অনেক দিন আগের কথা, শীতকাল। সম্ভবত তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, থাকি সরারচর রহমান ম্যানসনের কলোনীতে। গোবিন্দপুর বিজয় স্যারের বাড়িতে যেতাম ভোর সাতটায় গনিত প্রাইভেট পড়তে, ফিরতাম ৯ টায়।

আমি, বাপন, রতনা, হেপী, মনি এই পাঁচ জনের ব্যাচ। ফিরতি পথে বাপনদের বাড়ির পাশ দিয়ে ঘন জংগল ঘেরা পথ মাড়িয়ে কাচারীর পুকুর ঘাটের পূর্ব পাশ দিয়ে কিছুটা পথ মাঝে মাঝে সহপাঠী রতনাকে এগিয়ে দিতাম অফদা অফিস পর্যন্ত। হঠাৎ একদিন অফদা অফিসের পাশে যেতেই পাথারিয়াকান্দির বাদশা ও জসিমকে দেখি অফদার পূর্বপাশের কবরস্থান ঘেষা একটি সরু কালভার্টের ভিতর মাথা ঢুকিয়ে দুইজন দুই দিক থেকে কি যেন দেখছে। আমাকে দেখেই চেচিঁয়ে উঠে বললো – দেইক্ষা যারে কালবাটের ভিত্রে টর্স লাইট জ্বলতাছে।

কৌতুহল নিয়ে আমিও উকি দিলাম সত্যিই তো! টর্স লাইট তো একটা না, দুইটা, জ্বলজ্বলে দুটি চোখ। আমাদের হৈ হুল্লুরে তোতলা জাহাঙ্গীর বাড়ি থেকে দৌড়ে এলো। বাবু, মইনুদ্দীন, রুবেল, মানিক, সোহরাব সহ ডজন খানেক এসে জড়ো হয়েছে। বুদ্ধি পরামর্শ চলছে, যে করেই হোক জন্তুটাকে কালভার্টের ভেতর থেকে বের করতেই হবে।

জড়ো করা হলো খড়, জসিম দৌড়ে গিয়ে বাড়ি থেকে শুকনা মরিচ নিয়ে এলো। কালভার্টের একদিকে খড় আর শুকনা মরিচ দিয়ে জ্বালানো হলো আগুন অন্যদিকে লাঠিসোটা নিয়ে জুনিয়র সিনিয়রদের লাঠিগুলো তখন প্রস্তুত, বেরুলেই এটাকে মারা হবে।

হৈ হুল্লোরের এক ফাঁকে ডোরাকাটা জন্তুটি সবাইকে ফাঁকি দিয়ে দৌড়ে পালালো। তার পিছনে পিছনে দৌড়াচ্ছে একদল শিশু কিশোরের দল। ব্যাটা যাবে কৈ আমিও দৌড়াচ্ছি। অবশ্য আমি অন্যদের থেকে অপেক্ষা কৃত কিছুটা ভদ্রলোক পায়ে সেন্ডেল হাতে বইখাতা দৌড়ের গতি অনেকটাই কম। মিনিট দশেক এলোপাথারী দৌঁড়ানোর পর পৌঁছালাম জাহাঙ্গীরের বাড়ির পিছনের পুকুর পাড়ে। দেখলাম পুকুরের পূর্ব-দক্ষিন কোনে চারদিক থেকে দল বেধে সবাই জন্তুটাকে বেধম পেটাচ্ছে ততক্ষনে সেটা মরে গেছে তবুও পেটাচ্ছে। জীর্নশীর্ণ দেহের বাদশা নিজেকে হিরো প্রমান করছে কেননা প্রথম আঘাতে সে জন্তুটাকে প্রথম কুপোকাত করে। এরপর চলে জন্তুটার লেজে দড়ি বেঁধে সারা গ্রাম ঘুড়িয়ে বাহবা কুড়ানোর পর্ব। তারপর বড় রাস্তার পাশে সারাদিন একটা মেড়াগোটা গাছে ঝুলিয়ে রাখা হলো।

ঐদিনের এই গল্পে কোন অভিভাবক ছিলোনা, ছিলোনা কোন সচেতন মানুষ যে কিনা দুরন্ত কিশোরদের পথ আটকে বলবে – এই কিশোরেরা বন্যপ্রাণী মেরোনা। আজ ভাবি তখন যদি প্রাইমারীতে আমাদের পাঠ্য বইতে বন্য প্রাণী সংরক্ষন বিষয়ক একটা প্রচ্ছদ থাকতো তাহলে হয়তো ঐ জন্তুটা সেদিন নিশ্চিত রক্ষা পেত।

আসুন এবার জানি খাটাস সম্পর্কে কিছু তথ্যঃ

নিশাচর প্রাণী বড় খাটাশ ডোরাকাটা এক ভয়ংকর-দর্শন প্রাণী। ধূসর শরীর, তাতে হলুদাভ আভা। সারা গায়ে ধূসর- কালো ডোরা ও ছোপ, লেজের অধিকাংশ ও মুখের কিছু অংশ কালো। শুধু শরীরের মাপ ৮০-৮২ সেমি। লেজ ৪৫-৫০ সেমি, ওজন ৩০-৩৫ কেজি। জেদি, সাহসী, লড়াকু ও শিকারি হিসেবে এরা অবশ্যই স্বীকৃতি পাবে। প্রাণীটি সর্বভুক। মাটিতে পড়া পাকা তাল, খেজুর, সফেদা, আম ইত্যাদি ফল যেমন খায়, তেমনি খায়  ধেনো ইঁদুর, ছোট পাখি ও পাখির ডিম-ছানা, ব্যাঙসহ পোষা হাঁস-মুরগি, ছাগলছানা, কুকুরছানা।

গেছো শামুক ও আপেল শামুক এরা গাছে আছড়ে ভেঙে ভেতরের মাংস যেমন খায়, তেমনি নির্বিষ সাপ ও ওই সাপের ছানার লেজ কামড়ে ধরে গাছে আছড়ে মেরে খায়। তিনটি অনির্বাণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এদের আছে। রাতে ছানাদের রেখে যখন শিকারে বের হয়, তখন বৃত্তাকারে ঘুরে গুহ্যদেশের মাংসপিণ্ড থেকে দুর্গন্ধযুক্ত রস নিঃসরণ করে ‘গন্ধবৃত্ত’ রচনা করে।

দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, মলত্যাগের জন্য এদের নির্দিষ্ট একটি জায়গা থাকে। যত দূরেই থাক, ছুটে এসে ওই নির্দিষ্ট জায়গাতেই মলত্যাগ করবে। এটাকে বলা হয় খাটাশের ‘টাট্টিখানা’। এমনকি দূরে কোথাও থাকার সময় মলের বেগ সামলাতে না পারলে এরা সামনের দুই পা দিয়ে বাঁশপাতা বা অন্য কোনো শুকনো পাতা মলদ্বারে গুঁজে দেয়।

তৃতীয়টি হলো, শীতকালে যখন ছানা বুকে শুয়ে থাকে, তখন লোমশ মোটা লেজটা ঘুরিয়ে কম্বলের মতো ছানাদের শরীরটা ঢেকে দেয়। লেজের ডগাটা থাকে নিজের নাকের ওপরে। এ ছাড়া বড় খাটাশের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এরা যদি কুকুর-শিয়াল বা অন্য কোনো প্রাণী অথবা মানুষকে কামড়ে ধরে, সাধারণত ছাড়ে না। এমনকি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কামড়ে ধরে থাকে। এদের পুচ্ছদেশে বা পশ্চাদ্দেশে দুটি গ্রন্থি আছে। একটি থেকে নিঃসরণ করে দুর্গন্ধযুক্ত তরল, যা ধরামাত্র শত্রুকে সাময়িকভাবে অন্ধ করে দেয়। অন্য গ্রন্থি থেকে বেরোয় সুগন্ধযুক্ত তরল।

এটি খুবই মূল্যবান। এর নাম হলো civet scent (খাটাশ-সুগন্ধি)। বছরে কমপক্ষে দুবার ছানা দেয় এরা। ছানা হয় তিন থেকে পাঁচটি করে। এরা রাতে মানুষকে তেমন ভয় পায় না। বড় খাটাশের ইংরেজি নাম Large Indian civet, বৈজ্ঞানিক নাম Viverra zibetha. আমাদের দেশের জীববৈচিত্র্যের সম্ভারে বড় খাটাশ একটি মূল্যবান প্রাণী। উলুবন ছাড়াও বড় খাটাশের প্রিয় আশ্রয়স্থল ইটের পাঁজা, পানের বরজ, আখখেত, খড়বন, বাঁশঝাড়ের গোড়াসহ গ্রামীণ বনের দুর্ভেদ্য ঝোপজঙ্গল। সারা দেশেই এসব কমেছে ও কমছে। আবাসন ও প্রাকৃতিক খাদ্যের সংকট তো আছেই, উপরন্তু নজরে পড়লেই মানুষ অকারণে এদের মারে। লেজে দড়ি বেঁধে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখে গাছের ডালে। চোখ না ফোটা ছানাগুলোও রেহাই পায় না মানুষের হাত থেকে। অহেতুক এর প্রতি হিংসাত্মক মনোভাব নিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা উচিত নয়। প্রকৃতি, পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এগিয়ে আসা প্রয়োজন সবারই।

লিখেছেনঃ জি, এম ফ্রেজার