প্রায় সব মানুষেরই একজন মনের মানুষ আছে বা বন্ধু আছে, আর এই মনের মানুষটিকেই সে মনপ্রাণ উজাড় করে ভালবাসে। মনপ্রাণ উজাড় করেই তো ভালবাসবে, এরই নাম তো ভালবাসা, এরই নাম তো বন্ধুত্ব।

বন্ধু একটি ছোট শব্দ, কিন্তু এর গভীরতা অনেক। এই শব্দের মাঝে মিশে আছে পৃথিবীর সকল পবিত্রতা এবং মায়া-মমতার ছায়া। নির্ভরতার বিশ্বস্ত নাম হচ্ছে বন্ধু। বন্ধু নামটি শুনলেই কেমন যেন আপন আপন লাগে। বন্ধুত্ব এমন একটি বন্ধন, যাতে থাকে শর্তহীন ও স্বার্থহীন ভালোবাসা। বর্তমান ভার্চুয়াল জগতে বন্ধুত্বকে দেখা যায় ফেইসবুক চ্যাঁটিং এবং টুইটারে টুইট করে, যদিও এর মধ্যেই অনেকে প্রকৃত বন্ধু খুঁজে পায়। কিন্তু এছাড়াও বন্ধুত্বের আরেকটি জগৎ রয়েছে। যে জগৎটা তথ্য প্রযুক্তির এই চ্যাঁটিং বা টুইট করেই শেষ হয় না। বন্ধুত্ব হবে কোনো বিনিময় ছাড়া। যে বন্ধুত্বে বিনিময় নামের কোন নির্মমতা থাকে না সে বন্ধুত্ব হয় অনাবিল প্রশান্তির।

বন্ধু প্রত্যেক মানুষের জীবনে একটি গুরত্বপূর্ণ বিষয়। জীবন চলার পথে এই শব্দটা মানুষের জীবনে আসে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ভালই হোক বা খারাপ হোক বন্ধু মানুষের জীবনে আসবে, এটাই স্বাভাবিক। বর্তমান সমাজে স্বার্থ ত্যাগী বন্ধুর সংখ্যা অনেক কম। বন্ধুত্ব মানেই স্বার্থ বিনিময় নয়। ছেলে-মেয়ে বন্ধুত্বের বেলায়ও আমাদের নিঃস্বার্থ হতে হবে। বন্ধুত্ব যখন প্রেমে রূপ নেবে তখন তার মধ্যে ত্যগের মানসিকতা থাকতে হবে। বন্ধুর উপর বন্ধুর অধিকার থাকতে হবে। আজকাল দেখি ছেলে-মেয়ে একজন আরেকজনকে ভালবাসে, কিন্তু ছেলে-মেয়ে ভিন্ন ধর্মের। তারা একজনের কাছে আরকজন নিজের ধর্মকে সেক্রিফাইস করেছে। আমি বলবো তারা নিজেদেরকে নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসতে পারেনাই। তারা একে অপরের যৌনতাকে উপভোগ করার জন্য বন্ধুত্ব বা ভালবাসার আশ্রয় নিয়েছে।

এমন ভালবাসা তো জানোয়ারেও বাসে। যেমন পরিস্থিতির শিকার হয়ে বাঘিনী সিংহকে ভালবাসে, তারা সন্তানও জন্ম দেয়। উৎপাদিত বাচ্চার নাম হয়_টাইগার + লায়ন = টাইগন। ঘোড়া এবং গাধায় জন্ম দেয় খচ্চর, বর্তমানে গাধা এবং জেব্রার মিলনে হচ্ছে_ গাধা + জেব্রা = গাব্রা। আজকাল সমাজে দেখা যায় হিন্দু এবং মুসলিমে বন্ধুত্ব হয়, হয় প্রেম ভালবাসা এবং বিয়েতে গড়ায়। তাহলে তাঁদের ধর্ম পরিচয় কি? না হিন্দু না মুসলিম অথবা হিন্দু এবং মুসলিম উভয়য়ই। তাই তাঁদের ভবিষ্যৎ জেনারেশনের পরিচয় কি হবে? অনেক ভেবে চিনতে আমি তাঁদের একটি জাত পরিচয় বের করেছি। আর তা হল_ মুসলিম + হিন্দু = মুন্দু। আজ থেকে তাঁদেরকে আমি মুন্দু বলে ডাকতে চাই। আমি মৌলবাদী নই তাদেরকে আক্রমণ করবো। তারা বেচে থাক, তবে হিন্দু-মুসলিমের মত আলাদা একটি জাতি হিসেবে।

বন্ধুত্ব বা বন্ধু দিবসের প্রবন্ধে আমার আলোচনা হয়তো অনেকে বাড়াবাড়ি মনে করতে পারেন, তাঁদের নিকট আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। বন্ধুত্বে নেই কোন ছেলেমেয়ের ব্যবধান। বন্ধুত্বে নেই কোন জাত-বেজাতের ব্যবধান। তবে হ্যাঁ ছেলেমেয়ের ব্যবধান নেই মানেই স্বার্থ হাসিল উদ্দেশ্য নয়। জাত-বেজাতের ব্যবধান নেই, তাই বেজাতকে জাতের পথ দেখানোই প্রকৃত বন্ধুত্ব।

বন্ধু দিবসের ইতিহাসঃ
১৯৩৫ সাল থেকে আমেরিকাতে বন্ধু দিবস পালনের প্রথা চলে আসছে। ১৯৩৫ সালে আমেরিকার সরকার এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। দিনটি ছিল আগস্টের প্রথম শনিবার। তার প্রতিবাদে পরের দিন ওই ব্যক্তির এক বন্ধু আত্মহত্যা করেন। এরপরই জীবনের নানা ক্ষেত্রে বন্ধুদের অবদান আর তাদের প্রতি সম্মান জানানোর লক্ষেই আমেরিকান কংগ্রেসে ১৯৩৫ সালে আগস্টের প্রথম রোববারকে বন্ধু দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের অনুকরণ বাংলাদেশেও পালিত হয় বিশ্ব বন্ধু দিবস।

বন্ধুত্ব বিষয়ে মনিষীদের বানী,

বন্ধুত্ব বিষয়টাকে শেলবার্গ বলেছেন,

বন্ধু তাকেই বলা যেতে পারে, যে বন্ধুর সুখ-দুঃখের সঙ্গী হবে৷ সে সম্পর্কের মধ্যে ভালোবাসা থাকবে বটে, কিন্তু সে ভালবাসা হবে বিশেষ যৌক্তিক এবং বিশেষ মাত্রার।

জার্মান মনস্তত্ত্ব সংগঠনের প্রধান ক্রিস্টা বলছেন,
বন্ধু মানে সেই বিশেষ মানুষটি, যার সঙ্গে দীর্ঘ সময়ের সম্পর্ক আছে এবং থাকছে। যে ঘনিষ্ঠতার সবকিছু একে অপরের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারবে। যাকে যেকোনো সময়, যেকোন সমস্যা বা আনন্দের ভাগীদার করা যাবে। তবেই তাকে বলা যেতে পারে বন্ধু।

হেনরি ডেভিড থিওরোর মতে, অন্ধকারে একজন বন্ধুর সঙ্গে হাঁটা আলোতে একা হাঁটার চেয়েও ভালো।
প্লেটোর ভাষায়, আমার বন্ধুর জন্যে সবচেয়ে বেশি যা করতে পারি তা হলে শুধু বন্ধু হয়ে থাকা। তাকে দেয়ার মতো কোন সম্পদ আমার নেই। সে যদি জানে যে আমি তাকে ভালবেসেই সুখী, সে আর কোন পুরস্কারই চাইবে না। এক্ষেত্রে বন্ধুত্ব কি স্বর্গীয় নয়?
হেলেন কিলারের ভাষ্য_ একজন বিশ্বস্ত বন্ধু দশ হাজার আত্মীয়ের সমান।

ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গীতে বন্ধু নির্বাচনঃ

কোরানে বলা হয়েছে,
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা ঈমানদারদের বাদ দিয়ে কাফেরদের নিজের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা কি তাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করে আল্লাহতায়ালার কাছে তোমাদের বিরুদ্ধে কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ তুলে দিতে চাও? [সূরা আন নিসা_১৪৪]

নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, “মুমিন ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক মজবুত কর। আর তার সাথেই পানাহার কর।”

হাদিসে বলা হয়েছে,

“মানুষ তার বন্ধুর আদর্শে গড়ে ওঠে। সুতরাং বন্ধু নির্বাচনের সময় খেয়াল করা উচিত সে কাকে বন্ধু বানাচ্ছে।”

আমাদের নবীজী বলেছেন,
“একাকী নিঃসঙ্গতার চেয়ে ভালো বন্ধু উত্তম আর নিঃসঙ্গতা মন্দ বন্ধুর চেয়ে উত্তম।”

আমিরুল মুমেনিন হযরত আলী (আ) থেকে বর্ণিত হয়েছে,
“যে ব্যক্তি চিন্তাভাবনা করে যথাযথ বিচার বিশ্লেষণ করে বন্ধু নির্বাচন করবে, তাদের বন্ধুত্ব বজায় থাকবে এবং তাদের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর হবে।”

ইমাম গাযালী (রঃ) বলেছেন, “যার সাথে বন্ধুত্ব করবে তার মধ্যে পাঁচটি গুন অবশ্যই থাকতে হবেঃ

১. বুদ্ধিমত্তা।
২. সৎস্বভাব।
৩. পাপাচারী না হওয়া।
৪. বিদআতী না হওয়া।
৫. দুনিয়াসক্ত না হওয়া।

হযরত জাফর সাদিক (রঃ) বলেছেন, পাঁচ ব্যক্তির সাথে বন্ধুত্ব করবে নাঃ
১. মিথ্যাবাদী।
২. নির্বোধ।
৩. ভীরু।
৪. পাপাচারী।
৫. কৃপণ।

হাদিসে আছে “দুনিয়াতে যার সঙ্গে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা রয়েছে, পরকালে তার সঙ্গেই হাশর হবে।” মানুষ সামাজিক জীব। একটি সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর লোক বাস করে। সকলের পেশা এক নয়, তাই সমাজে একজনকে আরেকজনের প্রয়োজন পড়ে। সমাজবদ্ধতার প্রশ্নে মানুষ একে অপরের সাথে বালবাসা ও বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। প্রকৃত বন্ধু নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষ তার সামাজিক এবং ব্যক্তিগত জীবনকে সুষ্ঠু, সুন্দর এবং আনন্দময় করে তুলতে পারে।

সবশেষে কবীর সুমনের ভাষায় বলবো, ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে, দেখা হবে তোমার-আমার অন্য দিনের ভোরে।’