সুন্দরবনের গহিনে বাঘের চেয়েও রহস্যময় এক জীবের বাস, নাম ‘কালামুখ প্যারাপাখি’,   বাংলা নামের চেয়ে এর ইংরেজি নাম ‘ম্যাস্ক্ড ফিনফুট’ আজও এ দেশের পাখিপ্রেমীদের মাঝে বেশি পরিচিত। সুন্দরবনের জেলে ও বাওয়ালি একে বলে ‘হাঁসপাখি’, কেউ নাম দিয়েছে ‘গইলো হাঁস’,  কিন্তু পাখিটি হাঁস তো নয়ই, তার নিকটাত্মীয়ও নয়; বরং সারস, কালেম, কুট ও পানমুরগির ঘনিষ্ঠজন। ওই বিভ্রান্তিকর নাম ব্যবহার না করে বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ একে ‘প্যারাপাখি’ নামকরণ করেছে, কারণ পাখিটি মূলত প্যারাবনেই বাস করে।  পৃথিবীতে মাত্র দুই জাতের প্যারাপাখি আছে, ‘কালামুখ প্যারাপাখি’ ও ‘আফ্রিকার প্যারাপাখি’। বাংলাদেশ থেকে ভিয়েতনাম পর্যন্ত সাতটি দেশের মুষ্টিমেয় কটি বাদা এলাকায় কালামুখ প্যারাপাখি টিকে আছে। বর্তমানে সুন্দরবনই সম্ভবত পাখিটির বৃহত্তম আবাস। বিশ্বে কালামুখ প্যারাপাখির সংখ্যা খুবই কম ও সংখ্যাটা নিম্নগামী বলে বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল একে ‘বৈশ্বিক সংকটাপন্ন’ পাখির তালিকাভুক্ত করেছে। বাংলাদেশ-আইইউসিএন পাখিটিকে ‘বিপন্ন’ আখ্যায়িত করেছে।

প্যারাপাখি দূর থেকে দেখে সহজেই হাঁস বলে ভুল হতে পারে, আকারে-প্রকারে পাতিহাঁসের সঙ্গে এর কিছু মিল আছে। তবে এর বিশাল হলুদ ঠোঁট বেশ চোখা, হাঁসের মতো চেপ্টা নয়। এর লম্বাটে সবুজ পায়ের প্রতিটি আঙুলে বিচ্ছিন্ন পর্দা আছে, হাঁসের মতো পর্দা দিয়ে আঙুলগুলো জোড়া নয়। ছেলে ও মেয়ে প্যারাপাখির আকার ও রঙে পার্থক্য আছে। মেয়ের চেয়ে ছেলে বড়। মেয়ের ওজন আধা কেজির কম, ছেলের ওজন পৌনে এক কেজি। মেয়ের গলার পালক সাদা, ছেলের ঘন কালো।
কাদামাটিতে হেঁটে অথবা তীরসংলগ্ন পানিতে সাঁতার কেটে প্যারাপাখি মাছ, মাডিস্কপার, চিংড়ি ও পোকা শিকার করে। মানুষ দেখলে প্যারাপাখি খুব দ্রুত পানিতে দেহ ডুবিয়ে ফেলে অথবা বনের মধ্যে গা ঢাকা দেয়।

বাঘের মতো নিভৃতচারী এ পাখি কখনো দলবেঁধে বাস করে না, একাকী বিচরণ করে এবং কেবল প্রজননের সময় জোড়া বাঁধে। পানির কাছে ঝুঁকে থাকা গাছের সমান্তরাল ডালে পাতা দিয়ে বাসা বানিয়ে বর্ষাকালে প্যারাপাখি চার-ছয়টি ডিম দেয়।  বাঘের মতো প্যারাপাখিকেও সুন্দরবন ছাড়া বাংলাদেশে আর কোথাও দেখা যায় না। এ দেশে বাঘের সংখ্যা তবু মোটামুটি জানা আছে, কালামুখ প্যারাপাখির সংখ্যা সম্পূর্ণ অজানা। অধিকাংশ পর্যবেক্ষকের ধারণা, এ দেশে বাঘের চেয়েও প্যারাপাখির সংখ্যা কম; পাখিটি চোখে দেখেছেন এমন পাখিবিদের সংখ্যা আরও কম।

বাগেরহাট ও খুলনা জেলার সুন্দরবনের দক্ষিণে মানুষের আনাগোনা কম এমন নিভৃত খালের পাড়েই অধিকাংশ প্যারাপাখির বাস; বনের উত্তরে ও পশ্চিমে পাখিটি কমই চোখে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে প্যারাপাখির দেখা একেবারেই মেলে না। পৃথিবীর কোনো চিড়িয়াখানায় কালামুখ প্যারাপাখি নেই। সুন্দরবনের বাঘ গবেষণার মতোই দীর্ঘক্ষণ ধরে প্যারাপাখি পর্যবেক্ষণ করাও দুঃসাধ্য কাজ। ফলে পাখিটি সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাব রয়েছে।

‘তথ্যের অপ্রতুলতার বিচারে কালামুখ প্যারাপাখির মতো পাখি পৃথিবীতে কমই আছে’—এ মন্তব্য করা হয়েছে বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনাল প্রণীত ‘হ্যান্ডবুক অব দ্য বার্ডস অব দ্য ওয়ার্ল্ড’-এ। প্যারাপাখির বিচরণভূমির বৈশিষ্ট্য, আহার্য-তালিকা, পূর্বরাগ, প্রজনন-সফলতা ও ছানার জীবন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বহু তথ্য এখনো মানুষের অজানা। অদূর ভবিষ্যতে পাখিটির বিলুপ্তি রোধ করার জন্য ওই সব তথ্য সংগ্রহে দেশের দক্ষ গবেষকদের উৎসাহ দেওয়া জরুরি বলে পাখিপ্রেমীরা মনে করেন।
এ দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সহজেই এ বিষয়ে গবেষণা হতে পারে। সুন্দরবনের অনন্যসাধারণ এ পাখিটি সংরক্ষণে বন বিভাগেরও বিশেষ উদ্যোগ থাকা উচিত। বৈশ্বিক সংকটাপন্ন এ পাখি রক্ষা করার দায়িত্ব বাংলাদেশের সব পাখিপ্রেমী ও সচেতন মানুষের।

সুত্রঃ ইনাম আল হক । দৈনিক প্রথম আলো : ১৯.০৫.২০১০