চিৎকার-চেঁচামেচিতে পটু যে কটি উল্লেখযোগ্য পাখি আছে বাংলাদেশে, তার মধ্যে সেরা বোধ হয় নীলকণ্ঠ পাখি। চমৎকার নীলরঙা এই পাখিটি কারণে-অকারণে উত্তেজনায় ভোগে সর্বক্ষণ। চরাচর সচকিত করে, চেঁচামেচি করে আর ওড়াউড়ি করে। চোখে এদের সর্বক্ষণ লেগে থাকে একটা ভয়-ভয় ভাব ও সতর্কতা। অতিশয় ধুরন্ধর, প্রখর দৃষ্টিসম্পন্ন এই পাখিটি অনেক উঁচুতে বসেও মাটি-ঘাসবন-ধানখেতে একটি ছোট পতঙ্গের নড়াচড়া দেখতে পায়। তালের পাতা, বিদ্যুতের তার, খুঁটি বা উঁচু কোনো গাছের ডালে বসে নজর বোলায় চারদিকে। শিকার নজরে পড়লেই ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকড়াও করে। খাদ্য এদের পোকা-কীটপতঙ্গ-ব্যাঙ-সাপের বাচ্চা-টিকটিকি-অ্যাঞ্জন-গিরগিটি ইত্যাদি।

তবে তেলাপোকা, ঝিঁঝিপোকা ও গুবরে পোকা নজরে পড়লে এদের মাথা খারাপ হয়ে যায়—পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকার পাকড়াও করতে। ফকিরহাট-বাগেরহাটে নীলকণ্ঠের নাম ‘থোড়মোচা’ ও ‘কেওয়া’। কলার মোচার মতো রং অনেকটা, আকার-গড়ন-ধরনও কলার মোচার মতো, তাই এই নাম। অনেকটা ক্যাঁও ক্যাঁও শব্দে ডাকে, নাম তাই ‘কেওয়া’। এই দুটি নামই শুধু নয়, বাগেরহাট-ফকিরহাটের বহু প্রাণী ও পাখির স্থানীয় মজাদার নাম ব্যবহার করেছেন মনিরুল খান তাঁর প্রকাশিত বই এ গাইড টু ওয়াইল্ড লাইফ-এ।

নীলকণ্ঠ মূলত উঁচু খোলা মাঠ বা বিলের কিনারের পাখি। খোলা প্রান্তর পছন্দ ওদের। প্রয়োজনে দ্রুত বেগে উড়তে-ঘুরতে পারে, আচমকা বাঁক নিতে পারে যেকোনো দিকে। খাড়া উড়তে পারে, ডানা মুড়ে সোজা সরলরেখায় মাটির দিকেও নামতে পারে। বাসা করে মরা তাল-খেজুর-নারকেল বা অন্য কোনো মোটা গাছের খোঁড়লে। বাসার ধারেকাছে মানুষ বা অন্য কোনো শত্রু গেলে এদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। প্রবল উত্তেজনায় চেঁচিয়ে মাত করে পুরো এলাকা। আবার রাতে যদি বনবিড়াল-মেছো বাঘ-হুতুম পেঁচা-সারেল-ছোট খাটাশসহ অন্য কোনো নিশাচর প্রাণী ডিম-ছানা বা আস্ত বড় পাখিটার লোভেই গাছে চড়ে, তো সঙ্গে সঙ্গে বাসা থেকে বেরিয়ে চেঁচিয়ে চারদিকটা সচকিত করে তোলে।

নিঝুম রাতে ওই ডাক প্রায় আধা কিলোমিটার দূর থেকেও শুনতে পাওয়া যায়। মরা তাল-খেজুরগাছ আজ আর দেখা যায় না—হয় গেছে জ্বালানি হয়ে চুলোয়, নাহয় ইটের ভাটায়। বাসা বাঁধার জায়গার তাই তীব্র সংকট ওদের। মরা তাল-খেজুর-নারকেল গাছের কোটরে বাসা করত বালিহাঁসেরাও (cotton pygmy goose)। সরকারিভাবে মরা গাছ কিনে যদি রক্ষা করা যেত, তাহলে বালিহাঁস আবারও বাসা করত, নীলকণ্ঠরা থাকত সুখে। পুরোনো দরদালান-মন্দিরের ফাঁকফোকরেও বাসা করে এই দুই প্রজাতির পাখি।

এদের আছে প্রেমের উচ্ছ্বাসভরা গান, ধ্রুপদি নাচ—শূন্যে, প্রজনন মৌসুমে পুরুষটির আনন্দ আর নাচের কসরত দেখে কে! প্রেমিকাকে পটাতে আকাশে শরীরের নীলাভ রঙের ঝলক ছড়াতে ছড়াতে এরা নেচে চলে। শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যে এরা আমার নিত্য প্রতিবেশী ছিল। এই ২০১০ সালেও আছে। তবে সংখ্যায় গেছে কমে। সারা দেশেই দেখা মেলে এদের। ১৯৯৯ সালেও ঢাকার শিশু একাডেমীতে এক জোড়া পাখি নিয়মিত দেখা যেত। ঢাকার শহরতলিতে এখনো নজরে পড়ে মাঝেমধ্যে। মান্ডা বিলে মাত্র কিছুদিন আগেও দেখা গেছে। নিয়মিত বাসা করত কদমতলা-রাজারবাগ এলাকার বিশাল গঙ্গাসাগর দিঘির পাড়জোড়া কালীমন্দির চত্বরে।

নীলকণ্ঠের ইংরেজি নাম Indian Roller, মাপ ৩১-৩৩ সেন্টিমিটার। বাংলাদেশে নীলকণ্ঠের দুটি উপপ্রজাতি রয়েছে। প্রথমটির বৈজ্ঞানিক নাম coracias benghalensis। এটি সারা দেশেই দেখা যায়। এখানে যেটির ছবি ছাপা হলো, সেটির দেখা সারা দেশে মেলে না। এটির বৈজ্ঞানিক নাম coracias benghalensis affinis। এটির দেখা ক্বচিৎ মেলে গারো পাহাড়শ্রেণী, হবিগঞ্জ, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। আমি মাত্র পাঁচবার দেখেছি এদের। ২০০২ সালে শ্রীমঙ্গলে এক আদিবাসী বালক আঠার ফাঁদে একটি পাখি আটকেছিল। ওটার কয়েকটি পালক আমার সংগ্রহে রয়েছে আজও। এদের শরীরে নীলের আধিক্য বেশি, প্রথমটির চেয়ে দেখতে তাই বেশি সুন্দর। দুটিরই শরীরের ধরন-গড়ন, আচার-আচরণ ও খাদ্যতালিকা একই রকম।

 -লিখেছেনঃ শরীফ খান