মনে ধরার জায়গা গুলুর মধ্যে একটি, বিস্তৃন সবুজ।মাঝে মধ্যে কিছু বড় গাছ , দলবেঁধে কিছু বুনোঘোড়া বিশ্রাম নেয় গাছের নীচে, আসেপাশে কিছু ছোট জলাশয়।দূরে চারিদিকে কিছু পাহাড় ঘেরা উপত্যাকা।

গোটা কয়েকশত বছুরে ওয়েস্টার্ন সেলুন আর গোরস্থান। শুধুদিন দুপুরে নয় রাতে বিরাতেও জায়টিতে আমি আসি অনেক গুলু বছর ধরে।

কখনো দল বাঁধা হরিণ দেখতে কখনো মাছ ধরতে ,কখনো বা অজানা কিছুর টানে।
বড় একটি হ্রদ বাঁধের উল্টো দিকে মাছধরার জায়গাটি মোক্ষম।নীরবতা, দুইদিক দিগন্ত লাগোয়া উঁচুতৃণ ভূমি

দিন কয়েকের ভারী বৃষ্টিতে ঠাণ্ডাটি বেশ জেঁকে বসেছে আগে ভাগেই, তাপ মাত্রাটি যখন ৫০ ডিগ্রির নীচে নামে তখন মাছ কেনো উষ্ণ রক্তের কোন বন্যপ্রাণীর ও দেখা মেলেনা এলাকাটিতে।

তবুও কেনো জানি চলে আসতে ইচ্ছাহলো আজকে। যথারীতি মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়ে চলছি। হাইওয়ে থেকে নেমে যখনি ছো টগ্রামের রাস্তাটা ধরেছি মনে হয়েছে ক্যাটফিসে ধরার আধারটি আনা হয়নি। বঁড়শি আধার সামনের দোকান থেকে কিনে নিতে অসুবিধা হয়না, কিন্তু পারত পক্ষে আমি এলাকাটির দোকানপাট মাড়াইনা।

কারণ, কয়েকটি, প্রধানগুলুহলো , এলাকার মানুশজন শতভাগ বাইবেল অন্ধ স্ল্যাব হ্যামবার্গার ফ্রাইখেকো “রেডনেক”আমেরিকান , আমাদের মতো গায়ের রঙের মানুষ ওদের কাছে ভিনগ্রহের প্রাণী।

ওদের তাকানোটাই আমার কাছে বিব্রতকর এবং কিছু কিছু সময়ে ভীষণভাবে অসহনীয়।
এতদূর যখন এসেই পরেছি মাছতো ধরতেই হবে, অগ্যতা দোকানটি নেমে ক্যাটফিশ আধার নিয়ে কাউন্টারে দাঁড়াতেই, মার্কটুওয়েন আদলের ঝোলা গোঁফের লোকটি বাঁকা হাসিতে বলতে থাকলো ,

উড বেটার গো স্নোফিশিং, অলমোস্ট ফ্রিজিং.. ক্যাট(ফিশ) উডনটনিবল..
(এরচে বরং বরফ মাছ শিকারে যাও, একদম হিমাংকে, ক্যাটফিশ আধার ঠোকরাবেনা )
ঠিকই তো যে ঠাণ্ডা, বরফ মাছ শিকারি না হওয়াতে, বুড়োর কথাতে বেশী সায় দিতে পারলামনা। তবুও দোকান দরজা পেরুনোর আগে বলতে থাকলো –

হাই ওয়াটার , বিকেয়ারফুল আউট দেয়ার –
(পানিউঁচু , সাবধানে থেকো ওখানে)

এবার বললাম – থাঙ্ক্যু
হ্রদ বাঁধের বা পাশ ধরে ঢালু রাস্তাটায় বাঁক ঘুরতেই দেখলাম বিরান জনশূন্য , বাঁধের পাড়-বড়শি হাতে একজনকেও দেখা গেলোনা। নিরাশ হয়ে একটু সামনে এগুতেই চোখে পরলো এক ঝাক গাঙচিল সংসদ, শীতকালের জন্য বা অন্যকোন কারনে ওদেরকে কেন জানি সতেজ গাঙচিল মনে হচ্ছেনা।

গাড়ীর শব্দে উড়ে গিয়ে বিশালতৃণ ভূমিটির উপড়ে অদৃশ্য হলো।গাড়ী থেকে যা মোটেও বোঝা যায়নি তাহলো, বিপদ সীমার উপর দিয়ে বই ছেলেকের পানি, লেকের স্লুইস গেইটটি খুলে দেয়াতে,অসম্ভব আওয়াজে তীব্র ক্ষুরধারাতে পানি নেমে যাচ্ছে খাড়িটি ধরে ঘূর্নয়মান জলরাশির পাকে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে পাড়ের পাথরের ফাঁকফোকরের তৃণরজি।
শীতের ভারীকোট, হাতেদস্তানা , মাথায় উলের টুপি থাকা সত্যেও কনকোনে বাতাসে জমে যাওয়ার উপক্রম।তবু কেনোজানি ঠায় দাঁড়িয়ে আছি, ভাবছি সব সময়তো বড়শি ছিপ নিয়ে দাঁড়াই সৌম্য শান্ত জলের ধারে আজ নয় দেখি হ্রদের অন্যরূপ , ঢালু পাথর বেয়ে নীচে নামছি।

প্রচণ্ড পানির তোড়ে বাস্তুহারা কিছু ছোট কচ্ছপ চিংড়ি জাতিয় ক্রফিশ বেঁচে থাকার প্রাণান্তর চেষ্টায় দিশেহারা আমি তখন যা ভাবছি , তাহলো কিসের জন্য আমি একাকী ঠায় দাঁড়িয়ে আছি !

যদি কেউ এসে আমার অনেক স্বাধের অফরোড বাহন (পঙ্খিরাজ) র্যাং লার জীপটি নিয়ে আমাকে আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে খাড়িতে ফেলে দেয়! ঘড়ঘড় শব্দে চৈতন্যে ছেদ পড়লো, নীচ থেকেই তাকিয়ে দেখলাম হ্রদ বাঁধের ঢালু রাস্তা ধরে নেমে আসছে একটি বেশ ভাঙ্গাচুরা জংধরা লাল রঙাট্রাক , হয়তো বন সম্পদ রক্ষীহয়ে থাকবে , আশ্বস্তহলাম, অনেকক্ষণ পরে হলেও জনমানবের আগমন।আবার এ ও ভাবতে লাগলাম- লালরঙা এন্টিকট্রাক, চালকটি যদি আবার লাল গর্দানের ( রেডনেক ) হয়! কি করবো এ নির্জন স্থানে।বিপদ বিভ্রাটে যে সেলফোন ব্যবহার করবো সে জো’টিও নেই।

জায়গাটিতে পাহাড়, পাথর শুষে নেয় সেল সিগন্যাল শূন্যের কোঠায়।
যতক্ষণে আমি খাড়া পাথর ভেঙ্গে বাঁধে উঠেছি ততক্ষণে লাল ট্রাকটিও থেমেছে, কিন্তু সচরাচর গাড়ী পার্কিং স্পটে নয় , খানিকটা দূরে তৃণভূমি মুখী দিকটায়। আমি গাড়ীতে বসে দেখছি লোকটি দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে আসছে , কাঁধ অব্দি ঝাঁকড়া চুল এ দিব্যি শীতেও টিশার্ট জিন্স পায়ে ভারীবুট, ভেবে নিচ্ছি আত্মো রক্ষার্থে আমার প্রাকপরিকল্পনা!
কিন্তুনা, লোকটি তড়িঘড়ি তে হেঁটে গেলো সরাসরি গাংচিল সংসদ স্থান টিতে-বেশ কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো , আমি গাড়ী চালুকরে রওয়ানা হয়েছি, ততক্ষণে সেও তার ট্রাক অভিমুখী আমি তখন তার ট্রাকের পাশ ঘেঁষে যাচ্ছি, মাথা থেকে কিছু অযাচিত ভাবনাদূর করার জন্য কি ভেবে জানালার কাঁচ নামিয়ে জিজ্ঞাস করলাম –

এক্সকিউজমি, ডু ইউ ওয়ার্ক ফর দ্য কঞ্জারভেশন ডিপার্টমেন্ট
(তুমি কি মাছ এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্মী) !

প্রথমবারের মত দেখলাম পিটপিটে তীঘ্ন দুটো কোটরা গত চোখে বেশ বুদ্ধিদপতা ,তামাটে চেহারা বেশ পোড় খাওয়া। হেসে ও বলল –
-নো, ক্যান আই হেল্প ইউ উইথ অ্যানিথিং !
(না, তোমাকে কি কিছুতে সাহায্য করতে পারি )
ওর হাসিটি বেশ প্রফুল্লিত , লোকটি সম্বন্ধে এতক্ষণ যত দুশ্চিন্তা ছিলো , কোথায় যেন নিমিষে মিলিয়ে যেতে থাকলো।বল্লাম

থট ইউ আর আ লোকাল হেয়ার, ডু ইউ নো আইডিয়াল টেম্পারেচার টু ফিশ ইন দিস লেক !
(ভাবছিলাম তুমি এখানের স্থানীয়, তুমি কি জানো এই লেকে মাছধরার উপযোগী তাপমাত্রা ! ) আবারও হাসি দিয়ে বল্লো –
মে আই আস্ক ইফ ইউ আর এ বাংলাদেশি!
(আমি কি জানতে পারি তুমি কি বাংলাদেশী )

রীতিমত ভ্যবাচ্যাকা খেয়েই জিজ্ঞাস করলাম

হাও ডুই উ নো !!
(কি করে জানো )
জবাব না দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস বর্ণনা করে বলতে থাকলো

মডারেট মুসলিম কান্ট্রি !
(বাকি কথোপকোথন টুকু বাঙলাতে লিখি )

-তুমি কি মুসলিম! কোরআনপড় !
কেনো জানি শঙ্কিত হতে থাকলাম ভীষণভাবে , বলি

মুসলিম এবং কোরআন পড়েছি।

বাইবেল পড়েছো!

পড়েছি
-তুমি কি প্রাথনায় বিশ্বাস করো

কিছু কিছু,

আমি কি তোমার জন্য প্রাথনা করতে পারি !
-অবশ্যই পারো
আমি তখনো ড্রাইভার সীটে বসা, স্বভাবতই নানা কারনে মাথায় অনেক কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে ইতিমধ্যে।

তোমার হাতটি একটু বাড়িয়ে দাও
বাড়িয়ে দিলাম – ও নীচে দাঁড়িয়ে থেকে আমার হাতটি ধরে বলতে থাকলো

ঈশ্বর, আমার বাংলাদেশি ভাইকে এমনি ভাবে সুস্থ রেখে শ্বাপদসংকুল বিপদআপদ থেকে রক্ষা করে তোমার মুক্তস্বাধীন অবারিত ভূমিতে বিচরণ করতে দিয়ো, ভাইটিকে জানান দিয়ে দাও এই লেকে মাছ ধরার যুতসই তাপমাত্রা আর পাখা মেলে উড়তে দিয়ো অবারিত দিগন্তে গাংচিলদের সাথে, আমীন।

আমার হাতখানি দ্রুত ছেড়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে তৃণ ভূমির গাংচিল পানে হাঁটতে লাগলো, আমি ওবাঁধের উঁচু রাস্তায় উঠে ফিরে তাকালাম গাড়ীর পেছন আয়নায় , লালট্রাকটি ঠায় দাঁড়িয়ে।

লং ড্রাইভ শেষে বাসায় ফিরে টিভি‘র সান্ধ্য সংবাদের ব্রেকিং নিউজ –
“ কুড়ি বছর আগে হিলসডেল লেকে ড্রাইভার সহ নিমজ্জিত ট্রাকটির সন্ধান মিলেছে “