বেগম আইভি রহমান ১৯৪৪ সালের ০১ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব থানায় জন্মগ্রহণ করেন৷ তাঁর পিতা মরহুম অধ্যক্ষ জালাল উদ্দীন আহমেদ ও মাতা বেগম হাসিনা বানু৷ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় বি এ (অনার্স) ডিগ্রী লাভ করেন৷ পারিবারিক জীবনে তিনি ১ পুত্র ও ২ কন্যা সন্তানের জননী ছিলেন৷ তাঁর স্বামী মোঃ জিল্লুর রহমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সাবেক মহামান্য রাষ্ট্রপতি

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আইভি রহমান ছাত্রজীবন থেকেই গণতন্ত্রের সংগ্রামে আত্ননিয়োগ করেন৷ ১৯৬২ সালে আইয়ুব শাহীর সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সেপ্টেম্বর মাসে শিক্ষা কমিশন আন্দোলন এবং ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন৷ ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকাকালীন তিনি মহিলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাংগঠনিক সম্পাদিকা নির্বাচিত হন৷ ‘৭০ এর নির্বাচনে আইভি রহমান বীরোচিত ভূমিকা পালন করে ঢাকা শহরে নির্বাচনের সাংগঠনিক কাজে মহিলা আওয়ামী লীগের কর্মীদের নেতৃত্ব দেন৷

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বেগম সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে তিনি রাইফেল ও ফাস্ট-এইড ট্রেনিং নেন এবং অন্যান্য মহিলাদেরও ট্রেনিং দেন৷ মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুজিব নগর সরকারের অধীনে ভারতে বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পগুলোতে কানাডীয়ান ইউনাইটারী মিশন এবং রামকৃষ্ণ মিশনের সহায়তায় খাবার, ঔষধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করতেন৷ মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ও উদ্যম সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি জয়বাংলা রেডিওতে নিয়মিত কথিকা পাঠ করতেন৷

‘৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে স্বেচছাসেবী নারী সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা সমিতি সংগঠিত হয়৷ মহিলা সমিতি পুনর্গঠনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এবং আমৃত্যু তিনি এ সমিতির উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন৷ ১৯৭২ সালে গঠিত বাংলাদেশ নারীবর্ষ উদযাপন কমিটির তিনি ছিলেন একজন উদ্যোক্তা৷

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মীদের উপর নির্বিচারে অত্যাচার ও নিপীড়নের সময় তিনি দৃঢ়তার সাথে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন৷

১৯৭৮ সালে আইভি রহমানকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মহিলা বিষয়ক সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়৷ তাঁর ত্যাগ, অবদান ও গতিশীল নেতৃত্বের কারণে ১৯৮০ সালে তাঁকে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত করা হয়৷ উভয় ক্ষেত্রে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনকালে তিনি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচচার ও সাহসী ভূমিকা রাখেন৷

বেগম আইভি রহমান স্কুল জীবনে মুকুল ফৌজ, গার্লস গাইডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমাজসেবা শুরু করেন৷ বাংলার অনগ্রসর মহিলা সমাজকে রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিকভাবে উদ্বুদ্ধ এবং সচেতন করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি ছিলেন অগ্রগামী সৈনিক৷ সর্বক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীর অধিকার আদায়ে তিনি আজীবন ছিলেন একজন নিরলস কর্মী৷

নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে ১৯৯৬-২০০১ সময়কালে জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে অনবদ্য ভূমিকা পালন করেন৷ ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নারী উন্নয়নে জাতীয় নারী নীতিমালা ও কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করে৷ আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতা হিসেবে নারী অধিকার ও নারী উন্নয়নে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন৷

২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন বিরোধী আইন প্রণয়নে আইভি রহমান অনবদ্য অবদান রাখেন৷ তিনি নারী অধিকার সচেতনে আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল এলায়েন্স অব উইমেন’ এর সম্মানিত সদস্য ছিলেন৷ এর স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি The American Biographic Institute USA কর্তৃক Woman of the year 2000 নির্বাচিত হন৷ এর পাশাপাশি দেশেও বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন৷

দলমত নির্বিশেষে নারী সংগঠন ও মানবাধিকার সংগঠনের মতামতের প্রতি ছিল তার অকুন্ঠ সমর্থন৷ জাতীয় যৌতুক প্রতিরোধ সমিতি, এসিড সার্ভাইভার্স ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ ফ্যামিলি প্ল্যানিং এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও স্বেচছাসেবী সংগঠনের কর্মকাণ্ডে তিনি জড়িত ছিলেন৷ বাংলাদেশ অন্ধ কল্যাণ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক বেগম আইভি রহমান বাংলাদেশ মহিলা সমবায় সমিতির চেয়্যারম্যানসহ আরও অনেক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করেন৷

২০০১-২০০৪ সময়কালে তিনি মহিলা সমিতির সদস্য হিসেবে আন্তর্জাতিক সংস্থা The Associated Country Women of the World (ACWW) এর সেন্ট্রাল এন্ড সাউথ এশিয়ার এরিয়া প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন৷ আইভি রহমান ২০০৩ সালে বাংলাদেশ মহিলা সমিতির উদ্যোগে ঢাকায় একটি আন্তঃ এশিয়া কনফারেন্স আয়োজনে নেতৃত্ব দেন৷

বেগম আইভি রহমান দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও জনগণের অধিকার পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে সক্রিয় থাকা অবস্থায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস বিরোধী সমাবেশে স্মরণকালের ভয়াবহতম ও বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হন৷ ঘটনাস্থলে তাঁর দু’টি পা ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে যায়৷ চিকিৎসার জন্য প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তাঁকে স্থানান্তর করা হয়৷ ৫৭ ঘন্টা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ২৪ আগস্ট রাত ২.০০ টায় তিনি শাহাদত বরণ করেন৷

সমাজসেবা/জনসেবা ক্ষেত্রে অনন্য ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখার জন্য বেগম আইভি রহমান-কে স্বাধীনতা পুরস্কার-২০০৯ (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়৷