বাংলাদেশের হাওড়গুলোর মত মিঠাপানির এমন জলা পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। আর যা আছে, সুইটেবল নেচারের কম। এগুলোয় লেকের মতো পানি বেশি গভীর নয়। বেশির ভাগই শিতকালে ফসলের মাঠে পরিনত হয় ; মাঝখানের গভির বিল গুলোতে শুধু পানি থাকে। কিশোরগঞ্জ আর সুনামগঞ্জের হাওড় গুলো বেশ ক্যারেক্টারাইজ্ড। কয়েকটি জীব বৈচিত্রের জন্য সংরক্ষিত। সেগুলোর মধ্যে টাঙ্গুয়ার হাওড় আর বাইক্কা বিল অন্যতম।

হাওড় সম্পর্কে আরো জানতে চাইলে নিচের উইকিপেডিয়া টুকু পড়ুন; নইলে স্কিপ করে সময় বাঁচান –

“সাগর” শব্দটি থেকে “হাওর”  শব্দের উৎপত্তি বলে ধরে নেয়া হয়। আঞ্চলিক ভাষায় মানুষ ‘স’ কে ‘হ’ আর ‘গ’ কে ‘হ’ উচ্চারন করায় শব্দের এই বিবর্তন। হাওর মূলত বিস্তৃত প্রান্তর, অনেকটা গামলা আকৃতির জলাভূমি যা প্রতিবছর মৌসুমী বৃষ্টির সময় পানিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সমগ্র বর্ষাকাল জুড়ে হাওরের পানিকে সাগর বলে মনে হয় এবং এর মধ্যে অবস্থিত গ্রামগুলোকে দ্বীপ বলে প্রতীয়মান হয়। বছরের সাত মাস হাওরগুলো পানির নিচে অবস্থান করে। শুষ্ক মৌসুমে অধিকাংশ পানি শুকিয়ে গিয়ে সেই স্থানে সরু খাল রেখে যায় । শুষ্ক মৌসুমে হাওরের পুরো প্রান্তর জুড়ে ঘাস গজায়, গবাদি পশুর বিচরণক্ষেত্র হয়ে উঠে। হাওরে আগত পানি প্রচুর পলিমাটি ফেলে যায় যা ধান উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত উপকারী। আন্তর্জাতিক নেচার কন্জারভেশন ইউনিয়ন (IUCN) এর তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রায় ৪০০ হাওর রয়েছে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি হাওর রয়েছে সিলেট বিভাগে। সুনামগঞ্জের হাকালুকি হাওর সর্ববৃহৎ। শীতকালে এসব বিলকে ঘিরে পরিযায়ী পাখিদের বিচরণে মুখর হয়ে উঠে গোটা এলাকা। এছাড়া টাঙ্গুয়া, আলির হাওর, বাইক্কা বিল আর নাটোরের চলন বিল উল্লেখযোগ্য।

In the central part, important beels are Katla, Chatal, Nagarkanda, and Chanda. In Comilla, Faridpur, Dhaka and Pabna districts the beel is called as baor. Bengali language has several terms to differentiate between lakes, including Baor, Haor, Jheel and Beel. All four are types of similar freshwater wetlands.

The line of difference between an haor, a beel and a baor is usually very thin. A beel is usually a depression or topographic low generally produced by erosion or other geographical process. These are generally smaller and seen all over Bangladesh. These are marshy in character. Sometimes beels are remains of a river that has changed its course. Beels are generally smaller than haors, but Chalan Beel in Rajshahi is large, through which the Atrai River passes. It has shrunk over the years but still occupies an area of 26 km² in dry season.

A baor is an oxbow lake, found mostly in the moribund delta as in greater Comilla, Faridpur, Dhaka and Pabna districts. The haor is predominantly a feature of north-eastern Bangladesh.

Some famous are Chalan Beel, Gopalganj-Khulna Beel, Meda Beel, Aila beel, Dekhar beel, Kuri beel, Erali beel and Arial Beel. In the northwest, larger beels are Bara Beel in Pirganj, Tagrai Beel in Kurigram, Lunipukur in Rangpur, Bara Mirzapur Beel in Narail and Keshpathar in Bogra. The old river course of Atrai is marked by some beels. In the south, important beels are Boyra, Dakatia, Bara, Kola, Patla, Chatal and Srirampur.

হাওড়াঞ্চল নিয়ে আমার স্বপ্ন দেখার কারন আছে। এখানকার পরিবেশ ঋতুভেদে বদলায় ; জীবন ও প্রকৃতিতে আনে বৈচিত্র। এই বৈচিত্রে খাপ খাওয়াবার সামর্থ্য না থাকলে এখানে জীবন দূরুহ । আধুনিক জিবনের সবকিছুই এখানে দুর্লভ। এমন কি বাসস্থান, অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিতসা – এই মৌলিক চাহিদাগুলোও এখানে সাধারনের জন্য সহজ নয়। কিন্তু মানুষ ও প্রকৃতি এখানে উপভোগ্য।

এখানকার বসতি গুলোতে মানুষ খুব বেশি নয়। তাই অতি জন সংখ্যার চাপ সেখানকার পরিবেশ কৃত্তিম করতে পারেনি। সেখানকার খাবারের স্বাদও অনন্য। মাছ আর হাঁস সুলভ। দুধ-মাংসের স্বাদ অসাধারন। শাক-শব্জিও একেবারে মাখ্খন বরাবর। একবার খেলে ওখানকার ভাতের স্বাদ ভুলবেন না দির্ঘদিন। খাবারের এই স্বাদের কিন্তু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। বছরের দীর্ঘ একটা সময় ঐ এলাকার ফসলি বা চারনভুমি পানিতে তলিয়ে থাকে। উজান ঢলে আসা উর্বর নতুন পলি জমে প্রতি বছরই। ঐ মাটিতে চাষ করা ফসলতো অমন জিভে লাগার মত হবেই। আবার ঐ মাঠের ঘাস আর অন্যান্য খাবারই খায় ওখানকার গরু-ছাগল-হাস-মুরগি। এজন্যই ওখানকার ডেইরি বা পোল্ট্রি সুস্বাদু। একই কারনে মাছও টেস্টি। বন্যা ছাড়া প্রতি বছরই ঐ রকম পলি অন্য কোথাও পরে না; কাজেই খাবারের ঐ স্বাদ আপনি অন্য খানে কিভাবে পাবেন!

চাকরির সুবাদে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, ইটনা আর নিকলি যাবার সৌভাগ্য হয়েছিলো। এগুলো একেবারে হাওড়ের মাঝে। বেশ ক’বার দীর্ঘ লঞ্চ ভ্রমন করতে হয়েছে। মাঝে মাঝে সময় যেনো আর ফুরোতো না। কিন্তু ব্যাস্ততা ভেদ করেও হাওড় আমার অন্তরে ঢুকতে পেরেছিলো। আমি এখন হাওড় নিয়ে একটা শব্দ শুনলেও কান খাড়া করে শুনি। ক’দিন আগে টিভিতে সংসদের আলোচনা শুনছিলাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি জমিতে দরিদ্রদের পুনর্বাসন নিয়ে কি যেনো বলছিলেন। স্পিকার আবদুল হামিদ সাহেব তাকে থামিয়ে, তার হাওড় এলাকায় এ জন্য জমি দেবার প্রস্তাব করলেন । প্রস্তাবটা উনি আলোচনার মাঝে একটু আতকাই দিয়েছিলেন, যে জন্য হয়তো প্রধানমন্ত্রি বা অন্যরা এর সম্ভাবনাটা বোঝেনি । জলে ডুবে থাকে বলে, হাওড়ের উন্নয়নকে সবাই ডিফিকাল্ট মনে করে। কিন্তু হাওড়ের অব্যাবহৃত বিশাল জায়গা আমরা সত্যিই বহুমুখি ব্যবহার করতে পারি।

আমার এক দিনের অভিজ্ঞতার কথা বলি। মেইন্টেনেন্স টিম নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার যাবার কারন হলো তেল সাপ্লাইয়ের মেজারমেন্ট। তেল ঢালতে সময় লাগছিলো বলে আমার এসিস্টেন্টরা লাঞ্চ করার জন্য হোটেলে নিয়ে গেলো। ওটা ছিলো সাধারন গ্রাম্য একটা বাজার। হোটেল বলতে হাওড়ের পাড়ে বাশের বেড়া দেয়া একটা ঘর। গিয়ে জানলাম খাবার প্রায় শেষ, বৃষ্টি বাদলা বলে সম্ভবত তেমন রাধেই নি। মেজারমেন্ট নিয়ে একটু টেনশনে ছিলাম, তারপরেও ওখানে বসে আমার মনটা একেবারে আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আর পাশের হাওড়ের মৃদু ঢেউ আমার কাছে আদ্ভুত লেগেছে। আমরা সংখ্যায় বেশ ক’জন থাকায় হোটেলের অল্প বয়েসি ছেলেটি সব খাবারই বেড়ে দিলো। আমরা খেয়েছিলাম ছোট বাইম মাছের হলদে ঝোল, নিরামিষ অথবা ছোট তেলাপিয়া বা কই মাছ ছিলো বোধ হয় আর ছিলো শসার সালাদ। তবে যা খেয়েছি সবই ওখানে উতপাদিত;বাইরের বোধ হয় শুধু মশলাপাতি-তেল। ভাতের সাইজ ভোমা ভোমা, কিন্তু আমি দির্ঘদিন পরে তাতে ভাতের গন্ধ পেয়েছিলাম। কেমিক্যাল সারের অযাচিত ব্যাবহার ভাতের গন্ধ আমাদের ভুলিয়েই দিচ্ছে। এই সমস্যা শুধু আমাদের নয় ; বিদেশি দামি চালেও আপনি কোন ফ্লেভার পাবেন না। বাশমতির ভাত-পোলাও অনেকবার খেয়েছি।

যে ফ্লেভারের জন্য খেয়েছি, কৈ, তাতো মনেই করতে পারি না! কিন্তু ঐ ভাঙা বেড়ার হোটেলের ভাতের গন্ধ আমি আজো মনে করতে পারি সযত্নে, আহা ! আমি নিজে হাতে অর্গানিক সারের শষা ফলিয়েছি; কিন্তু ওখানকার শষার ঘ্রানের ধারে কাছেও হয়নি। অন্য মাছের কথা মনে নেই, কিন্তু ছোট ঐ বাইম মাছ আর তার ঝোলের স্বাদ ভুলবোন কোনদিন। আমি পরিবেশ আর খাবার ২ই খুব ফিল করছিলাম। কিন্তু অফিশিয়াল গাম্ভির্য রক্ষার্থে,টিমের কারো সাথে শেয়ার করছিলাম না। পাঠক মনে করতে পারেন আমি বাড়িয়ে বলছি; কিন্তু নিজেরা কখনো এমন সুযোগ পেলে এই অধমের কথা স্মরন করবেন। আমি নিশ্চিত অনুভুতি প্রবন যে কোন মানুষ আমার মতই ফিল করবেন। আর এমন ঘটনা চক্রে সুযোগ না পেলে, সুযোগ তৈরি করে হলেও বর্ষায় একবার গিয়ে ঘুরে আসুন। বাংলাদেশের অকৃত্তিম আর অদ্ভুত আরেক সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য হবে।

অফটপিক হলেও খাবার নিয়ে আরেকটু কথা বলি। আমি ওখানে খেয়ে পেটের ট্রাবল হবে ভেবেছিলাম। কারন ঢাকার কাওরান বাজারের হেড অফিসে এলে, কাছের অভিজাত হোটেল গুলোতে খেয়ে আমার সব সময় ডিসেন্ট্রি হতো। কিন্তু দেখলাম কোন সমস্যা হলো না। এর পরে আমাকে ঘটনাচক্রে রাঙামাটিতেও অমন গ্রাম্য হোটেলে খেতে হয়েছে। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখেছি, আমার পেটের ট্রাবল হতো না। আর আইবিএস নামের পেটের যে অসুখ নিয়ে গিয়েছিলাম, উল্টো সেটাও ভালো হয়েছে। কোন কিছু অবাক করলেই তা নিয়ে গবেষনা করার অভ্যেস ; তাই বিষয়টা একটু তলিয়ে দেখলাম। আসলে গ্রাম্য ঐ সব হোটেলের কিচেন সাধারনত সামনে বা পেছনে খোলা অবস্থায় থাকে। এর ফলে ওদের কিচেনে কোন ব্যাক্টেরিয়া জমে না। ঘরের ভেতরে থাকলেও, লাকড়ির চুলার গরমে তা চাল বা বেড়ার ফাঁক ফোকড় দিয়ে বেড়িয়ে যায়। আর শহরের হোটেলের কিচেন গুলো বদ্ধ হওয়ায়, সহজেই ডায়রিয়া বা ডিসেন্ট্রির জিবানু জমে। আর হাওড়ে তো শুধু আগুন-বৃষ্টি-বাতাসই নয়, বছরের দীর্ঘ একটা সময় ওখানকার সব কিছু একেবারে গঙ্গা-ধোয়া হয়ে যায়। এ জন্য ওখানকার খাবার নিরাপদ, পরিবেশও পরিচ্ছন্ন।

বাস্তবে যেমন দেশের আনাচে-কানাচে যাবার সুযোগ হয়েছে, তেমনি ভার্চুয়ালিও দেশ-বিদেশের অনেক জায়গা দেখার-চেনার সুযোগ হয়েছ। আবার পর্যটন নিয়েও বেশ খানিকটা গবেষনা করেছি। তাতে আমার কাছে কোন জায়গার অন্যতম বিষয় হিসেবে ধরা পরেছে, সেখানকার নারী। আবার মনে করবেন না, আমি সেক্স রিলেটেড আকর্ষনের কথা বলছি। সেক্সটাও পর্যটনের একটা আকর্ষন, কিন্তু সেটা ফর বোথ, মানে নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু যে কোন পরিবেশে নারীর শক্তিশালি এক প্রাকৃতিক আকর্ষন রয়েছে। মহান সেই আকর্ষনী ক্ষমতা পুরুষের নেই। সেটা সৃষ্টিকে ধারন করার শক্তি, সৃষ্টিকে লালন করার শক্তি। সাধারন একটা উদাহরন দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করি। যেমন ধরুন, নিঝুম দ্বীপ যখন প্রথম জেগে উঠেছিলো, তখন সেটা একধরনের আগ্রহের সৃষ্টি করেছিলো। আর বন বিভাগ যখন কিছু হরিন সেখানে ছেড়ে দিলো, তখন সেই দ্বীপের আবেদনটা যেমন হলো, নারী একটা পরিবেশে ঠিক তেমন। সেটা অন্য নারী, পুরুষ, পশুপাখি এমন কি গাছ-পালাকেও আলোড়িত করে। আমি জানিনা, পাঠককে সঠিক ভাবে বোঝাতে পারলাম কি না। সব জায়গায়ই সাধারন ভাবেই নারীদের দেখি বলে আমরা এটা বুঝি না।

হাওড়ের নারীদের মাঝে সেই আবেদনটা কিন্তু একটু ভিন্ন। তাদের উপস্থিতিতে প্রকৃতির পরিবর্তনটা অন্য কোন জায়গার মত নয় । আমি হাওড়ে যতবার কোন নারীর উপস্থিতি পর্যবেক্ষন করেছি, ততবার তাদের বর্নিল দ্যুতি দেখেছি। আমি এখানে পাঠককে একটা কম্পিটারিয় উদাহরন দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করবো। এম এস ওয়ার্ড বা পেইন্টে প্রধান রঙ গুলোকে বিভিন্ন মাত্রায় মিশিয়ে রঙের অসংখ্য টোন তৈরি করা যায়। আপনি ওতে কমন বেশ কিছু টোন পাবেন, যেগুলো আমরা অহরহ দেখি। আর কিছু টোন একেবারেই দুর্লভ। আপনি তৈরি করতে পারলে, চোখে পরার মতো পরিমানে আপনার ক্যানভাসে দিলে, কোন নির্দিষ্ট আকার ছাড়াই শুধু ঐ রঙটুকুই আপনাকে আলোড়িত করবে। হাওড়ের নারীরা সেই দুর্লভ রঙের টোনের মত। আমি কোন এলাকার নারীদের মাঝে সেই রঙের ছটা দেখিনি। একটি পরিবেশের বৈশিষ্ট সেখানকার মানুষকেও সেভাবেই গড়ে তোলে। হতে পারে সে জন্যই হাওড়ের নারীরাও অমন আসাধারন বৈশিষ্ট মন্ডিত।

নারীর আবেদন যেমন প্রাকৃতিক, পুরুষেরটা কিন্তু তা নয়। সম্পুর্ন সভ্যতা কেন্দ্রিক; মানুষের সাথে তার আচার ব্যাবহারের উপর নির্ভরশীল। যে কোন এলাকায় গেলে, প্রথমেই আপনাকে নির্ভর করতে হবে সেখানকার পুরুষদের উপরে। কাজেই একটি এলাকার পুরুষদের প্রকৃতির উপরে নির্ভর করে অভ্যাগতদের প্রাথমিক স্বাচ্ছন্দ। আর যে কোন বিষয়ের স্বাচ্ছন্দ নির্ভর করে তার সহজ সরলতার উপর। প্রথম পরিচয়ে আপনি যদি কারো মাঝে সারল্য পান তাহলে আপনি তার সাথে মিশতে নিরাপদ বোধ করবেন। আর যদি জটিল মানসিকতা দেখেন, তাহলে আপনার চিন্তা ভাবনার বিষয় হয়ে দাড়াবে। আর আমি প্রতিবার হাওড়ের প্রতিটি মানুষের হেল্প পেয়েছি। যে দোকান থেকে কিছু কিনেছি, সেই দোকানদার থেকে শুরু করে যাদের নিয়ে অফিসের কাজ করেছি, প্রতিটা মানুষকে যার যার অবস্থানে সহযোগিতামুলক মনোভাবের পেয়েছি; অনেকের আতিথেয়তাও পেয়েছি। হাওড়ের উপরের দীর্ঘ লঞ্চ জার্নিটা একটু রাত হলেই আর নিরাপদ নয়। কয়েকবার কাজ শেষ হতে দেরি হয়েছে। ওখানকার লোকজন আমাকে রাত থেকে আসতে বলেছে। আমার কাছে তাদের কথা নির্ভরযোগ্য মনে হতো ; মনে হতো এখানে আমি নিরাপদ। কিন্তু তারা কেউই আমার পুর্ব পরিচিত ছিলো না। আমি ফিল করতাম, আমি এখানে একা এলেও দুর্বৃত্ত ছাড়া আমার কোন ক্ষতি এখানকার সমাজের কেউ করবে না। সত্যি বলতে, আমি খুব পরিচিত কেউ না থাকলে বাংলাদেশের কোন এলাকায় গিয়ে সমাজকে এতোটা নির্ভরযোগ্য ফিল করিনি ।

আমি আরেকটা অভিজ্ঞতার কথা বলবো। আমার ছোটবেলা কাটা মফস্বল আর ঢাকার বাড়িটিও কিছুটা গৃহস্থ বাড়ির মতো খোলা মেলা। বাড়িতে কাজ জমে গেলেই আম্মা বাজার থেকে কামলা আনতে বলতেন। যদি সৌভাগ্য বশত কখনো কিশোরগঞ্জের লোক পেতাম, তাহলে মোটামুটি কাজ নিয়ে সারাদিন নিশ্চিন্তে থাকতাম। এমন স্বাচ্ছন্দ অন্য কোন জেলা বা আমাদের নিজ এলাকার মানুষের ক্ষেত্রেও দেখিনি।

হাওড় এলাকার পুরুষরা যেমন সরল আবার কিছুটা গোয়াড়ও। খেয়াল করলে এর প্রমান আপনি ওখানকার কৃতি পুরুষদের মাঝেও দেখবেন। আমাদের সংসদের স্পিকার আব্দুল হামিদ, চিত্র নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন থেকে শুরু করে জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, সত্যজিত রায়, তার পিতা সুকুমার রায় আর তার পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়ের সৃষ্টিতেও সেই সারল্য স্পষ্ট ।

তাহলে দেখুন, হাওড়ের মানুষও অবারিত ঐ প্রাকৃতির মত; হাওড়ের পানির মত টলটলে আর ছোট ছোট ঢেউ সম্বলিত। হাওড়ের প্রকৃতি সুন্দর, পুরুষ সমাজ নির্ভরযোগ্য আর নারিরা অস্তিত্বময়, জীবজগত বৈচিত্রময় আর খাবার সুস্বাদু। এবার বলুন একটা পরিবেশকে ভালো লাগার জন্য আর কি লাগে !

আমার অভিজ্ঞতা গুলি ছোট স্কেলের আর একেবারেই আড়ম্বররহীন। এগুলো থেকে শুধু ওখানকার সুন্দর সম্ভাবনাটাকে আচ করা যাবে। এই বৈশিষ্টগুলো যদি একটু যত্নের সাথে বৃহত পরিসরে তুলে ধরা যায়, তাহলে এর গ্রহনযোগ্যতা ব্যাপক। দির্ঘ দিন অকৃত্তিম পরিবেশে থেকে আমি দেখেছি, খাবার আর প্রাকৃতিক পরিবেশ জীবনের গুন গত মান কিভাবে উন্নত করে! হাওড়ের বিশেষ বৈশিষ্ট তাই আমাকে এর বৈরিতা জয় করার তাগিদ দেয়। সে জন্যই হাওড় নিয়ে আমার এই ফ্যান্টাসিয়া। খানিকটা সায়েন্স ফিকশান ধর্মি। তবে দুর ভবিষ্যতে নয়, এটা বর্তমানেই বাস্তবায়নযোগ্য। প্রকল্পটি বিশাল কোন হাওড়ে মাল্টিস্টোরিড কংক্রিটের প্ল্যাটফর্মের উপরে ছোট একটি শহর। এতে হাওড়ের জিবন ও প্রকৃতির সব বৈশিষ্ট বজায় রেখে আধুনিক বসতি গড়ে তোলা হবে। আনুপাতিক হারে স্থানীয় এবং বাইরের এমনকি বিদেশিদের থাকার ব্যবস্থা করা হবে। আর পর্যটনের ব্যাবস্থায় দেশি-বিদেশিদের বেড়াবার সুযোগ তো থাকবেই।

আমাদের দেশের সরকারের সামর্থ কম। আর যাও আছে, দেশের একশ্রেনীর মানুষ এসব ব্যায় বহুল কাজকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে। অথচ এসব প্রকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে, দেশের পর্যটন, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং জীব বৈচিত্র সংরক্ষনেও সহায়ক। মুঘল সম্রাটরা বা এশিয়া-ইউরোপের পুরনো রাজা বাদশাহদের আমল হলে ভালো হতো। ঢাকায় মুঘলদের সাথে দন্দে টিকতে না পেরে এই কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়িতেই রাজধানী গেড়েছিলেন বারো ভুঁইয়া ঈশা খাঁ। তাদের রাজত্ব এখনো থাকলে আরো সুবিধা হতো । কারন তারা নিজেদের ইচ্ছা মতন বড় বড় দুর্গ করতে পারতেন অনেক কম জবাবদিহি করে।

এই প্রকল্পের প্রধান শর্ত হলো পরিবেশ বান্ধবতা। তাই বেছে নিতে হবে যে হাওড়ে বিশেষ কোন বায়োডাইভার্সিটি নেই। এটির আকার হবে হাওড়টির সামগ্রিক আকারের সাথে সামঞ্জস্যপুর্ন । তবে আবশ্যই ২/১ বর্গ কিমির কম নয়। আবার এটি ১০/১২ তলারও বেশি হবে না। একবার চোখ বন্ধ করে দৃশ্যটা কল্পনা করুন তো ২ কিমি দৈর্ঘ আর ২ কিমি প্রস্থের ১২ তলা একটি বিল্ডিং পানির বেশ উপরে দাড়িয়ে আছে। ইটালির ভেনিস শহরটিও এমন পানির উপরেই । তবে ওখানে এমন বিশাল স্ট্রাক্চার নেই ; ছোট-বড় অনেক বিল্ডিং।

এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট গুলো হবে –

  • এটি হওড়ের পানির বেশ উপরে পিলারের উপরে গড়ে তোলা হবে । যাতে এর নিচের হাওড়ের পরিবেশটা অক্ষুন্ন থাকে । ভরা বর্ষায়ও পানি কম পক্ষে ২০/৩০ ফুট নিচে থাকবে।
  • পিলার গুলো মজবুত করে সংখ্যায় কম করা হবে । অনেকটা ঢাকার ফ্লাই ওভার বা পদ্মা-যমুনা সেতুর পিলার গুলোর মত উচু ।
  • পিলারের উচ্চতা-খরচ কমানোর জন্য পানির কম গভির এলাকা বেছে নেয়া হবে ।
  • প্রতিটি পিলারের উপরে স্থাপিত ভুমিকম্প নিরোধি এক ধরনের মুভেবল মেটাল বলের উপরে প্ল্যাট ফর্মটি বসানো হবে,ভুমিকম্পের সময়ে ঐ মেটাল বলগুলো বল-বিয়ারিঙের মত কাজ করবে। আমরা ছোট বেলায় রিক্শার বিয়ারিংকে চাকা বানিয়ে তার উপরে একটা কাঠের তক্তা বসিয়ে, বাসার সামনের রাস্তায় চালাতাম। প্রযুক্তিটা অনেকটা সেরকম, ভুমিকম্প হলে প্ল্যাটফর্মটি পিচ্ছিল মেটাল বলের উপরে ঐ তক্তা-গাড়ির মত দুলবে । এতে কাঠামোটি বড় হলেও ভুমিকম্পে সহজে ক্ষতিগ্রস্থ হবে না ।
  • এই বিশাল প্ল্যাটফর্মটিকে বেশ কিছু ভাগে ভাগ করা থাকবে । মানে নির্দিষ্ট সংখ্যক পিলারের উপরে কাঠামো গুলো স্বতন্ত্র ভাবে থাকবে । যাতে একটির ভুমিকম্পের এফেক্ট পাশের গুলোকেও ক্ষতিগ্রস্থ না করে ।
  • যদি এমন কোন জিব বৈচিত্র থাকে, যা নির্মানের সময় ক্ষতিগ্রস্থ হবে ; তাহলে তা অন্য কোথাও সরিয়ে রাখতে হবে । কাজ শেষ হলে আবার সেখানে ফিরিয়ে আনতে হবে । একটা কথা বলে রাখি সাধারনত বদ্ধ কোন ওয়াটার বডিতে কোন স্থাপনা করলেই কিন্তু সেখানকার পরিবেশ বদলায় না । বদলায় যদি সেখানে অনবরত কোন আনইউজুয়াল ট্রেসপাস হয় । কাজেই মাঝখানের কংক্রিটের ঐ পিলার গুলো হাওড়টির পরিবেশ তেমন বদলাবে না । আর বিশেষজ্ঞদের তত্বাবধানে নিচে গড়ে তোলা হবে দারুন এক জলজ বাগান । বিদেশ থেকে উপযোগি জলজ জিব-উদ্ভিদ এনেও সেখানে রাখা যাবে । আন্ডারওয়াটার ক্যামেরা, থারমোমিটারের মতো সেন্সরগুলো লাগিয়ে সেসব পর্যবেক্ষন করার ব্যাবস্থাও থাকবে।
  • রুফ টপে থাকবে বিশাল খেলার মাঠ, বাগান আর মুক্ত মঞ্চ। তাতে নিয়মিত খেলা, মেডিটেশন আর নাচ-গান-নাটকের আয়োজন হবে ।
  • এতে আরো একটি অপ্রচলিত বিশেষত্ব থাকবে । সেটা হলো বিল্ডিংটির সাইড উচু আর দীর্ঘ সাউড ওয়াল গার্ডেন । এই দেয়াল বাগানও আমারই নতুন একটা কন্সেপ্ট । এটা আলাদা একটা আর্টিকেলে ডিটেইল্স বুঝিয়ে বলবো । এছাড়াও বিশেষজ্ঞরা আরো অনেক নতুন কিছুই এতে সংযোজন করবেন ।

বর্তমানে এই ফ্যান্টাসির সবচেয়ে আলোচিত একটা প্রায়োগিক দিক সম্পর্কে বলে শেষ করি। ব্যাপক ভুমি ব্যবহার করার জন্য আড়িয়াল বিলে এয়ার পোর্ট নির্মানের বিরোধিতা করেছে অনেকে । এই সমস্যা প্রায় সবখানেই ; এমন কি হাওড়েও। কিন্তু সরকার যদি উচু মাল্টিস্টোরিড প্ল্যাটফর্ম করে এর টপ ফ্লোরে এয়ারপোর্ট তৈরি করে, তাহলে নিচে পানি থাকুক আর ধানি জমিই থাকুক, সেগুলো অক্ষতই থাকবে । আর দির্ঘ রানওয়ের নিচের ফ্লোর গুলোতে সরকার বিশাল জন বসতি, কর্মসংস্থান আর এয়ারপোর্ট ম্যানেজমেন্ট অফিসও করতে পারবে অনায়াসে । পাঠক খেয়াল করুন, রান ওয়ে আর পাশের এক্সট্রা জায়গার জন্য এয়ারপোর্টে প্রচুর জমি লাগে । প্লেনের নিরাপদ ল্যান্ডিঙের জন্য আবার পার্শবর্তি এলাকায় উচু স্থাপনা নিষিদ্ধ থাকে। কিন্তু এই রানওয়ে অনেক উঁচুতে থাকায়, আশেপাশের জায়গা তেমন নষ্ট হবে না । আবার নিচের ফ্লোরেই টার্মিনাল বানানো যাবে। অনেকের কাছেই এটা খুব ব্যায়বহুল বা অবাস্তব মনে হতে পারে। কিন্তু দেশ-বিদেশে দীর্ঘ যে সব ফ্লাইওভার হচ্ছে, সেখানে মাত্র ১০ কিলোমিটার মাল্টিস্টোরিড রানওয়ে কোন ব্যাপারই না।

আর্কিটেক্ট-ইন্জিনিয়াররা অল্প সময়েই এর ডিজাইন করে দিতে পারবে । আর সরকার পিপিপিতে প্রস্তাব করলে, এর বিনিয়োগও পাওয়া যাবে । হয়তো সারা বিশ্বে এই বিমান বন্দরই একসময় অনুকরনিয় হবে ।