চামড়া বন্দরের নৌকাঘাটে অষ্টগ্রাম যাবে এমন নৌকার খোঁজ করতে দেখা যাচ্ছে যে ব্যস্ত তরুণটি, তার নাম ঈভান। আর লঞ্চঘাটের পাশে একমাত্র ভাঙ্গাচোরা যাত্রী ছাউনিটির ছায়ায় নীল রঙের প্লাস্টিক চেয়ারটায় চোখ মুখ লাল করে বসে আছে যে তরুণী, তার নাম নিতুই। এই মুহুর্তে তাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বাংলাদেশের সবচেয়ে লক্কর ঝক্কর মার্কা ভয়াবহ রকমের রাস্তা কোনটি? সে নি:সন্দেহে বলবে, এই মাত্র সে যেই রাস্তা ধরে কিশোরগন্জ সদর হতে চামড়া বন্দরে এসেছে, সেই রাস্তা। আগেও বহুবার সে এই পথ ধরে ঢাকা কিশোরগন্জ ময়মনসিংহ কিংবা গাজীপুর গিয়েছে। প্রতিবারই রাস্তাটার এই বেহাল দশায় পরে বাস কিংবা সিএনজির ঝাকুনিতে মেজাজ যখন চরমে উঠে যেত, তখন কিছুটা মুখ ফুটে বাকিটা মনে মনে সে দেশের আমলা থেকে শুরু করে প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত সবার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে ছাড়ত। সে কখনোই নিজের মনকে বুঝ দিতে পারতো না, এই ছোট্ট একটা অঞ্চল কিশোরগন্জ, দেশের বড় বড় মাথাওয়ালা আর প্রভাবশালী লোকের যেখানে অভাব নেই, একটার পর একটা প্রেসিডেন্ট হয় যে অঞ্চলের মানুষ, সেই অঞ্চলের অবকাঠামো এতোটা নিম্নমানের হয় কি করে! সে একবার বগুড়ায় গিয়েছিল স্কুল থেকে একটা পিকনিকে, জেলা শহর, কিন্তু অবকাঠামো আর স্থাপনায় যেন বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাজধানী! একজন ব্যক্তির কারণেই যদি একটা জেলা শহর এতোটা উন্নত হতে পারে, সেখানে অবকাঠামোগত দিক দিয়ে কিশোরগন্জ তো এতোদিনে দ্বিতীয় হংকং সিঙ্গাপুর হওয়ার কথা!! হায় কপাল, এমন এলাকায় জন্ম, সারা জীবন খালি আফসোস করেই যাওয়া লাগবো!

এই পথে আগে হাজারবারই সে আসুক না কেন, এইবারের আসাটা একেবারেই ভিন্নরকম। বিয়ের পর এই প্রথম সে তার নিজ বাড়িতে ঈদ করতে যাচ্ছে। যাত্রাপথের যতরকম বিরম্বনা সে সহ্য করেছে তার সমস্ত রকম রাগ ক্ষোভ গিয়ে পরেছে সাথের মানুষটার উপর! যেন সংকীর্ণ রাস্তা আর তার ক্ষতগুলো, সিএনজি চালকের বেপরোয়া গতি, অসহ্য রকম ঝাকুনিতে মাথা ব্যথা আর বমি, এসব সমস্ত কিছুর দোষই বেচারা ইভানের। নিতুইকে কষ্ট দেয়ার এ যেন এক গোপন ফন্দি, যা যুগযুগান্ত ধরে ব্যাটা ছক করে রেখেছে। গোপন কোন পরামর্শে সে যেন প্রেসিডেন্ট সাহেবকে অনুরোধ করে এসেছে যেন কিশোরগন্জ টু চামড়া বন্দর রাস্তাটা কোন কালেই ঠিক না হয়। আজ সেই পরিকল্পনার মোক্ষম ব্যবহার করে ছেড়েছে, নিতুইকে যত রকম বিরম্বনা সম্ভব সবটাই সে দিতে পেরেছে। এই মুহুর্তে নিতুইয়ের চেহারার দিকে তাকালেই যে কেউ সেটা বুঝতে পারার কথা। ঈদের পূর্বমুহূর্তের যাত্রায় এরকম ভীড় আর বিরম্বনা খুবই স্বাভাবিক। এই পথে নিতুইয়ের এ ভোগান্তি যদিও নতুন নয়, তারপরও আজকে আর কারো প্রতিই তার কোন ক্ষোভ জাগছে না, না রাজনীতিক, না আমলা, না প্রেসিডেন্ট! আশ্চর্যভাবে সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ছে ঐ বেচারা ঈভানের উপর!

খুব ভোরে দুজনেই খুব তাড়াহুড়ো করে রওনা দিয়েছে, নাস্তা রেডি ছিল, তাও কেউ খেতে পারেনি। এই মধ্য দুপুরে দুজনেরই প্রচন্ড রকম ক্ষিধা লাগার কথা। যাত্রাপথের নানারকম ঝামেলায় কারোরই খাবার ফুরসত কিংবা ইচ্ছাটাই জাগেনি। যাই হোক, ঈভান ভীরের মধ্যে একটা ট্রলারে কোনরকম দুজনের বসা আর ব্যাগপত্র রাখার ব্যবস্থা করে খাবারের জন্য উপরে যেতে চাইলো

– চল যাই, উপর থেকে যা-ই পাওয়া যায়, একটু খেয়ে নিই।

– তুমি যাও, আমার ক্ষিধা নাই।

নিতুই একবার যখন না করেছে, ‍দ্বিতীয়বার আর বলে কোন লাভ হবে না জেনেও অগত্যা ইভান বললো-

–      চলো না, ভাল কিছু হয়তো পাওয়া যাবে না, তারপরও সারাটা দিন তো আর না খেয়ে কাটানো যাবে না। যা-ই হোক হালকা কিছু………

দ্বিতীয় অনুরোধে নিতুইয়ের মেজাজ গেল আরো খারাপ হয়ে। কথাটা আর শেষ করতে পারলো না ঈভান, নিতুই কেবল চোখ বড় করে তাকাল তার দিকে, সেই চোখে যে কতোটা আগুনের উত্তাপ, তার সামনে আর ঈভান মুহূর্তকাল দাঁড়াতে পারলো না। ঈভান আশ্চর্য হয়ে ভাবে, এই কি সেই চোখ, যা গত সন্ধ্যায় তার দিকে চা বাড়িয়ে দিতে দিতে অপলক স্নিগ্ধতা বিলিয়েছিল? গত পরশু চাঁদনি রাতে মাঝ পুকুরে কলার ভেলায় ভেসে বেরিয়েছিল? এই কি সেই চোখ যার প্রেমেই কিনা সে প্রথম দেখায় জীবন উৎসর্গ করে দিতে রাজি হয়েছিল? ঈভান সত্যিই ধাধায় পরে যায়, একই চোখ একই সাথে এতোটা স্নিগ্ধ আর প্রচন্ড উত্তাপের হয় কি করে। একবার মনে হয় এই স্নিগ্ধ চোখের জন্য হাজারটা জনম অনায়াসে কৃতজ্ঞতায় ভালবেসে যাওয়া এক নিতান্ত ব্যাপার। আর এই মুহুর্তেই কিনা মনে হচ্ছে, একটা মুহুর্তের এই আগুন-দৃষ্টি যেন তার হাজারটা জনম ছারখার করে দিয়ে যাচ্ছে! কোথা থেকে সে পায়, একই চোখে এতোটা স্নিগ্ধ জল আর এতোটা উত্তপ্ত আগুন?

ঈভান কথা না বাড়িয়ে উপরে চলে গেলো। ঈভানকে ওভাবে বিদায় করার পর থেকেই নিতুই’র মনটা পুড়ছিল, লোকটা যে তাকে রেখে কিছুই খাবে না, এ কথা সে জানে। জানে বলেই তার নিজের উপর রাগটা আরো বেড়ে গেল। এদিক সেদিক ইতস্তত ঘোরাফেরা করে কিছুই আর খেতে ইচ্ছে হলো না ঈভানের । বউ নিয়ে উঠলে হয়তো, দুজনে মিলে নদীর পারের ঐ ছাউনি ঘরে হাওড়ের চিংড়ি কিংবা পুটিমাছের ঝোল অথবা বোয়াল মাছ দিয়ে হাফ প্লেট ভাত এতোক্ষনে খেয়ে নিত। কিন্তু এখন আর তাকে কিছুই টানছে না, বউকে অভুক্ত রেখে নিজে এতোটা স্বার্থপরের মতো খেতে তার খুবই বাধছে, ইতোমধ্যে ক্ষিধাটাও নষ্ট হয়ে গেছে। ঘাটের পাশেই সার বেধে রাখা আনারস বিক্রি হচ্ছে, বাড়ির জন্য ভালো দেখে কিছু আনারস নিয়ে ওঠে গেল সে নৌকায়। ঈভানের মুখ দেখেই নিতুই বুঝলো যে তার ধারণার ব্যতিক্রম হয়নি। মনে মনে কষ্টই লাগতে থাকলো বেচারীর।

একটু পরই নৌকা ছেড়ে দিল, মালে আর ঘরমুখো মানুষে নৌকা বোঝাই, ডুবু ডুবু অবস্থা। নিতুই আর ঈভান পাশাপাশিই বসলো, কেউ কারো দিকেই তাকালো না, দুজনের মধ্যে কেমন যেন একটা গুমট ভাব বিরাজ করছে, ঠিক বৃষ্টি হওয়ার আগ মুহুর্তের আকাশের মতো। মিনিট ত্রিশেক চলার পর নৌকাটা একদম হাওরের মাঝে এসে পৌছাল, মাঝারি আকারের ঢেউ ভেঙ্গে নৌকাটি এদিয়ে যাচ্ছে, আকাশের অবস্থা অতটা সুবিধার না, যেন তাদের মনের মতোই অবস্থা, একটু হলেই ঝড়ের মতো গর্জে ওঠবে অথবা বৃষ্টির মতো ভেঙ্গে পড়বে। ঈভান হঠাৎ করে নিতুই এর হাত চেপে ধরলো, নিতুই যেন কেঁপে ওঠলো। এ কী অবস্থা! এই ছেলের লাজ শরম নাই, এতো এতো লোকের সামনে করে কী এগুলা! না, নিতুই দেখে ছেলের আক্কেল আছে বটে, বেশরম তবে বোকা না, নিতুইয়ের হাতটা তার উরনা দিয়ে ঢাকা পরেছিল, অন্যকেউ খুব খেয়াল করলেও তাদের যুগল হাতের আলিঙ্গন চোখে পড়ার মতো না! ঈভানের এই সতর্ক রোমান্টিকতায় মুগ্ধই হলো নিতুই, খুব গোপনে মাথা নিচু করে মুচকি হাসলো সে, আর আলতো একটা চাপ সেও দিল। এতোক্ষণের গোমট ভাবটা এমন ভাবে কেটে গেল যেন, তারা যোজন যোজন কোন এক স্বর্গীয় পথ পারি দিয়ে এসেছে এইমাত্র, যার স্নিগ্ধভাব তাদের দুজনকেই উচ্ছল করে নিয়ে যাচ্ছে আরো কোন এক স্বর্গীয় ঠিকানায়। ঈভানের এই মুহুর্তটায় ইচ্ছা হচ্ছে, হেচকা টানে নিতুইকে টেনে তুলে নিয়ে যায় নৌকার গলুইয়ের উপর। নিতুইয়ের সুন্দর চোখের দিকে তাকিয়ে, দুজনের দুইহাত ধরে, অপর দুইহাত দিয়ে গলুইয়ের পাশে দুজনেই চলন্ত নৌকার ঢেউ-ভাঙ্গা পানি ছুয়ে আসে। এক জন আরেক জনকে পানি ছিটা্য়ে ভিজিয়ে দেয়! এসব দুষ্টুমি যখন খেলা করছিল ইভানের মনে, নিতুই যেন এক পলক তার দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারছিল সব। টান দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিল সে-

–      যাহ্ অসভ্য ওঠো আমার পাশ থেকে!

এ কথায় ঈভান আরো অসভ্য হয়ে ওঠলো, সবার অলক্ষ্যেই নিতুই এর হাতটা আবারও ধরে নিজের মাথাটা একটু নিচে করে নিতুইয়ের হাতের পিঠে একটা চুমু এঁকে দিলো। আর সবার সামনে ভাবটা এমন যে, তাদের দুজনের বসার মাঝখানে কী যেন একটা নিচে পড়ে গিয়েছে, মাথা নিচু করে সে ঐটা্ই খুজছিল। যাতে নৌকার ঝাকুনিতে সে পড়ে না যায় এজন্য নিতুইয়ের হাতটা ধরে ছিল, এতোটুকুই! নিতুই এবার অনেকটা লজ্জায় লাল হয়ে ওঠলো, ইভান সবার অলক্ষ্যে এরকম কিছু করে বসবে এতোটা সে ভাবেনি।

যাই হোক, এইবার ঈভান উঠে গিয়ে সরাসরি নিতুইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে একটা চোখ টিপ দিয়ে বলল, বসো, আমি বরং উপরে যাই। তোমার পাশে থাকলে আরো কি না কি করে বসি, তার ঠিক নাই! তোমার পাশে থাকলে অসভ্য না হয়ে পারা যায় না!

নিতুই লজ্জায় আর কিছুই বললো না, হাসলো আর মাথা নিচু করলো।

নিতুইকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ঈভানের সখ আর স্বপ্ন দুই-ই। মুহুর্তকাল আগের রোমান্টিক আবহটাই তাকে আরো নানারকম রোমান্টিক চিন্তায় বিভোর করছিল। পৃথিবীর সুন্দর সুন্দর জায়গায় সে তাদের দুইজনকে কল্পনা করতে থাকলো, একটার পর একটা দৃশ্য তার কল্পনার রাজ্যের রাণীকে নিযে সাজাতে থাকলো, যা শত রকম নতুন নতুন দুষ্টুমিতে ভরা।

আকাশের গোমট ভাবটা যে এতোক্ষণে এক ভয়ংকর রুপ নিয়েছে, তা ঈভান খেয়ালই করেনি। হঠাৎ দেখে বাতাসের বেগ অস্বাভাবিক, হাওরের ঠিক মাঝখানটায় তারা, বিশাল বিশাল ঢেউ, নৌকা এমনভাবে দোলছে, মনে হচ্ছে এই বুঝি ডুবল! বাতাস আর ঢেউ ক্রমেই বাড়লো। তারপর হঠাৎ কেবল একটা মোচড়, স্টিলবডির নৌকো আর তাল রাখতে পারেনি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ডুবে যেতে থাকলো, তলিয়ে যেতে থাকলো জিনিসপত্র আর মানুষ। ঢেউয়ের এক চোটে ঈভান ছিটকে গিয়ে পড়লো নৌকা থেকে হাত দশ দুরে। উদভ্রান্তের মতো ঈভান খুজতে থাকলো তার প্রাণের নিতুইকে। তলিয়ে যেতে থাকা নৌকাকে ডুব দিয়ে অনুসরণ করলো সে। একটা জানালা ধরে ধরে এগিয়ে গেল ঠিক যেখানটায় সে বসেছিল নিতুইয়ের পাশে। কেউ নেই সেখানে, দ্বিগ্বিদিক কেবল মানুষের ছোটাছোটি। এতোক্ষণে ইভানের শ্বাস প্রায় ফুরিয়ে এসেছে, তাও সে খুজেই যাচ্ছে, কোথায় তার প্রাণের নিতুই? কোথায় সেই আগুনমাখা স্নিগ্ধ চোখ? কোথায় সেই লুকুচুরির হাত, যে হাতে এখনো তার চুমোর দাগ জীবন্ত? কোথাও খুজে পেল না ঈভান তার সেই নবপরিণীতা নিতুইকে!

পরদিন, দুপুরবেলায় ডুবুরির দল নৌকা উদ্ধার করলো। অন্য অনেকের সাথে একজনকে পাওয়া গেল, যাকে কিনা একটা ওরনা আকড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, মাথা নিচু করা, যেন সবার অলক্ষ্যেই সে কারো হাত ধরে আছে, এক অমৃত চুমু খাওয়ার দূর্বার লোভে!

ঈভান চলে যাওয়ার পর থেকেই নিতুই এর মন আর নৌকোর ভিতর টিকছিল না। বারবার সে এদিক সেদিক তাকাচ্ছিল। সে স্পস্টই লক্ষ্য করতে পারছিল যে, আকাশের অবস্থা ক্রমশই খারাপ থেকে ভয়ংকরতর হচ্ছিল। নৌকো ডুবু ডুবু অবস্থাতেই সে জানালা দিয়ে বের হয়ে যেতে পেরেছিল। হাবুডুবু খেতে খেতে সে নৌকোর উপর দিকে ঈভানকে খুজে বেড়াচ্ছিল। কোথায় কে? দিগন্ত জোড়া পানি আর পানি, বিশাল বিশাল ঢেউ আর ঢেউ। প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থায় এক জেলে নৌকো উদ্ধার করতে পেরেছিল নিতুইকে। তার নীল রংয়ের ওরনাটা রয়ে গিয়েছিল, নৌকোর ভিতর।

পরদিন লাশ খুজতে আসা স্বজনদের ভীড়ে, এক তরুণী তার নীল রংয়ের ওরনাটা আকড়ে থাকা তরুণকে দেখেই মূর্ছা গেল!