কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর উপজেলাটির আয়তন ১৯৩.৭৩ বর্গ কি.মি.যার উত্তরে নান্দাইল উপজেলা,দক্ষিনে পাকুন্দিয়া এবং গফরগাঁও উপজেলা;পূর্বে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা আর পশ্চিমে গফরগাঁও উপজেলা।

নামকরণঃ
১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে জেমস রেলেন অংকিত অবিভক্ত বাংলাদেশের ভৌগোলিক মানচিত্রে কিশোরগঞ্জ জেলার যে সীমানা সে সীমানার মধ্যে মধ্যে যে তিনটি প্রধান স্থান বা জনপদের নাম পাওয়া যা তা হলো জংগলবাড়ী, অফুনপুর এবং বাজিতপুর। হোসেনপুর পূর্বে হুসুনপুর উচ্চারণ করা হত বলে জানা যায়। তাই উচ্চারণ পার্থক্যে বিদেশীদের কাছে হোসেনপুরকে অফুপুর লেখা হয়েছে বলে ধারণ্য করা হয়। হোসেনপুরকে প্রাচীন কিশোরগঞ্জের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনপদ হিসেবে উক্ত মানচিত্রে দেখানো হয়েছে।

কিশোরগঞ্জের আগে হোসেনপুরে চৌকি বা মুন্সেফী আদালত স্থাপিত হলেও কত সালে তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা অনেক চেষ্টা করে জানা যায়নি। শুধু জানা যায় ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে হোসেনপুরের মুন্সেফী আদালত কিশোরগঞ্জে নিয়ে আসা হয়।

বাংলার শাসনকর্তা সুলতা আলাউদ্দিন হোসেন শাহের নামে এ পরগনাটি পরিচিত। ব্রহ্মপুত্র নদের যে তীরে তিনি অবস্থান করেছিলেন তা আজো হোসেনপুর বলে পরিচিত। সম্রাট আকবরের রাজস্ব মন্ত্রী টোডরামলে রাজস্ব বন্দোবস্তে এই পরগনার জমা ৪৫৬৮৮ টাকা আট আনা নির্ধারিত হয়। অতঃপর ১৫৯৭ খ্রিঃ পরগনাটিসহ অপরাপর বাইশটি পরগনা সম্রাট আকবর ঈশাখাঁকে প্রদান করেন। তাঁর মৃত্যুর একশত বৎসরের মধ্যে এটি তাঁর আমলে বেত্রটির দেওয়ানের হস্তগত হয়। সুবেদার মুর্শেদকুলী খাঁর রাজস্ব বন্দোবস্তকালে এটি চরাকা জাহাঙ্গীর, ইট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দেওয়ানী লাভের পর তাদের নায়েরব দেয়ান রেজা খাঁর সময় তা ঢাকা নেয়াবত এ ইমাম দায়ী হুজুরী সেরেসস্তাদার অন্তর্গত জমিদার ভবানী প্রসাদের অধীন ছিল। এখানে উল্লেখ্য-এর মধ্যবর্তী সময়ে এটি সরকারর বাজুহার অন্তর্গত রাজস্ব বিভাগ হিসেবে রাজশাহীর অন্তর্গত ছিল। অষ্টাদশ শতাবন্দীতে নাটোর রাজবংশের প্রাধান্যের সময় এটি নাটোরের শাসনাধীনে আসে। ১৭৯৩ খ্রিঃ মহারাজ রামকৃষ্ণ এর জমিদারী খাজনার দায়ে নিলামে উঠে। এ পরগনাটি খাজা আরাতুন নামক একজন আর্মেনীয় ক্রয় করেন। একই বৎসর এটি রাজশাহী থেকে ময়মনসিংহ কালেক্টরেটের অধীনে আসে। ১৮২২ খ্রিঃ আরাতুনের দুই কন্যা বিবি কেথারিনা, বিবি এজিনা এবং তার দুই আত্মীয় ওয়াইজ ষ্টিফেন্স এবং কেসপার্জ (মতান্তরে হোম্স) প্রত্যোকে চারি আনা অংশে এই পরগনার জমিদারী লাভ করেন। ১৮৫৩ খ্রিঃ আঠারবাড়ীর শম্ভুচন্দ্র রায় বিবি এজিনার অংশ (কিংবা মতান্তরে কেসপার্জ ওরফে হোমস এর অংশ), মোহিনী রায় বিবি কেথারিনার অংশ ওয়াইজ সাহেব এদেশ ত্যাগ করেযোবার সময় তাঁর জমিদার হোসেন শাহীর চার আনা মুক্তাগাছার জমিদার রাম কিশোর আচর্য চৌধুরী এবং অবশিষ্ট অংশ গাংগাটিয়ার দীননাথ বংশ চক্রবর্তী, মসুয়ার হরি কিশোর রায়, সরারচরের জয় গোবিন্দ রায় ও টি টি কেলা নোজ এর নিকট বিষয় করেন। মুক্তাগাছার রাম কিশোরের অংশ তার পুত্রের আমলে নিলাম করলে আঠার বাড়ীর মহিম চন্দ্র রায় এই অংশ খরিদ করেন। অন্যান্য শরীকগণ ক্রমশঃ আঠারবাড়ীর জমিদারদের নিকট তাদের অংশ বিক্রয় করেন। ফলে এ শতাব্দীর শেষ দিকে (১৯০৪) আঠারবাড়ীর জমিদার জ্ঞানদা সুন্দরী চৌধুরাণী স্বামীর উত্তরাধিকার ও ক্রয়সূত্রে এ পরগণার চৌদ্দ আনার মালিক ও পাওনাদার ছিলেন। অবশিষ্ট দুই আনা গাংগাটিয়ার অতুলচন্দ্র চক্রবর্তী ও অন্যান্য ক্ষুদ্র অংশীদারদের ছিল।

মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ এর আমলে বাংলার তদানিন্তন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ একদা  ব্রহ্মপ্রত্র নদ দিয়ে পরগনার প্রজা সাধারণের সুখ-দুঃখ স্বচক্ষে দেখার জন্য এখানে আগমন করেন এবং দুল বাজার নামক এক জায়গায় বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন। পরবর্তীতে এ দুল বাজারই সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এর নামানুসারে ‘‘হোসেনপুর’’ নামকরণ করা হয় বলে জনশ্রুতি আছে।

প্রধান নদী সমূহঃ
পুরনো ব্রহ্মপুত্র(প্রায় মৃত) এবং নরসুন্দা; উল্লেখ্যযোগ্য জলাশয় পানান বিল।

উলে­খ্যযোগ্য স্থান বা স্থাপনাঃ
১. কুড়ির ঘাট বধ্যভূমি
২. রামানন্দের বাড়ী
৩. গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়ী
৪. সাহেব বাড়ী

প্রশাসনঃ
বর্তমানে হোসেনপুর থানা একটি উপজেলা যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২২ সালে। এতে ৬টি ইউনিয়ন পরিষদ,৭১টি মৌজা,১০১টি গ্রাম আছে।

উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নাম

১.জনাব আলহাজ্ব মোঃ আঃ কাদির স্বপন ,
চেয়ারম্যান, হোসেনপুর উপজেলা পরিষদ ।
মোবঃ-    ০১৭১২৪৬২৭৯৫

২. জনাব মোঃ আশরাফ হোসেন (কবীর),
ভাইস চেয়ারম্যান,    হোসেনপুর উপজেলা পরিষদ।

৩. বেগম সেলিনা সারোয়ার,
মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান,হোসেনপুর, উপজেলা পরিষদ।

৪. জনাব,মোঃ ফজলুল হক,ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, সিদলা ইউপি।
৫. জনাব মোঃ মাহবুবুল হাসান, চেয়ারম্যান,পুমদী ইউপি।
৬. জনাব মোঃ সোহরাব উদ্দিন খান, চেয়ারম্যান, জিনারী ইউপি।
৭. জনাব মোঃ সাইফুল ইসলাম, চেয়ারম্যান, গোবিন্দপুর ইউপি।
৮. জনাব মোঃ আঃ বাতেন, চেয়ারম্যান, আড়াইবাড়ীয়া ইউপি।
৯. জনাব মোঃ শাহ মাহবুবুল হক, চেয়ারম্যান, শাহেদল ইউপি।

হোসেনপুর শহরঃ
শহরটির আয়তন ৪.৫১বর্গ কিমি,এতে মৌজা আছে ৩ টি। এর লোকসংখা ১৩৭৫৪জন;পুরুষ ৫১.৮৪%,মহিলা ৪৮.১৬%। এই শহরের জনসংখ্যার ঘনত্ব ৩০৪৯/বর্গ কিমি। শহরের স্বাক্ষরতার হার ৩০.১%।

ঐতিহাসিক ঘটনাবলীঃ
স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি আর্মির সাথে হোসেনপুরে এক সংঘর্ষে মুক্তিযুদ্ধারা ৩৯ পাক সৈন্যকে হত্যা করে এবং প্রচুর পরিমানে অস্ত্রও গোলাবারুদ হাতিয়ে নেয়। ১৮ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধারা একটি ব্রীজ ধ্বংস করে। তাঁরা একটি রাজাকার ক্যাম্প এ হামলা করে ১৪ জন রাজাকারকে অস্ত্রসহ বন্দি করে। প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন ও ভগ্নস্তুপঃ পিতলগঞ্জ নীল কুঠি(১৮০০), গনগাটিয়া জমিদার বাড়ির মন্দির, কুলিশাওরী কালী মন্দির।
জনসংখ্যাঃ ১৪৮০২৮; পুরুষ ৫১.৪৯%, মহিলা ৪৮.৫১%; মুসলিম ৯৭.৬২%, হিন্দু ২.২৭%;অন্যান্য ০.১১%।

স্বাক্ষরতা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানঃ
গড় স্বাক্ষরতা ২৩.১%; পুরুষ ২৭.৪%, মহিলা ১৮.৫%।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানঃ

কলেজ ২টি, উচ্চ বিদ্যালয় ৮টি, মাদ্রাসা ৪৬টি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৫৪টি, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১০টি; উল্লেখ্যযোগ্য প্রতিষ্ঠান হোসেনপুর হাই স্কুল(১৯৩৬)।

প্রধান পেশাসমূহঃ

কৃষি ৫৬.৬৯%,কৃষি মজদুরি ১৮.৪৩%, দিনমজুর ৩.৩৮%, ব্যবসায় ১০.৬৩%, যানবাহন ২.০২%, চাকুরী ২.৬৫%, অন্যান্য৬.২০%।

জমির ব্যবহারঃ

এক-ফসলী ৭%, দ্বি-ফসলী ৩৫%,  ত্রিফসলী ৫৮%;  সেঁচের আওতাভুক্ত জমি ৩১%।
কৃষকের মাঝে জমির নিয়ন্ত্রন ২৭.৮৪% ভূমিহীন,২৪.৪৮%প্রান্তিক,২৭.৯৬%ছোট, ১২.৩৯%মাঝারী, ৭.৩৩%ধনী চাষী।

জমির মূল্যঃ প্রথম মানের ০.০১ হেক্টর জমির মূল্য প্রায় ১০০০০টাকা।

প্রধান শস্য পাট,গম,সরিষা বীজ,আলু,বেগুন,মরিচ, ভুট্টা,পান,পটল।
বিলুপ্ত বা প্রায় বিলুপ্ত শস্য ধান,খেসারী,কালাই।
প্রধান ফল আম,কাঁঠাল,কলা,বেল,নারিকেল,পেঁপে,বরই,আতা,জামরুল।

মাছ চাষ,পশুপালন,পোল্ট্রিঃ

মাছের খামার ১টি,পশু খামার ১০টি,পোল্ট্রি ১২৪টি, হ্যাচারী২০টি।
যোগাযোগ ব্যবস্থাঃ পাঁকা রাস্তা ১১কিমি, মাটির রাস্তা ২৮১কিমি,আধাপাঁকা ৮কিমি।
ঐতিহ্যবাহী যানবাহন পাল্কি,ঘোড়ার গাড়ি,গরুর গাড়ি।এই যানবাহনগুলো বিলুপ্ত বা বিলুপ্তপ্রায়।

শিল্পকারখানাঃ আটার মিল ১৬, ওয়েল্ডিং ২৪।
কুটির শিল্পঃ বাঁশের কাজ ১২০,কাঁঠের কাজ ১২১, স্বর্ণকার ৩১, কামার ৭৯, কুমোর ৩৭,দর্জি ১৭০।
হাট, বাজার,মেলাঃ মোট হাট বাজার ২০টি,তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হচ্ছে হোসেনপুর বাজার, বানাগ্রাম, জিনারী, ভাংগাটিয়া,পিতলগঞ্জ,রামপুর, আমন সরকার, হারেঞ্জা,গোবিন্দপুর, চরপামদী,শাহীদল।
প্রধান রপ্তানীজাত পণ্য ধান,পাট,গম,ডাল,আঁখের গুড়,কলা।

এন.জি.ও কার্যক্রমঃ কার্যত গরুত্তপূর্ন এন.জি.ও গুলো হচ্ছে প্রশিকা,আশা,গ্রামীণ ব্যাংক,গন স্বাস্থ্যকেন্দ্র।
স্বাস্থ্য কেন্দ্রসমূহ উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র ১টি,স্যাটেলাইট ক্লিনিক ৬টি, পরিবার পরিপকল্পনা কেন্দ্র ৫টি।