ভাটি অঞ্চল-যেখানে ছয় মাস পানি আর বাকি ছয় মাস শুকনো মৌসুম। বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-এই সাতটি জেলার ৪০টি উপজেলা জুড়ে ভাটি অঞ্চল বিস্তৃত। পুরো অঞ্চলে সুতোর মতো জড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য হাওর-খাল-বিল-নদী-নালা। প্রকৃতি যেন তার অপার সৌন্দর্যে এ অঞ্চলকে অপরূপ করে সাজিয়ে রেখেছে। প্রকৃতির মতোই উদার ও প্রাণবন্ত এখানকার বাসিন্দারাও। ভৌগলিক বৈচিত্র্যের কারণেই বোধহয় হাওরবেষ্টিত জনপদের জীবনাচরণ ও সংস্কৃতি অত্যন্ত বিচিত্র, বর্ণিল, সমৃদ্ধ ও প্রাণবান।

ভাটি অঞ্চলের আশি ভাগ মানুষের পেশা কৃষিকাজ কিংবা মৎস্যশিকার। সঙ্গত কারণেই দিনে হাড়ভাঙা পরিশ্রম এঁদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। কিন্তু সেই পরিশ্রমী মানুষদের কাছে দিনের সূর্য ডোবার মুহূর্তটুকু যেন নতুন আমেজে হাজির হয়। দিনমান কাজ শেষে বাড়ি ফিরে সেই মানুষেরা অনাবিল আনন্দে মেতে ওঠেন। গ্রামে গ্রামে বসে বিচিত্র সব গানের আসর, উৎসবের রং ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। একই অঞ্চল হওয়ার সুবাদে এখানকার প্রায় আড়াই কোটি মানুষের গানের ভুবনও প্রায় অভিন্ন। যেহেতু আমি ভাটি অঞ্চলের মানুষ, তাই এখানকার আচার-অনুষ্ঠানের অনেক কিছুই আমার নখদর্পণে।

ছোটোবেলা থেকেই নানা উৎসব-পার্বণ উপলক্ষ করে মেতে ওঠা হাওরবাসীর নির্মোহ আনন্দ-উচ্ছ্বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বড় হয়েছি। তাই আমি ভালো করেই জানি-বর্ষায় হাওরের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে বুক চিতিয়ে চলা ভাটির মানুষের কণ্ঠে গান অনেকটা আপনা-আপনিই ধ্বনিত হয়। শুকনো মৌসুমে দিগন্তবিস্তৃত সবুজ ধানখেতে ভোরের আলোয় স্নাত কৃষক মনের আনন্দে আপন খেয়ালে সুর ভাঁজেন। পুরো অঞ্চল জুড়ে যাত্রাগান, পালাগান, বাউলগান, কীর্তন, গাজীরগান, ভাটিয়ালি, ধামাইলগান, মালসিগান, বারোমাসি, সূর্যব্রতের গানসহ কত ধরনের গানের প্রচলন রয়েছে।

হাওরের বিচিত্র সব গানের ধারার পাশাপাশি গ্রামীণ চিরায়ত সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ নৌকাবাইচ, কুস্তি-খেইড়কেন্দ্রিকও অসংখ্য গান রচিত হয়েছে। এছাড়া মহররম উৎসব, দোলউৎসব, শ্যামাপূজাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসবে এখনও মূল আকর্ষণ গান। এসব উৎসবে শেষপর্যন্ত গানই প্রধান হয়ে ওঠে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীতে কৃষি উৎপাদনের সময় নানামুখী লোকাচারেও গানের ব্যবহার রয়েছে। হালচাষ, বীজ রোপন, ফসল কাটা থেকে ঘরে তোলা পর্যন্ত নানা রকমের উৎসবের আয়োজন করা হয়, এতে আনুষঙ্গিক লোকাচার হিসেবে গান ও মন্ত্র পরিবেশিত হয়। অবশ্য গ্রামীণ লোকাচারের এ ধারাগুলো এখনও নির্দিষ্ট দিন-ক্ষণ মেনে কৃষকেরা পালন করে থাকেন।

বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে আমাদের না-দেখা অতীতের গল্প শুনি। কেমন করে একেকটা গান জন্ম নেয় সে গল্পও শুনি। ভাটির মানুষের জীবন বড় অদ্ভূত। বৈশাখের শেষ সময়ে কিংবা জ্যৈষ্ঠ মাসের শুরুতে পানি এসে ডুবিয়ে দেয় পুরো ভাটি অঞ্চল। আষাঢ় ও শ্রাবণের অবিশ্রান্ত বর্ষণে মাঠ-ঘাট ভেসে যায়। বাড়ির উঠোনজুড়ে জল থিকথিকে কাদায় ভরে ওঠে। কিছুদিনের মধ্যে সেই বর্ষণ থেমে গেলে মানুষ মেতে ওঠে নানান আনন্দ-আয়োজনে। জাতপাত, বৈষম্য আর ভেদাভেদ ভুলে সেই আনন্দযজ্ঞে গা ভাসান ভাটির সকল মানুষ।

হেমন্তে যে-বছর ফসল ভালো জন্মায়, সে বছর খুব ঘটা করে উৎসব হয়। বাড়িতে বাড়িতে চলে বিয়ের আয়োজন। সে আয়োজনে নেচে-গেয়ে নারীরা মুখরিত করে তোলে পুরো গ্রাম। ধামাইলগানের সুরের ঢেউ হাওরের লিলুয়া বাতাসে যেন আচড়ে পড়ে। প্রখ্যাত লোকগীতিকার রাধারমণ, প্রতাপরঞ্জন তালুকদারদের লেখা কত কত ধামাইলগান ফেরি করে বেড়ান গ্রামীণ নারীরা। এক গ্রামের ডাকসাইটে শিল্পীর ডাক পড়ে আরেক গ্রামে। গানের প্রতি নিখাদ ভালোবাসার এ বড় অদ্ভূত সম্মিলন।

মনে পড়ে সেই দিনের কথা। প্রায় বছর দশেক আগের কাহিনি। বন্ধুর আমন্ত্রণে তাঁর বোনের বিয়েতে নেত্রকোনা জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়েছিলাম। বন্ধুটির কাকার বাসায় আমার ঘুমোনোর ব্যবস্থা হয়েছিল। বিয়ের আগের মধ্যরাত, মানে অধিবাসের সময়। ভাটি এলাকায় সেদিন রাতভর ধামাইলগান পরিবেশনার রীতির প্রচলন রয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়েতে ধামাইলগান নারীদের জন্য এক আনন্দের অনুষঙ্গ হিসেবে হাজির হয়। মধ্যরাতে গান শুরু হওয়ার আগে আমি বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম করছিলাম। হঠাৎ ওপাশের কক্ষে চাপা কণ্ঠে ঝগড়ার আওয়াজ শুনি।

বন্ধুটির কাকা কী কারণে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে বাক-বিতণ্ডা করছেন। ঠিক কিছুক্ষণ পর ধামাইলগান শুরু করার জন্য ঝগড়ারত ওই স্ত্রীলোকটির কাছে তাগদা আসে। ‘আসছি’ বলে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তিনি প্রস্তুতি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। আমিও ধামাইলগান দেখার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয়ে অনুষ্ঠানস্থলে যাই। প্রায় আধাঘণ্টা পর গান শুরু হয়। ১৫/২০ জন নারী গোল হয়ে নেচে নেচে হাততালি দিয়ে ধামাইল পরিবেশনায় মেতে উঠেছে। হঠাৎ বন্ধুটির কাকীর কণ্ঠ শুনে চমকে উঠি। এত সুরেলা কণ্ঠ, মন জুড়িয়ে যায়। একটু আগে স্বামীর দুর্ব্যবহার ভুলে তিনি মজে গেছেন গানে। তাঁর চেহারা দেখে বেশ অনুমান করতে পারি-একটু আগের সেই ঘটনাটি তিনি বেমালুম ভুলে গেছেন। এখন গানের মধ্যে নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দিয়েছেন।

এই মগ্নতার নেপথ্যে যে ভাটির লোকগানের সুরের জাদু এটা আমি ঐদিনই উপলব্ধি করি। ভোররাতে গান শেষে কাকীর সঙ্গে আলাপ করি। বলি, ‘এই গান শিখলেন কার কাছে?’ তিনি একটু হাসলেন। আমাকে চমকে দিয়ে বললেন, ‘গান আবার কারো কাছ থেকে শিখতে হয় নাকি?’ মানে? আমার বিস্ময়ের রেশ তখনও কাটেনি। এর আগেই আসে উত্তর-‘আমার মা গাইতেন, ঠাকুমা গাইতেন, আমি তাঁদেরকে অনুসরণ করেই গাই। আমার মা শিখেছেন দিদিমার কাছ থেকে। দিদিমা শিখেছেন তাঁর মায়ের কাছ থেকে। গ্রামীণ নারীরা এভাবেই গান শেখে।’ এই হলো গান শেখার রহস্য। গ্রামীণ নিরক্ষর মহিলারা একেকটা গান শিখে আর সেগুলো ভুল বানানে খাতায় লিপিবদ্ধ করে রাখে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।

যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখা এসব গানের খাতা ওই নারীরা কোনোভাবেই হাতছাড়া করে না। কারণ এ যে তাঁদের পরম সম্পদ। শুধু কি ধামাইলগান? একই রকম কথা বলা যায় সূর্যব্রত সংগীত, ভজন, বারোমাসি থেকে শুরু করে বিভিন্ন মেয়েলিগান ও গ্রাম্যগীতের বিষয়েও। নারীর বুকের ভেতরে যে অন্তহীন বেদনা ও দুঃখ, সেসবই যেন গানের পঙ্ক্তিতে-পঙ্ক্তিতে বিধৃত হয়েছে। ভাটির নারীরা হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত করে রেখেছেন সেসব গান। তাই হয়তো তাঁদের বুকের ভেতর থেকেই উৎসারিত হয় একেকটা গান।

নারীদের মতো পুরুষেরাও ভাটিতে মেতে ওঠে যাত্রাগান, পালাগান, ঘাটুগান, কীর্তন, গোষ্ঠগান, কবিগান, টিক-লরানির গান, ত্রিনাথের গান আর বাউলাগান নিয়ে। তাঁদের শিল্পীসত্তাও প্রকৃতিপ্রদত্ত। যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় তাঁরা গানের ধারা বহমান রেখেছেন। দিনে যে মাঝি খেয়ানৌকা চালায়, যে জেলে মাছ ধরে কিংবা যে কৃষক মাঠে ফসল ফলায়-রাতে তাঁরাই ডাকসাইটে কীর্তনীয়া, যাত্রাভিনয়শিল্পী অথবা দক্ষ পালাকার। এঁদের কারো কারো লোকবাদ্যের লহরিতে মুখরিত হয় ভাটির পরিপার্শ্ব, বিমুগ্ধ হয় মানুষ; কারো বা মনোমুগ্ধকর কণ্ঠের জাদুতে আচ্ছন্ন হয় ভাটিবাসী।

বড় বিচিত্র এ অঞ্চল, গান এখানে আপন গতিতে ধাবমান। যে নিরক্ষর মানুষটি লেখাপড়া না জানায় টিপসই দিয়ে মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিয়ে সর্বস্ব খোয়ায়, সেই ব্যক্তিটিই কিনা কেবল চোখের আন্দাজে পুঁথির ছাপা অক্ষরে আঙুল বুলিয়ে পড়ে ফেলতে পারে ৪৮০ পৃষ্ঠার সুবৃহৎ বাইশকবি শ্রীশ্রী পদ্মপুরাণ। প্রতি শ্রাবণে মনসা দেবীকে উপলক্ষ করে প্রতি ঘরে ঘরে পঠিত হয় পদ্মপুরাণ। এ সময়টাতে আকাশে-বাতাসে ভাসে নারী-পুরুষের সম্মিলিত সুর। ঘরে ঘরে কুপিবাতি জ্বালিয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে পদ্মপুরাণ পুঁথিপাঠ।

এ এক আশ্চর্য জায়গা। এখানে বড় বিচিত্র সব প্রতিভা। মাত্র আটদিন নৈশ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা প্রয়াত শাহ আবদুল করিম এখন বাউলগানের কিংবদন্তিতুল্য মহাজন, যিনি কিনা শৈশবে ছিলেন একজন রাখাল বালক। তিনিও এই ভাটিরই মানুষ। কুষ্টিয়ার লালনের পরে এখন সর্বাধিক উচ্চারিত নামটি তাঁরই। আবার হাসন রাজার মতো এমনও ভাবুক রয়েছেন, যিনি গানের নেশায় চারিত্র্য খর্ব করে কুড়েঘরে থাকাটাই শ্রেয় মনে করেছেন। ভাটির কত কত বাউল-ফকির দীন ভবানন্দ, দীনহীন, সৈয়দ শাহনুর, রাধারমণ, কালা শাহ, রশিদ উদ্দিন, উকিল মুন্সী, জালাল উদ্দীন খাঁ, কামাল উদ্দিন, দুর্বিন শাহ যাঁরা মানুষ-বন্দনা করে গেছেন আমৃত্যু। এ তো গেল ভাটি অঞ্চলের লোক ও বাউলগানের একটি ক্ষুদ্রতম অংশ। এর বাইরে কতশত প্রখ্যাত পরিচিত ও অপরিচিত শিল্পী-সাধক লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেছেন, তার কোনো হিসেব নেই।

ভাটি অঞ্চলের ডাকসাইটে এক বাউলগায়ক রণেশ ঠাকুর। তিনি প্রয়াত বাউলসাধক শাহ আবদুল করিমের অন্যতম শিষ্য। দীর্ঘদিন ধরে হাওরবাসীর গানের ক্ষুধা মিটিয়ে আসছেন। সম্প্রতি এক আলাপচারিতায় তিনি আমাকে একটা চমকপ্রদ তথ্য জানান। তিনি বলেছিলেন, ‘গত দুই বছর ধরে আমি কলকাতার যাদবপুরে বাউল-ফকির উৎসবে যাচ্ছি। সেখানে এত খোলামেলা গানের পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই। মদ্যপান থেকে শুরু করে চলাফেরা পর্যন্ত এতই স্বাধীনভাবে বাউল-ফকিররা করতে পারছেন, যেটা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে একেবারেই অসম্ভব।

এছাড়া অতিসম্প্রতি দেখছি অনেক বাউলনামধারীরা বাংলাদেশে বাউলগানের আসরে কি-বোর্ড ও অক্টোপ্যাড ব্যবহার করছে। এটি আরও উদ্বেগের বিষয়। অথচ বাউলগানে একতারা ও দোতরার কোনো বিকল্প নেই।’ একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন হবিগঞ্জ জেলার আজমিরিগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামের বাউল এবং শাহ আবদুল করিমের আরেক জ্যেষ্ঠ শিষ্য আবদুর রহমানও।

বাউলদ্বয়ের অভিজ্ঞতার সূত্রে আমরা ধরেই নিতে পারি যে, বাংলাদেশে ধীরে ধীরে বাউলগানের পরিসর ও ক্ষেত্রগুলো ক্ষীণ হয়ে আসছে। বাউলগান ছাড়া অপরাপর গানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ঘাটুগান হারিয়েছে সেই কবে, এমন কী উরিগান (হোরি), গাজীর গান, বটকিরাগান, টপ্পা আর মালজোড়াগানও তেমন চোখে পড়ে না। দুই-একটি গ্রাম বাদে অন্য কোথাও এসব গানের আর চর্চা হতে দেখা যায় না। যেসব গানের ধারা শুকিয়ে যাচ্ছে, তাতে জল ঢালার কাজটা করবে কারা? ভাটি অঞ্চলে সেই নিষ্ঠাবান শিল্পীরা উঠে আসছে কই? হেমাঙ্গ বিশ্বাস, নির্মলেন্দু চৌধুরী, প্রাণেশ দাস, রণেন রায়চৌধুরী, দিনেন্দ্র চৌধুরীদের মতো সুরকার, গীতিকার ও শিল্পীদের উত্তরসূরিদের এত অভাব কেন? অথচ বাংলা গানের অসংখ্য বিচিত্র ধারার উৎপত্তি ও বিকাশ বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলেই তো।

আগের সেই দিন আর নাই। আমাদের শৈশবের দেখা সেইসব গায়ক ও গীতিকার এখন তেমন চোখে পড়ে না। সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে যাচ্ছে ঔৎসুক্য শ্রোতা-দর্শকেরাও। বড় বেশি আফসোস হয় ধীরে ধীরে যেন হারিয়ে যাচ্ছে গানের সমৃদ্ধ ধারাগুলো। অতীতের সেই সুর কিংবা গান অতি দ্রুতই যেন সবকিছু পালটে যাচ্ছে। আমাদের শৈশবে দেখেছি বাড়ির উঠোনে বসতো কত বিচিত্র ধরনের গানের আসর। এখন আর তেমনভাবে সেসব চোখে পড়ে না। যেসব গ্রামে এখনও গানের আসর বসে, সেসবও কেমন যেন ধীরে ধীরে ধুসর থেকে ধুসরতর হয়ে পড়ছে। অতীতে হাওরাঞ্চলের গানের পরিবেশ সম্পর্কে প্রয়াত বাউলসাধক শাহ আবদুল করিমের কিছু ব্যক্তিগত উপলব্ধি এখনও আমার কানে বাজে। বড়ই কষ্ট ও বেদনাদায়ক এ উপলব্ধি।

বর্তমানের গানের পরিবেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘পরিবেশটা বিপথে গেছেগা আমার মতে। এখন ব্যবসার আলতে গেছিগি। গান লাগলে এক পার্টি জুয়া খেইড় লাগাই দেয়, পারমিশন লাগে, টিকেট লাগে, মাইরকাইজা হয়, শান্তি শৃংখলার অভাব। আগে সারা রাত্র ঠাণ্ডার মধ্যে হাওরের মধ্যে গান শুনছে। সেই দিন আর নাই, সেই গানের পরিবেশও আর নাই। তাই সবাইরে কই এ পথে না আসাটাই ভালা।’

একজন শিল্পী হিসেবে শাহ আবদুল করিমের এ উপলব্ধি বড়ই করুণ ও কষ্টের। যে ব্যক্তিটি জীবনভর গানের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করে গেছেন, সেই ব্যক্তিই কিনা ভবিষ্যৎ প্রজš§কে উদ্দেশ্য করে বলছেন, গানের জগতে না-আসা ভালো। কিন্তু কেন? সেটাও করিমের কথাতে কিছু কিছু আভাস পাওয়া যায়। ওই যে ‘পারমিশন’, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া বাংলাদেশের কোথাও কোনো যাত্রাগান, পালাগান কিংবা বাউলগানের আসর বসতে দেওয়া হয় না। যেকোনো ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত কীর্তন ও ঢপযাত্রা (ধর্মীয় পুরাণ নির্ভর আখ্যান) পরিবেশনার জন্যও স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতির প্রয়োজন।

গ্রামীণ মানুষদের কাছে এসব অনুমতির ব্যাপারটা বিশাল ঝামেলার কাজ। তাছাড়া অনুমতি চাইলেই যে সেটা পাওয়াও যাবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। ফলে ধীরে ধীরে গানের আসরের আয়োজন হ্রাস পেয়েছে। তাছাড়া গানের আসরকে কেন্দ্র করে একশ্রেণির মুনাফালোভীরা নগ্নতা ও জুয়াখেলার প্রচলন করায় গানের আয়োজনের ভাবগাম্ভীর্যে ছেদ পড়ছে, ফলে দর্শক-শ্রোতারা বিচ্যুত হয়ে গানের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছে। এর বাইরে গ্রাম্য-রাজনীতিও গানের আয়োজক ও শিল্পীদের অনুকূলে কখনোই ছিল না।

বাংলাদেশে হিন্দু অধ্যুষিত বসতিগুলোর মধ্যে ভাটি অঞ্চল অন্যতম। সঙ্গত কারণেই দেশের অপরাপর এলাকার চেয়ে ভাটি এলাকায় গানের একটা সমৃদ্ধ পরিবেশ ছিল। কিন্তু দেশভাগের পর থেকে ক্রমশ মুসলিম মৌলবাদীদের উত্থান লাভের কারণে গানের পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়ে। আশির দশকের পর থেকে একই মহল অনেকটা প্রকাশ্যে গান-বাজনার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এসব কট্টর মৌলবাদীগোষ্ঠী গানের আয়োজক ও শিল্পীদের ‘কাফের’ আখ্যা দিয়ে অব্যাহতভাবে বাধা-বিপত্তি দিতে শুরু করে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন কিংবা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সেসব মোকাবেলায় কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এতে করে শিল্পীরা ক্রমশ হতাশ হয়ে গানের জগত থেকেই সট্কে পড়ছে।

আজ থেকে বিশ-পঁচিশ বছর আগে আমাদের ছোটোবেলায়ও দেখেছি, গ্রামে গ্রামে বাউলগান, ঢপযাত্রা, কীর্তন, গাজীর গান, উরিগান থেকে শুরু করে বিচিত্র ধরনের গানের আসরের আয়োজন হত। বৃহৎ পরিসরে আয়োজিত কোনো উপলক্ষ ছাড়া এসব গানের আসর এখন আর চোখেই পড়ে না। আমাদের দেখা মাত্র আড়াই দশকের ব্যবধানে কত পরিবর্তন চোখে পড়ছে। এখন ভাবি, বাবা-কাকা-দাদুদের মুখে শুনা তাঁদের সময়কার গ্রামীণ গানের আয়োজনের কথা। কিছুদিন আগে বাহাত্তর পেরোনো আমার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তাঁদের দেখা গানের পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে। তিনি যে তথ্য জানালেন, তা শুনে চমকে উঠি, নিজের কাছে তাঁর গল্পগুলো অবিশ্বাস্য ঠেকে!

আমার বাবা বারীন্দ্রকুমার দাশ বলেছিলেন, ‘আমাদের ছোটোবেলায় মৌসুম অনুযায়ী নানা ধরনের গান হত। যাত্রা, পালা, কীর্তন, গাজীর গান, ঘাটুগান, ধামাইলগান, বৈঠকিগান, উরিগান, মালসীগান, বাউলগান, বাউলাগান তো ছিলই। এমনকী আমরা এও দেখেছি-মা-দিদিদের নাইওর যাওয়ার আগে-পরে এবং বাবা-কাকাদের পাখি শিকারে যাওয়া উপলক্ষে গান পরিবেশিত হত। বৃষ্টির অভাবে যখন একমাত্র বোরো ধান খেত ফেটে চৌচির, তখন বৃষ্টি-দেবতার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বেঙাই-বেঙির বিয়ে দেওয়া হতো, সেই সঙ্গে এদের বিয়ে উপলক্ষে গানও গাওয়া হতো।

ছিল বাঘাই শিন্নির গান। এখন আর এসব হয় না। অনেকে পুরোনো সেসব গানের ধারা সম্পর্কে জানেনও না। আমাদের এলাকা যেহেতু কৃষিপ্রধান, এখানে একমাত্র বেরো ধান ফলে। ধানের বীজ রোপন, চারা রোপনসহ বিভিন্ন উপলক্ষে কৃষিভিত্তিক গান পরিবেশিত হত।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আগের দিনের মানুষদের কাছে কঠিন রোগ হিসেবে স্বীকৃত যক্ষাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীদের রোগ সারাতে কিছু কিছু স্থানে গানের আয়োজন হতো। ভূত তাড়াতে ওঝা-বৈদ্যরা ঝাঁরফুঁকের পাশাপাশি গানও গাইত। বেদেনীরা সাপের খেলা দেখানোর সময় গান গাইত। আসলে গ্রামীণ সংস্কৃতি মানেই তো গানের সংস্কৃতি। কত কত গান ছিল, গানের ধারা ছিল, সেসব কিছুই মনে নেই। সব ঐতিহ্যগুলো আজ হারিয়ে যাচ্ছে।’

বাবার কথার সূত্র ধরে মনে পড়ে পণ্ডিত রামকানাই দাশের কথা। যিনি ভাটি অঞ্চলের বাউলগান ও বাউলাগান সম্পর্কে তাঁর আত্মজীবনী সঙ্গীত ও আমার জীবন (ঢাকা, ২০১১ : পৃ. ১২৯) বইয়ে লিখেছিলেন, ‘বাউলাগান হলো দলগত গান। প্রায় গ্রামেই বাউলাগানের দল থাকত।

গানের বিষয়বস্তুতে হিন্দু ধর্মীয় প্রভাব থাকলেও ভাবগত দিক দিয়ে ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি সর্বজনীন। প্রতিযোগিতামূলক বাউলা অনুষ্ঠানে এক গ্রামের দল অন্য গ্রামকে পান পাঠিয়ে আমন্ত্রণ জানাত। তারিখ মতে নিমন্ত্রিত দল চলে যেত সে গ্রামে। ভালো খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা থাকতো সেখানে। সারাদিন গান চলত প্রতিযোগিতামূলক ভাবে। শ্রোতারা গানের ভালোমন্দ বিচার করে শ্রেষ্ঠত্বের রায় দিত। অনুরূপভাবে, এবারের আমন্ত্রিত দল অপর দলকে ফিরতি পান-নিমন্ত্রণ দিয়ে তাঁদের গ্রামে নিয়ে যেত। বাউলাগানের দলকে বলা হত বাউলার দফা।’

রামকানাই দাশ একইভাবে বাউলগান সম্পর্কে একই বইয়ের পরের স্তবকে লিখেছেন, ‘অনেকে বাউলা ও বাউলগানকে একই জিনিস মনে করে থাকেন। বাউল সংগীত হচ্ছে একক পরিবেশনায় গান যা সচরাচর একতারা বা দোতারা বাজিয়ে গাওয়া হতো। পরবর্তীকালে অনেক বিশিষ্ট বাউল বেহালা বাজিয়েও বাউল গান গাইতে থাকে। বাউল গানের চর্চা গ্রামে-গঞ্জেই বেশি ছিল। বাউলগানের লোকপ্রিয়তা সর্বাধিক। অধুনা খানিক রূপান্তরিত হয়ে, গায়কি স্টাইলের কম-বেশি সমন্বয়ে জনপ্রিয় ব্যন্ডদলের মাধ্যমে নাগরিক সমাজেও এ গান বেশ লক্ষণীয় স্থান করে নিয়েছে।’

রামকানাই দাশের জীবদ্দশাতেই তাঁর দেখা অতীতের বাউলা ও বাউলগানের পরিবেশ-পরিস্থিতি অনেকটাই পালটে গেছে। যেটি তাঁর শেষ পঙ্ক্তিতেই টের পাওয়া যায়, একই কথা আমরা শুনেছিলাম বাউল রণেশ ঠাকুরের জবানিতেও। আসলে বাংলাদেশে বাউলগানে ব্যন্ড সংগীতের এত আগ্রাসী প্রভাব ঘটেছে যেখানে থেকে বের হওয়া প্রায় মুশকিল বটে। তবে একটা বিষয় লক্ষণীয়, বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, রাজশাহী, যশোর কিংবা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম, নদিয়া, কেন্দুলিসহ বিবিধ অঞ্চলে বাউলগান বলতে যেটি বোঝায়, সেটি ঠিক বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা কিংবা কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে তা বোঝায় না।

শোষোক্ত অঞ্চলগুলোতে বাউলগানের চর্চা যাঁরা করে, তাঁরা প্রায় সবাই গৃহী। এঁরা মুর্শিদ ভজনার মধ্য দিয়ে বাউলসাধনায় প্রবেশ করে। অপরাপর অঞ্চলের বাউলদের মতো এঁরা গুরু ধরে ‘ভেক’/‘খিলাফত’ গ্রহণ করে না, কিংবা ‘জ্যান্ত দেহে মৃতের ভূষণ’ অর্থাৎ, সাদা কাপড় পরিধান করে না। এঁরা যেকোনো রংয়ের পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিধান করে। তবে তাঁরা অনান্য অঞ্চলের বাউলদের মতো নিয়মানুযায়ী ‘বস্তুনিয়ন্ত্রণ’ তত্ত্বটি মানলেও এঁদের অনেকেই ব্যক্তিগত জীবনে এটির বাস্তব প্রয়োগ ঘটায় না। তারপরও এঁদের বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠী বাউল অভিধায় পরিচিত লাভ করেছে। তবে এ অঞ্চলেও কিছু কিছু বাউল-ফকিরদের দেখা মিলে, যাঁরা বিয়ে পর্যন্ত করেনি। মুষ্টিমেয় এ অংশটি কুষ্টিয়া কিংবা নদিয়ার বাউলদের মতো জীবনযাপন করে চলেছে।

ভাটি অঞ্চলের বাউল-ফকিরদের অনেকেই গান রচনাও করেছেন। সেসব গানের মধ্যে মারফতি, বিচ্ছেদী, গুরুতত্ত্ব, কামতত্ত্ব, পারঘাটাতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, নবিতত্ত্ব, রাসুলতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব থেকে শুরু করে ভাটিয়ালি, আঞ্চলিক ও গণসংগীত পর্যায়ভুক্ত গানও রয়েছে। এঁদের মধ্যে এমন অনেক নমস্য বাউল-ফকিরেরা রয়েছেন-যাঁরা বাউলতত্ত্বের গান রচনা শুরু করে বাউল জগতে প্রবেশ করেছিলেন, পরবর্তীতে এঁরাই গণসংগীত গান লিখে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছেন। আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার পট পরিবর্তনের সঙ্গে তালমিলিয়ে এসব বাউলেরা গণসংগীত রচনার দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। যেটা বাউল ইতিহাসের ক্ষেত্রে বিরল ঘটনাই বলা চলে।

বাউলদের রচিত নানা পর্যায়ভুক্ত এসব গান কেবল যে রচয়িতা কিংবা বাউল-শিল্পীরাই গেয়েছে, তা কিন্তু নয়। বরং তা সানন্দে গ্রহণ করেছে গ্রামের অসংখ্য লোকগান নির্ভর শিল্পীরা। এসব গান পরিবেশন করে এই শিল্পীরাও পেয়েছে অনন্য সম্মান। তবলা-বাদক হিসেবে ভাটি এলাকার প্রত্যন্ত জনপদ শাল্লা উপজেলার পুটকা গ্রামের রামকানাই দাশ পেশাজীবন শুরু করেছিলেন, তিনি আজ বাংলাদেশে লোকগানে এক নমস্য ব্যক্তি। তাঁর বাবা রসিকলাল দাশও ছিলেন একজন প্রখ্যাত গীতিকার। সে সুবাদেই হয়তো রামকানাই দাশের রক্তে ঢুকে গিয়েছিল লোকগান।

তাই সেই যুবক বয়স থেকে তিনি হারিয়ে যাওয়া লোকগানগুলো সংগ্রহ করে নিরন্তর গেয়ে চলেছেন। প্রায় নব্বই বছর বয়সী সুষমা দাশ ও চন্দ্রাবতী রায়বর্মনের কথাও বলা যায়, যাঁদের জন্ম ভাটি এলাকায়। তাঁরা রাধারমণ, মধুসূদনসহ বিভিন্ন অজ্ঞাত লোকগীতিকারদের গান শিখেছিলেন মা-দাদীদের মুখে। তাঁদের মুখ থেকে শুনে সেসব গান তাঁরা শিখে ফেলেছিলেন। এখন আপন খেয়ালেই তাঁরা গেয়ে বেড়াচ্ছেন বাংলাদেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। শুধুমাত্র গানের প্রেমেই জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসেও এঁরা ক্লান্তিহীন সুর ফেরি করছেন দেশের ভৌগলিক সীমা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের কলকাতা পর্যন্ত।

কিন্তু হাওরাঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্য থেকে এই রামকানাই দাশ, সুষমা দাশ কিংবা চন্দ্রাবতী রায়বর্মনদের যথাযোগ্য উত্তরসূরি আসছে কই? অথচ ভাটি এলাকার এমন কোনো পরিবার নেই, যে পরিবারে অন্তত একজন সুরেলা কণ্ঠের নারী ছিল না। এখন এসব শিল্পীদের বড়ই অভাব।

এ কারণেই কী তবে আগের মতো ঝিম-ধরা গানের পরিবেশ আর নেই? নেই সেই শ্রোতা? গত কয়েক বছরের ব্যবধানে ধামাইলগানের জনপ্রিয় গীতিকার প্রতাপরঞ্জন তালুকদার, বাউল কফিলউদ্দিন সরকার, রোহী ঠাকুরেরা দেহত্যাগ করেছেন। ধীরে ধীরে শূন্য হচ্ছে হাওরাঞ্চল কাঁপানো গ্রামীণ-গানের নায়কেরা। এ অঞ্চলের গানের ধারাকে বেগবানকারী কতশত নাম না-জানা লোকগায়ক আর গীতিকারদের লেখা গান কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে। চর্চা ও সংরক্ষণের অভাবে এঁদের গান ও সুর দুটোই এখন সোনালী অতীত।

যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা করা হলে হয়তো এ সংগীতধারা সচল রাখা যেত। আর এটা হলে প্রবীণ শিল্পী রামকানাই দাশও হয়তো এভাবে আক্ষেপ করতে পারতেন না ‘ঘাটুগান প্রায় পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে। কিন্তু উরিগানের প্রচলন হ্রাস পেলেও বিলুপ্ত হয়নি। উভয় প্রকার গানই বৃহত্তর সিলেট আর কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোনার অধিকাংশ স্থানে বিশেষ করে হাওর অঞ্চলের গ্রামীণ সংস্কৃতিতে জনপ্রিয় সংগীতধারা হিসেবে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বর্তমান ছিল।’ গানের সঙ্গে সঙ্গে এর রচয়িতারাও হারিয়ে যাচ্ছে। সেটাও রামকানাইয়ের জবানিতে পাই ‘ঘাটু ও উরি উভয় প্রকার গানেরই একজন প্রধান রচয়িতার নাম লালা।

লালার নিবাস কোথায় ছিল কেউ জানে বলে মনে হয় না। শুধু গানের মধ্যে থাকা সংক্ষিপ্ত ভণিতা থেকে লালার কথা জানা যায়।’ তার মানে বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের পর থেকেই এসব গান ও রচয়িতাদের নাম বিলুপ্ত হতে হতে এখন তলানিতে পৌঁছেছে।  সেই তলানি এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে বিয়ের সময় আবশ্যিকভাবে ধামাইলগান মুখ্য হয়ে ওঠত, এখন তা কেবল নিয়ম মানার জন্য দায়সারা ভাবে পরিবেশিত হয়। এই যদি হয় হাওরাঞ্চলের সবচেয়ে সমৃদ্ধ গানের ধারাটির বর্তমান রূপ, তাহলে অপর ধারাগুলোর বর্তমান অবস্থা সহজেই অনুমেয়। আমাদের ছোটোবেলায়ও দেখেছি বাউলগান কিংবা যাত্রাগানের আসরের আগে পুরো দিন বাড়ির উঠোনে খুঁটি গেঁথে ত্রিপাল টানিয়ে এবং মেঝেতে খড়খুটো দিয়ে মঞ্চ বানানো হতো। মধ্যরাতে গানের আসর শুরু হলে গ্রামসুদ্ধ নারী-পুরুষেরা হাজির হতেন।

এখন গ্রামাঞ্চলে বেড়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের কাছে এ দৃশ্য অনেকটাই বিরল। সময় কত দ্রুত বদলে যায়, সমাজ-সংস্কৃতির কত দ্রুত পরিবর্তন হয়। মাত্র বছর ত্রিশ কিংবা চল্লিশের ব্যবধানে হুট করেই পুরো ভাটি অঞ্চলটাই বদলে যেতে শুরু করল। সামাজিক, রাজনৈতিক ও ভৌগলিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গানের পরিবেশও বদলে যাচ্ছে। হাওরের অসংখ্য চেনা-অচেনা প্রজাতির মাছ ও জলজ উদ্ভিদের মতোই বিলুপ্তির পথে রয়েছে দোতরা, একতারা, ডপ্কি, ঢোল, মন্দিরা, করতাল, বাঁশিসহ গানের আসরে ব্যবহিত বাদ্যযন্ত্রগুলোও। প্রযুক্তির সুবাদে গ্রামীণ মানুষের হাতে আসছে এফএম রেডিও। অত্যাধুনিক মুঠোফোনের সুবাদে এসব মানুষের কাছে অতি সহজেই ব্যান্ডশিল্পীদের রিমিক্স গান দেদারসে বাজছে।

মফস্বল শহরের প্রায় বাসা-বাড়িতে ডিস্-সংযোগের মাধ্যমে হিন্দি গানের আগ্রাসনে পুরোপুরি মগ্ন তরুণ-যুবক-বৃদ্ধ আপামর নর-নারী। অথচ এই ভাটি অঞ্চলের গ্রামগুলো ছিল বাংলা লোকগানের ঐতিহ্যবাহী জনপদ, যার রয়েছে সুবিদিত ঐতিহ্য। কত কত শিল্পী, সাধক, কীর্তনীয়া, বাউল, ফকির ও সাধুসন্তদের বিচরণক্ষেত্র ছিল ভাটি অঞ্চলের মাটি। এ কারণেই ভাটি অঞ্চলকে বলা হতো ‘সুরের জন্মভুমি’, কিন্তু নামের সেই মাহাত্ম্য এখন আর চোখে পড়ে কই? গ্রামীণ জনপদ মাতিয়ে তোলা বহুবর্ণিল সেই সুর আর গান কেমন যেন রঙ হারিয়ে পাংশুটে ও বিবর্ণ হয়ে পড়ছে। আমাদের আক্ষেপটা ঠিক এখানেই। তবে কী এভাবেই অবহেলা ও সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাবে একটা অঞ্চলের সমৃদ্ধ গানের প্রবহমান ধারা?

লিখেছেনঃ সুমন কুমার দাশ