রাবতীর জন্মস্থান ও তার রচনার সিক্তভূমি কিশোরগঞ্জ সদর থানার মাইজখাপন ইউনিয়নের কাচারী পাড়া গ্রামে। চন্দ্রাবতী দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা। মায়ের নাম সুলোচনা। কাচারী পাড়া গ্রামে যে শিব মন্দিরটি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তা চন্দ্রাবতীর শিবমন্দির নামেই বহুল পরিচিত। চন্দ্রাবতী পালাটি ১২টি অধ্যায়ে শেষ হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে ফুল-তোলা, দ্বিতীয় অদ্যায়ে প্রেমলিপি, তৃতীয় অধ্যায়ে পত্র দেওয়া, চতুর্থ অধ্যায়ে বংশীর শিবপূজা, কন্যার জন্য বরকামনা, পঞ্চম অধ্যায়ে চন্দ্রার নির্জনে পত্রপাট ষষ্ট অধ্যায়ে নীরবে হৃদয়দান, সপ্তম অধ্যায়ে বিবাহের প্রস্তাব ও সম্মতি, অষ্টম অধ্যায়ে বিবাহের আয়োজন নবম অধ্যায়ে মুসলমান কন্যার সঙ্গে জয়জন্দ্রের ভাব দশম অধ্যায়ে দুঃসংবাদ একাদশ অধ্যায়ে চন্দ্রার অবস্থা দ্বাদশ অধ্যায়ে শেষ।

নয়নচাঁদ ঘোষের বর্ণনায় জানা যায় যে, কবি চন্দ্রাবতীর জীবনেতিহাস বড়ই করুণ ও এক বিয়োগান্ত কাহিনী। চন্দ্রাবতী যেমন কবি ছিলেন তেমনি ছিলেন রোমান্টিক মনের অধিকারিণী। চন্দ্রাবতী পরমা সুন্দরী ছিলেন। বাল্যকাল থেকে তিনি কবিতা রচনা করতেন। তার রূপ ও গুণের খ্যাতি শুনে অনেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি তার পানিগ্রহণে ইচ্ছুক হতো। কিন্তু চন্দ্রাবতীর প্রার্থেব দেবতা ছিলেন পার্শ্ববতী গ্রামের জয়ানন্দ নামক এক ব্রাহ্মণ যুবক। বাল্যকাল থেকেই উভয়ে একত্রে লেখাপড়া ও খেলাধূলা করতেন। পিতার পুজার জন্য ফুলতুলতে যখন চন্দ্রাবতী উদ্যানে প্রবেশ করতেন, তখন জয়ানন্দ সাথে থেকে তাকে সাহায্য করতো,  চন্দ্রাবতী কাব্যে আছে-

“ডাল যে নোয়াইয়া ধরে জয়ানন্দ সাথী।
তুলিল মালতী ফুল কন্যা চন্দ্রাবতী ॥
একদিন তুলি ফুল মালা গাঁথি তায়।
সেইত না মালা দিয়া নাগরে সাজায় ॥”

এদের এই ঘটনার কথা পিতা জানতেন না। কিন্তু চন্দ্রা ও জয়ানন্দের বিবাহের প্রস্তাব যখন পিতা বংশীদাসের নিকট এল তখন তিনি তাকে সম্মতি প্রদান করেন এবং বিবাহের যাবতীয় আয়োজনে মন দেয়। এদিকে ঘটে যায় আর এক ঘটনা। জয়ানন্দ কমলা নাুী এক মুসলমান রমণীর প্রেমে আবদ্ধ হয়ে ধর্মান্তরিত হলেন। চন্দ্রাবতী এতে দারুণ আঘাত পান। তার অন্তরে জাগ্রত হয় বৈরাগ্য। তিনি আমৃত্যু শুদ্ধাচারিণীর মত শিবপূজায় মনোনিবেশ করে জীবন কাটিয়ে দেবেন সিদ্ধান্ত নিলেন। পিতার কাছে তিনি দু’টি প্রার্থনা করলেন। একটি ফুলেশ্বরী নদীর তীরে মন্দির প্রতিষ্ঠা, অন্যটি তার চিরকুমারী থাকার ইচ্ছা। পিতা তার দু’টি প্রার্থণাই মঞ্জুর করলেন। সে মন্দির আজও মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে তার জন্মস্থানে। নিদারুণ আঘাতে যাতে চন্দ্রাবতী একেবারে মুষড়াইয়া পড়েন। জয়ানন্দ পরে তার ভুল বুঝতে পেরে আত্মগ্লানিতে দিশেহারা হলেন। জয়ানন্দ চন্দ্রার দর্শন প্রার্থী হয়েএক পত্র লিখলেন। তিনি জানালেন, চন্দ্রাকে এক নজর দেখে জীবনের শেষ আশা পূরণ করবেন। চন্দ্রাবতী তার অসম্মতির কথা জয়ানন্দকে পত্র লিখে জানান। অনুতপ্ত জয়ানন্দ পত্র পাঠ করে পাগলপ্রায় উদভ্রান্ত অবস্থায় চন্দ্রাবতীর মন্দিরের দ্বার দেশে উপস্থিত হন। কিন্তু মন্দিরের দ্বার ভিতর থেকে রুদ্ধ।

“পাগল হইল জয়ানন্দ ডাকে উচ্চৈস্বরে।
দ্বার খোল চন্দ্রাবতী দেখা দেও আমারে ॥
না ছুইব না ধরিব দূরে থাক্যা খাড়া।
ইহজন্মের মতন কন্যা দেও মোরে সাড়া ॥
দেবপূজার ফুল তুমি তুমি গঙ্গার পানি।
আমি যদি ছুই কন্যা হইবা পাতকিনী ॥
নয়ন ভরে দেখ্যা যাই জন্মশোধ দেখা।
শৈশবের নয়ান দেখি নয়ানভঙ্গি বাকা ॥”

অভিমানিনী চন্দ্রা তাকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেন। হতভাগা জয়ানন্দ তখন মন্দিরের প্রাঙ্গণে সদ্যফোটা সন্ধ্যামালতী ফুলের রস নিংড়িয়ে মন্দিরের কপাটের উপর চার ছত্র কবিতা লিখে যান। কবিতাটি নিুরূপ-

“শৈশবকালের সঙ্গী তুমি যৈবনকালের সাথী।
অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী ॥
পাপিষ্ঠ জানিয়া মোরে না হইলা সম্মত।
বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মত ॥”

চন্দ্রাবতী পরে মন্দির খুলে এ কবিতা লেখা দেখতে পান। এই কবিতা খানি ধুয়ে মুছে ফেলার জন্যে চন্দ্রাবতী নদীর ঘাটে জল আনতে গিয়ে দেখেন নদীর জলে ভেসে আছে প্রেমিক জয়ানন্দের মৃত লাশ। চন্দ্রাবতী কাব্যে উল্লেখ আছে-

“জলে গেল চন্দ্রাবতী চক্ষে বহে পানি।
হেনকালে দেখে নদী ধরিছে উজনী ॥
একেলা জলের ঘাটে সঙ্গে নাহি কেহ।
জলের উপরে ভাসে জয়ানন্দের দেহ ॥”
জয়ানন্দের লাশ দেখার পর চন্দ্রাবতীর অবস্থা কবি নয়ানচাঁদ বর্ণনা করেছেন এভাবে-
“আখিতে পলক নাহি মুখে নাই সে বাণী।
পারেতে খাড়াইয়া দেখে উমেদা কামিনী ॥”
নয়ানচাঁদ চন্দ্রাবতীর দুঃখের কাহিনী এভাবে শেষ করেনঃ
“স্বপ্নের হাসি স্বপ্নের কান্দন নয়ান চান্দে গায়।
নিজের অন্তরের দুষ্কু পরকে বুঝান দায় ॥”

গবেষকদের মতে, নদীর ঘাটে মৃত অবস্থায় জলে জয়ানন্দের লাশ ভাসতে দেখে তীব্র অনুশোচনায় চন্দ্রাবতীও পরবর্তীতে ফুলেশ্বরী নদীর জলে ঝাঁপিয়ে জয়ানন্দের মত অনুগামী হন। এখানে একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয় যে, জয়ানন্দ তিনিও একজন স্বভাব কবি ছিলেন। কিংবা কবি প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। আবার কারো মতে, জয়ানন্দের জলে ডুবে আত্মহত্যা বা মৃত্যুর কিছুদিন পরপরই শোকাবিভূত চন্দ্রাবতী মর্মান্তিক আঘাত প্রাপ্ত হয়ে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন।

জয়ানন্দের সাথে চন্দ্রাবতীর বিবাহের প্রস্তাব ভেঙ্গে যাবার পর কবি চন্দ্রাবতী আজীবন কুমারীত্ব থাকার ইচ্ছা নিয়ে রামায়ন কাব্য গ্রন্থ রচনা করেন। পিতা দ্বিজবংসী দাস চন্দ্রাবতীর মনকে অন্যদিকে ধাবিত করার জন্য কন্যাকে রামায়ন কাব্য রচনা করতে আদেশ দেন। তিনি সীতার বনবাস পর্যন্ত লিখেছিলেন। বাংলা ভাষায় রামায়ন লেখা অসমাপ্ত রয়ে যায়। অথচ এই অসমাপ্ত রামায়নই তাকে সারা বাংলা সাহিত্যে অমর করে রেখেছে। চন্দ্রাবতীর লেখা রামায়নের পান্ডুলিপি বর্তমান কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। চন্দ্রাবতীর বাংলা ভাষায় রচিত এই রামায়ন গ্রন্থই এককালে শুধু বৃহত্তর ময়মনসিংহের পূর্ব ময়মনসিংহ নয়, সমগ্র পূর্ব বাংলা অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশসহ সমগ্র পশ্চিম বাংলার ভারতের ও অনেক স্থানে মহিলাদের কণ্ঠে গীত হতো। বিগত শতাব্দিসহ বর্তমানেও এই কিশোরগঞ্জের ভাটি অঞ্চলের কুলবালা নারীগণ তাদের সূর্য ব্রতের দিন উদয়াস্ত থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এই রামায়নের কাহিনী সুরারোপ করে গান গেয়ে থাকেন। চন্দ্রাবতীর রামায়নই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে জেলা কিশোরগঞ্জের এই মহিয়সী কবি কন্যা চন্দ্রাবতীর নাম চির অমর করে রেখেছে।

শৈশবে কবি চন্দ্রাবতী প্রতিবেশি ত্রিনাথ ঠাকুরের সংস্পর্শে এসে ধর্মীয় জ্ঞানে অর্থাৎ রামই যে ব্রহ্মা নারায়ন যুগে যুগে ভিন্ন ভিন্ন নামে তিনি এ ধরণীর এষণা সাধ পূর্ণ করছে তাকেই পয়ার ছন্দাকারে পূর্ণ করতে স্বরসতীর আশীর্বাদে বাল্মিকীর রামায়ণকে পদ্যাকারে রূপ দিতে গিয়ে কবি নিজেও আরেক প্রেমিক জয়ানন্দের প্রেমে পড়ে তার জীবনকে সীতার ন্যায় বনবাসে না গিয়ে বিসর্জন দিলেন প্রেমের সলিল সমাধি রূপে। সীতার বনবাস সম্বন্ধে কবি চন্দ্রাবতী রামায়ণে কুকুয়া চরিত্র সংযোজন করে একটি সুন্দর কাহিনীর অবতারণা করেছেন। উদ্বৃতাংশ পাঠ করলেই বোঝা যাবে যেমন-

“উপকথা সীতারে গো শুনায় আলাপিনী ॥
হেনকালে আইল তথায় গো কুকুয়া ননদিনী ॥
কুকুয়া কইল, “বধু গো, মোর বাক্য ধর।
কিরূপে বঞ্চিলা তুমি গো রাবণের ঘর ॥
দেখি নাই রাইক্ষসরে গো শুইন্যা কাঁপে হিয়া।
দশমুন্ড রাবণ নাকি দেখাও গো, আঁকিয়া।’
মূর্চ্ছিতা হইল সীতা গো রাবণ নাম শুনি।
কেহ বা বাতাস করে কেহ মুখে দেয় পানি ॥
সখিগণ কুকুয়ারে গো কত করিল বারণ।
‘অনুচিত কথা তুমি গো জিগাও কি কারণ ॥
রাজার আদেশ নাই গো জিগাইতে কুকথা।
তবে কেন ঠাকুরাণীর গো মনে দিলা ব্যাথা ॥’
প্রবোধ না মানিল সেই গো কুকুয়া ননদিনী।
বার বার সীতারে গো বলয়ে সেই বাণী ॥
সীতা বলে, ‘আমি তার গো না দেখিয়াছি নয়ানে।
কিমতে আঁকিবাম আমি গো পাপিষ্ঠ রাবণে ॥
যত কইর‌্যা বুঝায় সীতা গো কুকুয়া না ছাড়ে।
হাসিমুখে সীতারে গো সুধায় বারে বারে ॥
বিষলতার বিষফল গো বিষগাছের গোটা।
অন্তরে বিষের হাসি গো বাধাইল লেঠা ॥
সীতা বলে, ‘দেইখ্যাছি গো ছায়ার আকারে।
হরিয়া গখন দুষ্ট গো লয়্যা যায় মোরে ॥
সাগরের জলেতে পড়ে গো রাইক্ষসের ছায়া।
দশমুন্ড কুড়ি হস্ত গো রাইক্ষসের কায়া ॥’
বইস্যা আছিল কুকুয়া গো শুইল পালঙ্কতে।
আবার সীতারে কয় গো রাবণ আঁকিতে ॥
এড়াইতে না পারে সীতা গো, পাঙ্খার উপরে।
আঁকিলেন দশমুন্ড গো রাজা লঙ্কেশ্বরে ॥
শ্রমেতে কাতর সীতা গো নিদ্রায় ঢলিল।
কুকুয়া তালের পাঙ্খা গো বক্ষে তুইল দিল।”

কুকুয়া ছিল কৈকেয়ীর এক কন্যা। মাতার ন্যায় সেও রামচন্দ্রের সর্বনাশ কামনা করত। তাই সে সীতাকে দিয়ে তাল পাতার পাখার উপর রাবণের প্রতিকৃতি অংকন করাল এবং তা সীতার উপর রেখে রামকে দেখিয়ে বললো, দেখ তোমার সীতা এখনো রাবণকে ভুলতে পারেনি। ফলে তিনি সীতাকে নির্বাসন দিলেন। এখানে একটি কথা না বললেই নয় যে চন্দ্রাবতীর নিজের জীবনেও সেই কুকুয়া চরিত্রের এক নারীর কারনেই প্রেমিক জয় চন্দ্র তাকে ভুলে গিয়ে মুসলমান এক জনৈক নারীকে বিয়ে করে সেও ধর্মান্তরিত হয়ে চন্দ্রাবতীকে তেমনি নির্বাসন দিলেন। রামায়নে সে ঘটনা লেখার পর চন্দ্রাবতী আর বেশি কিছু লিখতে পারলেন না। বাংলাদেশের অন্য কোন কবির রচিত সেই রামায়ণে কুকুয়া নামের চরিত্র দেখা যায় না। চন্দ্রাবতী কুকুয়ার ষড়যন্ত্রের বর্ণনা রামায়ণের দ্বিতীয় খন্ডের তৃতীয় অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন। যা নিুরূপঃ

“বইস্যা আছিলেন রামচন্দ্র গো রত্ন সিংহাসনে।
উপনীত-হইল কুকুয়া গো শ্রীরামের স্থানে ॥
কালনাগিনী যেমন কইরা গো ছাড়য়ে নিশ্বাস।
দাণ্ডাইল দুষ্টা আইস্যা গো শ্রীরামের পাশ॥
নয়নে আগুনি গো ঘন শ্বাস বহে।
তর্জিয়া গর্জিয়া তবে গো শ্রীরামেরে কহে॥
‘শূন শুন দাদা, ওগো আমি কই যে তোমারে।
কইতে এই পাপের কথা গো মুখে বাক্য নাহি সরে॥
সীতা ধ্যান সীতা জ্ঞান গো তোমার সীতা চিন্তামণি।
পরাণের অধিক দেখি গো তোমার জনকনন্দিনী॥
বিশ্বাস না কর কথা গো তুমি না শুনিলা কানে।
অসতী নিলাজ সীতা গো ভজিল রাবণে॥”

কুকুয়া চরিত্র চন্দ্রাবতী কবির নতুন যোজনা, বলতে গেলে মৌলিক সৃষ্টি। দেখা যায় চন্দ্রবতীর কবি প্রাণতো ছিলই বরং সৃজনশীল মনের ও সাহায্য তিনি তার রচনায় গভীর প্রেম এবং প্রাণের আশ্রয় নিয়েছেন। তখনকার দিনে রামায়ণ নিয়ে অনেক রকমের গল্পও হয়ত প্রচলিত ছিল যা আসল রামায়নে পাওয়া যায় না। এককালে হিন্দু মহিলারা সূর্য ব্রতের দিন উদয়ান্ত থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এই রামায়ণের কাহিনীতে সুরারোপ করে গান গাইতেন। কবি চন্দ্রবতী তিনি নিজেও একজন গায়ক কবি ছিলেন। এ প্রমাণ রয়েছে তার শ্রেষ্ঠ রচনা রামায়নে উল্লেখ আছে-

“বিধিমতে প্রণাম করি সকলের পায়।
পিতার আদেশে চন্দ্রা রামায়ন গায় ॥”

অর্থাৎ চন্দ্রাবতী নিজেও ‘রামায়ন’ গান গেয়েছেন। সীতার বনবাস পর্যন্ত লেখার পর আর লেখা হয়নি জয়ানন্দের সাথে বিচ্ছেদের কারণে। চন্দ্রাবতী রামায়নে আসলে একটি পালাবদ্ধ গীত। বাল্মীকি রামায়ণের তুলনায় চন্দ্রাবতীর রামায়ণ কলেবরগত দিক থেকে অকিঞ্চিতকর। বাল্মীকি রামায়ণের মতো কাহিনীগত বৈচিত্র, জটিলতা, বিস্তৃতি এ রামায়নে পাওয়া যাবে না। বাল্মীকি রামায়নের মহাকাব্যক কলেবরগত বিশালতার কথা চিন্তা করলে দেখা যাবে এটি তিন খণ্ডে বিভক্ত। যথা- সুন্দর কাণ্ড, যুদ্ধকাণ্ড ও উত্তরকাণ্ড। এই তিনটি কাণ্ডই অসংখ্য সর্গে বিভক্ত। সুন্দরকাণ্ডে আছে ৬৮টি সর্গ, যুদ্ধকাণ্ডে আছে ১২৮টি সর্গ এবং উত্তর কাণ্ডে আছে ১১১টি সর্গ। অর্থ্যাৎ সর্বমোট তিনটি খণ্ডে মোট ৩০৭টি সর্গে বিন্যস্ত বাল্মীকি রামায়ণের বিশালতা সহজেই অনুভব করা যায়।

অপরদিকে চন্দ্রাবতীর রামায়ণ তিনটি খণ্ডে মোট ১৯টি অধ্যায়ে রচিত হয়েছে। প্রথম খণ্ড হলো জন্মলীলা, এখণ্ডে মোট ৮টি অধ্যায় রয়েছে। অধ্যায়গুলো হচ্ছে, প্রথম অধ্যায়ে লঙ্কা বর্ণনা যা নিুরূপঃ

“সাগরের পারে আছে গো , কণক ভুবন।
তাহাতে রাজত্বি করে গো, লঙ্কায় রাবণ॥
বিশ্বকর্মা নির্মাইল সেইনা রাবণের পুরী।
বিচিত্র বর্ণনা পুরীর গো, কহিতে না পারি॥
যোজন বিস্তার পুরী গো, দেখিতে সুন্দর।
বড়ো বড়ো ঘর যেমন পর্বত পাহাড়ে॥
সাগরের তীর লঙ্কা গো, করে টলমল।
হীরামণ মাণিক্যিতে পুরী করে ঝলমল॥”
দ্বিতীয় অধ্যায়ে রাবণের স্বর্গ জয়,

তৃতীয় অধ্যায়ে রাবণ কর্তৃক মর্ত্ত্য ও পাতাল বিজয়, চতুর্থ অধ্যয়ে সীতার জন্মের পূর্বে সূচনা এবং মন্দোদরী গর্ভসম্ভার ও ডিম্বপ্রসব, পঞ্চম অধ্যায়ে মাধব জালিয় ও সতা জাল্যানী, ষষ্ট অধ্যায়ে ডিম্ব নিয়ে জনক মহিষীর কাছে সতার গমন। এই অধ্যায়ে সীতার জন্মের কাহিনী বিধৃত হয়েছে এভাবে-

“শুভদিন শুভক্ষণ গো, পূর্ণিত হইল।
ডিম্ব ফুটিয়া এক কন্যা ভূমিষ্ঠ হইল ॥
সর্ব সুলক্ষণা কন্যা গো, লক্ষ্মী স্বরূপিনী।
মিথিলা নগর জুইড়্যা গো, উইঠ্ল জয়ধ্বনি ॥
জয়াদি জোকার দেয় গো, কুলবালাগণ।
দেবের মন্দিরে বাদ্য গো, বাজে ঘনে ঘন ॥
স্বর্গে মর্ত্যে জয় জয় গো, সুর-নরগণে।
হইল লক্ষ্মীর জন্ম গো মিথিলা ভবনে ॥
সতার নামেতে কন্যার নাম রাখে গো, সীতা।
চন্দ্রাবতী কহে গো, কন্যা ভুবন বন্দিতা ॥”

সপ্তম অধ্যায়ে রামের জন্মের পূর্ব সূচনা অষ্টম অধ্যায়ে রামের জন্ম, ভরত, লক্ষণ ও শত্র”গ্নুর জন্ম এবং কুকুয়ার জন্ম। এইখানেই চন্দ্রাবতী রামায়ণের প্রথম খণ্ডের সমাপ্তি ঘটেছে। জন্ম খণ্ড শেষ হয়েছে।

চন্দ্রাবতী রামায়ণের দ্বিতীয় খণ্ডের আলাদা কোনো নামকরণ করা হয় নি। এই খণ্ডে সীতার কাহিনী প্রাধান্য লাভ করেছে। এই খণ্ডে কবি জনক দুহিতা সীতার মুখে তাঁর কাহিনী বর্ণনা করিয়েছে। এই খণ্ডে শেষ দুটি অধ্যায়ে বিভক্ত – প্রথম অধ্যায়ে বনবাস পূর্ববতী জীবনের কাহিনী এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ে সীতার বনবাসের ঘটনায় পরিপূর্ণ।
চন্দ্রাবতীর রামায়ণের তৃতীয় খণ্ডটিও দ্বিতীয় খণ্ডের মতো নামকরণ বিহীন। মোট নয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম অধ্যায়ে সীতার বনবাসের পূর্ণ সূচনা, দ্বিতীয় অধ্যায়ে সীতার বিরুদ্ধে কুকুয়ার চক্রান্ত তৃতীয় অধ্যায়ে রামচন্দ্রের কাছে সীতার বিরুদ্ধে কুকুয়ার মিথ্যা অভিযোগ দায়ের।

চতুর্থ অধ্যায়ে রামচন্দ্রের সীতাকে পূর্ণবার বনবাসে পাঠানোর সিদ্ধান্ত পঞ্চম অধ্যায়ে সীতার বনবাস, ষষ্ট অধ্যায়ে সীতাকে বাল্মীকি মুনির আশ্রয় দান ও লব-কুশের জন্ম, সমপ্তম অধ্যায়ে সীতার সঙ্গে হনুমানের সাক্ষ্য, অষ্টম অধ্যায়ে রামচন্দের সঙ্গে হনুমানের সাক্ষ্য , নবম অধ্যায়ে চন্দ্রাবতী রামায়ণ শেষ। এ অধ্যায়ে সীতার

অগ্নীপরীক্ষা ও পাতালে প্রবেশের বর্ণনা রয়েছে-
“দুই হস্ত জুড়ি সীতা গো, অগ্নি প্রণাম করিল।
ধীরে ধীরে অগ্নিকুন্ডে গো, সীতা প্রবেশিল ॥
সেইক্ষণে হইল কিবা গো, দৈবে অঘটন।
বসুমতী উঠিল কাঁইপ্যা গো, কাঁপিল অযোধ্যা ভুবন ॥
চিতা ফাইট্যা উঠিল গো, পাতাল গঙ্গা ভোগবতী।
তার সঙ্গে উইঠ্যা আইল গো মাতা বসুমতী ॥
বসুমতী কয়, ‘মাগো আইস আমার কোলে।
দুঃখিনী কন্যারে লয়্যা গো আমি যাইব পাতালে ॥
সুখে থাউক রাজা রাম গো রাইজ্য প্রজা লয়্যা।
আমার কন্যা সীতারে আমি গো লয়্যা যাই চলিয়া ॥
এই না কথা বইলা দেবী গো সীতারে লইল কোলে।
পাতালে প্রবেশিল সীতা গো দেখিল সগলে ॥”

এই সময়ে রামায়ণ, মলুয়া ও দস্যু কেনারাম পালা ছাড়াও তিনি অসংখ্য কবিতা, গান, পালাকাব্য, মনসা ভাসানের কিছু অংশ পদ্মপুরান, অসংখ্য বিয়ের গীত ও লোক সঙ্গীত রচনা রয়েছে। তাঁর অনেক কবিতা ও গান সংগ্রহের অভাবে অতীতের গর্ভে হারিয়ে গেছে। চন্দ্রাবতীর পালায় কিশোরগঞ্জের সমাজ চিত্রের তৎকালীন রূপ ও রস অপূর্বভাবে প্রকাশিত হয়েছে। যেমন, দস্যু কেনারাম পালায় উল্লেখ্য আছে, যেমনঃ

“বাতানে মহিষ আর পালে যত গাই।
কত যে চরিত তার লেখাজুখা নাই ॥”

চন্দ্রাবতী বিরচিত মলুয়া পালায় সে সময়ের কিশোরগঞ্জের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিচয়ও পাওয়া যায় এভাবে-

“পাঁচ পুত্র হয় তার অতি ভগ্যবান।
সরু সশ্যে ভরা টাইল গোলা ভরা ধান ॥
ঘরে আছে দুধবিয়ানী দশ গোটা গাই।
হালের বলদ আছে তার কোন দুঃখ নাই ॥
বাইশ আড়া জমীন তার সাইল আর আমন।
ধনে পুত্রে বর তারে দিছে দেবগণ ॥”

কবি চন্দ্রাবতী বাল্মীকি কিংবা কৃত্তিবাসের পথ পরিত্যাগ করে রাম কাহিনীকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিশ্লেষণ করলেন । চন্দ্রাবতীর এই রামায়ণ কাহিনিতে রাম নয় সীতাই হয়ে উঠলেন নায়িকা। সীতার জন্ম কাহিনি দিয়ে শুরু করে, তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলিকে স্থান দিয়ে, তাঁর মানসিকতাকে সুনিপুণ ভাবে ব্যাখ্যা করে তাঁরই পাতাল প্রবেশ দিয়ে এ রামায়ণের ছেদ টেনেছেন কবি। রামায়ণের এই নবতর রূপ কল্পনা করতে গিয়ে নিজস্ব শিক্ষা এবং রুচি অনুসারে কবি চন্দ্রাবতী রামায়ণের চিরাচরিত বহু বিষয়কে যেমন বিমুক্ত করেছেন, তেমনই নতুন বহু বিষয়কে সংযুক্ত করেছেন, নবনির্মিত বস্তু হিসেবে যার মূল্য অপরিসীম। প্রথমেই প্রশ্ন জাগে সপ্তদশ শতাব্দীর সেই পুরুষতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার বৃত্তে বসে চন্দ্রাবতী কেন সীতাকে উপজীব্য করে রামায়ণ রচনা করলেন? কেনই বা তিনি রাম চরিত্রের একনায়ত্বকে নস্যাৎ করলেন? আসলে চন্দ্রাবতীর এই বিপরীত ধর্মী ভাবনার মূলে কাজ করেছে তাঁর নিজস্ব জীবন অভিজ্ঞতা।

চন্দ্রাবতী অন্বেষণ করেছিলেন এমন এক চরিত্র যে চরিত্রের পাথেয় হয়ে উঠবে সীমাহীন দুঃখ। সেক্ষেত্রে এই রকম নিরবচ্ছিন্ন দুঃখ ভারাক্রান্ত চরিত্রের অভিধা একমাত্র সীতাই পেতে পারে। আর আবাল্যের দোসর তথা প্রেমিক জয়ানন্দ পরিত্যক্তা চন্দ্রাবতীও ছিলেন সীতারই মতন দুঃখভাগিনী। তাই দুঃখিনী চন্দ্রাবতী রাম পরিত্যক্তা জনমদুখিনী সীতার সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে তুলেছিলেন। নিজের জীবন অভিজ্ঞতা তথা জীবনাদর্শকে জারিত করে রামায়ণের গতানুগতিক ধারার মধ্যেই সংযুক্ত করলেন তাঁর ব্যতিক্রমী রচনা- রামায়ণের মোড়কে সীতায়ন।

আধুনিক সাহিত্যের স্রোতে সেই মৈয়মনসিংহ গীতিকার কথা বিস্মৃতির অতল গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এই কিশোরগঞ্জে আজো আষাঢ়-শ্রাবণের মেঘ ভরা আকাশ তলে ভরা নদীর বাকে সাজের নৌকা সারি দিয়া বয়ে যাওয়ার সময় মাঝির কণ্ঠে শুনা যায় চন্দ্রাবতীর বিয়ের গীত কিংবা কোন লোকসঙ্গীত। বিবাহে ফুল কামিনীগণ নব বর বধুকে যখন øান করাতে ঘাটে জল ভরনে যায় তখন মহিলাদের কণ্ঠে শুনা যায় চন্দ্রাবতীর গান। পাশাখেলার সময় বা অন্যান্য ব্রতের সময় শুনা যায় চন্দ্রাবতীর গীত। কত রকমের বিচিত্র সংগীত। মলুয়ার স্মৃতি বিজড়িত আরালিয়া গ্রাম, কাজীদের বাড়ী, জাহাঙ্গীরপুর, ধনুনদী, সুত্যানদী, বিস্তর পদ্মফুলে ভরা ধলাই বিল আজও আমাদেরকে সেই কিশোরগঞ্জের কবি কন্যা চন্দ্রাবতীর সেই স্মৃতি মন্দির আজো স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে আগ্রহী কবি-সাহিত্যিক, গবেষক ও পর্যটকদের আকর্ষণ করে আমন্ত্রণ জানায়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মহিলা কবি খনা, রামী ধোবানী, মাধবী দাসী, আনন্দময়ী, গঙ্গামনি দেবী, রহিমুন্নেছা এরা সকলেই প্রাচীন মধ্যযুগের আদি কবি ছিলেন, তবে এদের মধ্যে কিশোরগঞ্জের কবি কন্যা চন্দ্রাবতী নিঃসন্দেহে শীর্ষ স্থানীয়া। অর্থাৎ চন্দ্রাবতী ছিলেন বাংলা সাহিত্যের পূর্নাঙ্গ শ্রেষ্ঠ মহিলা কবি।

লিখেছেনঃ ফয়সাল শাহ
উপ পরিচালক – মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়