পরিবারে দাদু, বাবা, ফুপু উনারা অনেক পড়তেন, তাই বাড়ীতে বই পড়াটা ছিলো পারিবারিক রেওয়াজ। বয়সের মাপকাঠিতে পঠিত হতো বিভিন্ন বই। মেয়েরা পড়তেন “বেগম” কেউ আবার নীহাররঞ্জন গুপ্ত, কেউ বা রবীন্দ্রনাথ এর “গল্পগুচ্ছ”, “বিষাদ সিন্ধু” পড়ে আবার কেউবা কেঁদে কেটে হতেন জারে জার। ফুফাতো বোন দের দেখতাম লুকিয়ে লুকিয়ে পরতেন রোমানা আফাজ। আমার লিষ্টে ছিলো ঠাকুর মা’এর ঝুলি, আরব্য উপন্যাস, পারস্য উপন্যাস। হাওর পারে আমার জন্ম, হিন্দু প্রতিবেশী, খোল কর্তালের আওয়াজ, এক ঘাটে নারী পুরষের স্নান, ঈদ রোজা , পুজা কীর্তন পার্বন, হিন্দু জমিদার দের পরো বাড়ীর আঙ্গিনায় কানা মাছি, গোল্লাঝুট বৌ , জামাই, মুক্তিযুদ্ধ খেলে আমার বেড়ে উঠা।

শৈশব ছেড়ে আমি তখন কৈশরে। প্রাইমারী স্কুল ঘেঁসে ছিলো কোন কালে ফেলে যাওয়া হিন্দু জমিদার দের “কাল ভৈরবের মন্দির” এ মন্দির নিয়ে অসম্ভব কিছু গল্প প্রচলিত ছিলো। বর্ষা মৌশুমে মন্দির ঘরটা পানিতে প্রায় অর্ধেক ডুবে যেতো ।এটার ভিতর ছিলো একটা দেবীর মূর্তী। বেশ পুরানো ধাচের, গায়ের রঙ কালো। একটা চোখে গর্ত। নাকটা ভাংগা। একাটা হাত বাহুর নীচ থেকে নেই। তবুও মুখটা বেশ মায়াবী। শুষ্ক মৌশুমে এই কাল ভৈরব মন্দিরে অনেক কষ্টে সৃষ্টে নিয়মিত ভোগ দিতেন কোন বৃষ্টিভরা গভীর রাতে খুন হয়ে যাওয়া গনিতের শিক্ষক শিশির বাবুর চীর রুগ্না কাঠী দেহী আমার দাদীর বয়সি বিধবা স্ত্রী। মন্দিরে দেয়া “ভোগ” চুরি করে খাওয়া ছিলো আমার নিত্যদিনের অভ্যাস। কেনো জানি না- টিফিনের ঘন্টা বাজলেই আমি ঐ মন্দিরের সামনে কড়জোরে হাজির হতাম, যেনো তেনো একটা প্রনাম ঢুকে বলতাম “মাফ করবেন, আপনার খাবার গুলি আমি খাবো, অনুগ্রহ করে গালি/বর দেবেন না”।

দেবী আমাকে মাফ করলেও দাদীর বয়সের শিশির বাবুর বিধবা স্ত্রী বেপারটা বুঝে ওনার গুষ্টি সুদ্ধ গালা গাল থেকে আমি মাফ পাইনি; ওনার গালা গাল টা আমাকে কেনো জানি “ভোগ” চুরিতে উতসাহিত করতো বহুগুনে। হাই স্কুলের গন্ডিতে পা দিয়েই আমি যখন শরত বাবুকে পড়ে পড়ে আমার হ্রদ মন্দিরে বসিয়ে নিজকে শত ভাগ শ্রীকান্ত ভেবে কিছু ইন্দ্রনাথ জুটিয়ে কখনো মাছ চুরি, কখনো অন্নদা দিদি দের কাষ্ঠকর্মে রিতীমত অংশ গ্রহন, ফুটবলের দলে ঝগড়া বিবাদ করে পিঠে ছাতা ভাংভাংগির পর্বে ব্যাস্ত্‌, হাওর পাড়ে আমার বিভিন্ন দুঃস্কর্মের ভয়াবহতার আশংকাতে পারিবারিক সিদ্ধান্তে আমাকে বসতে হলো ময়মনসিংহ জেলা স্কুলের ভর্তী পরীক্ষা তে। আমার নতুন চারন ভূমি- ময়মনসিংহ। ফুফাতো বড় ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে- যিনি তখন অনার্সে ভালো ফল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাষ্টার্সের জন্য বড় বড় ইংরেজী ভল্যূয়ুম এর বই পত্র বগল দাবা করে বা সাইকেল ঠেঙ্গিয়ে কলেজে যান, আর মধ্যরাতাব্দি পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদের বিদ্ঘুটে সব লেটিন নাম আত্মস্থ করাতে মরিয়া থাকেন, তার মুখে উনার বন্ধুদের মাঝে বলতে শুনি “নন্দিত নরকে” দারুন সুখপাঠ্য। যদিও ইতিমধ্যে আমি নতুন স্কুলের বেক বেঞ্চার হয়ে পাঠ্যবইয়ের ভেতরে সুনিপুণে মাসুদ রানা, শামসুদ্দিন নওয়াব, রকিব হাসানের,জুল ভার্ন,এইচ জি ওয়েলেস ছারাও “ইচড়ে পাকা” জাতিয় বই ও পড়ে ফেলাতে রিতীমতো অভ্যস্ত। “ওটা বড়দের জিনিষ”- একথাটা শুনার ভয়ে সে সময়ে“নন্দিত নরকে” এর কথা জিজ্ঞাস করবো দূরে থাক, আশে পাশেও যেতে পারিনি।

কয়েক বছর পর এক সময়ে ছুটিতে বাড়ি, হাতে এলো “দেবী”- অনেক রাতে পড়ছি মশারীর নীচে। কি অদ্ভুত!! বইটার প্রত্যেক টা পাতা যেনো আমাকে রুদ্ধশ্বাসে নিয়ে যেতে থাকলো পুকুর পারে, কাল ভৈরবের মন্দিরে, এই তো ! একচোখের মায়াবী চেহারা মূর্তী টা লকলকে লাল জিহ্বা টা বেড় করে দৌড়ে আসছে আমার পেছনে, পিছু পিছু বিরাট একটা খর্গ হাতে শিশির বাবুর চীর রুগ্না কাঠী দেহী বিধবা স্ত্রী ফোকলা দাঁতে হাসছেন। নদীর পারের শ্মসান ঘাটের পাকের পানিতে আমি ডুবে যাচ্ছি! ডুব সাঁতারে দেবী টা আমাকে ধাওয়া করছে। মধ্যরাতে আমি ঘামছি অবিরাম। এক সময়ে চোখ দুটো বন্ধ করে মশারির নীচ থেকে “দেবী” বইটা আমি খাটের নীচে ছুড়ে দিয়েছিলাম। দিনের বেলাতে খাটের নীচে তাকিয়ে দেখতাম, উঠাই নি প্রায় সপ্তাহ দু’এক। “দেবী” প্রচ্ছেদে যে ছবিটা ছিলো, সেটা দেখতে হুবুহু একদম কাল ভৈরবের দেবীর মতো!!!- দেবী পড়ে শেষ করার পর একদিন ভোরবেলাতে সেই যে কাল ভৈরবের মন্দিরের দেবীর আছে মাফ চেয়ে এসেছিলাম সে দিন থেকে আর ভোগ চুরি করে খাইনি।

হুমায়ূন আহমেদের অনেক লিখা আমি পড়েছি। শুনতাম উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা শিক্ষক। মনে মনে কল্পনা করতাম, মনে হয় দেখতে উনি মিসির আলী এবং হিমুর সঙ্করায়নে এমন একজন হবেন যিনি হয়তো নিজে নিজে রমনা পার্কের গাছগুলুর সাথে লুকোচুরি খেলছেন অথবা ফুলার রোড ধরে হাটছেন আর “পি” , ‘পি” করে কাল্পনিক বাশী বাজিয়ে গ্রীস্মের খরতপ্ত দুপুরে যানবাহনের গতি পথ নিয়ন্ত্রন করেছেন নিজের খেয়ালখুশী মতো। ততদিনে আমার ভাই শহীদুল্লাহ হলে থাকেন, হুমায়ূন আহমেদের সাথে সাক্ষাৎ বাসনার কথা ভাইকে প্রকাশ করে ব্যর্থ হয়েছি।

বারে বারে ভেবেছি যে মানুস টা লেখনি তে পাঠক কে শুধু কল্পনাতেই নয়, মানুসের ষষ্ঠ ঈন্দ্রীয় কে জাগ্রত করতে পারেন অপূর্ব কায়দাতে, মনুশ্য ঈন্দ্রীয়ের মাঝে ব্যাপক গোলযোগ বাধিয়ে একটা তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে পাঠকের চক্ষুস্মান জাগতিক বুহ্য বলয় কে নিমিষে এ ফোঁড় ও ফোঁড় করে নিয়ে যেতে পারেন যেখানে গল্পের গন্ধ বর্ন স্বাদ সমেত এক দারুন অবস্থানে, কখনো অতিপ্রাকৃত কখনো বা জাগতিক, প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপট। ঊনার সাথে আমার দেখা তো হতেই হবে।
আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্রাড পড়ি সে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট ছাত্র ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এক ডাকসাইটে ছাত্র যার সুবাদে সামনা সামনি দেখা হয় এই ক্ষনজন্মা লেখকের সাথে কোন এক তুষার ঝড়া সন্ধ্যাতে। তখন শুধু বলেছিলাম “স্যার, আপনার দেবী অসাধারন” উনি মুচকি হেসেছিলেন। জিজ্ঞাস করেছিলেন কি বিষয়ে পড়ি। ওই পর্যন্তই।

উনার সৃষ্ট অদ্ভুত চরিত্রগুলুর সার্থক রুপের দেখা পেয়েছি- নিউ ইয়র্কের রাস্তায়, কখনো ক্যানসাসের কুখ্যাত ফেডারেল কারাগার লেভেনোয়ার্থ থেকে ৩০ বছর পর মুক্তি পাওয়া আধ পাগল কিংকর্তব্যবিমূড় লোকটার ভ্যাবাচ্যাকা মার্কা চেহারটায়। ফ্লোরিডার উপকূলে কোন মধ্যদুপুরে কিউবা মুখী হয়ে দারিয়ে থেকে বিড়বিড় করে কথা বলা উশকো খুশকো লোকটার মাঝে। কখনো চরিত্র গুলো কে অচেনা মনে হয়নি। বরঞ্চ মনে হয়েছে, অতি পূর্ব পরিচিত।

আবার দেখা মেলেছে ধনূ নদীর বাকে একাকী দোতারা বাজিয়ে ঘুরে বেড়ানো বেসুরো লোকটায় , আলোছায়াতে রাস্তার ধারের গোরস্থানে চান্নীপশর রাতে লাশের গা থেকে কাফনের কাপড় টা খুলে নিয়ে নিজের গায়ে আজানুলম্বিত ভাবে জড়িয়ে মানুশ কে ভয় দেখানো “মামু পাগলার” মাঝে।

জিবনের এক পর্যায়ে এই গল্প কারীগর এর সাথে আমার দেখা হওয়ার এবং কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছিলো, সেটা সময়ে একদিন লিখবো। অনেকেই বলেন হুমায়ূন আহমেদ তো আপনাদের এলাকার লোক, আমি বলি, হুমায়ূন আহমেদ সমগ্র বাংলাদেশের। আমি হাওরের সন্তান। আমি শুধু এতটুকুই জানি, ভাটির দ্যাশ কে যিনি তুলে এনেছেন উনার গল্প, উপন্যাস, নাটক চলচ্চিত্রে- সুখী নীলগঞ্জের চরিত্র গুলুকে জীবিত করে তুলেছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভুমিকায়। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জের অবহেলিত বিস্তৃন ভাটির এলাকার মানুষের মুখ নিঃসৃত আঞ্চলিক ভাষা কে তুলে এনেছেন উনার লেখনীতে। ভাটির সোনার কইন্যাকে আষাড় মাসের ভাসা পানিতে ব্যক্ত করিয়েছেন বাংগালী নারীর চিরায়িত অব্যাক্ত বেদনা বিধুর গাথা।

ভাদ্রমাসের ভরা পুর্নিমাতে হাওরের স্বচ্ছ পানিতে কেওরালী গুল্মের নৃত্যে যিনি হতেন মাতোয়ারা, হারিয়ে যেতে বসা দরদি কন্ঠের বাউল গানে যিনি হতেন আবেগ আপ্লুত- সেই গল্পকারীগর জনাব হুমায়ুন আহামেদ, আপনি বেচে থাকবেন আপানার সৃষ্ট অমর চরিত্র গুলূর মাঝে আপনার প্রিয় ডাকোটার সেই হোটেলে অথবা ঝলমলে রৌদ্রের নীচে নিউইয়র্কের রাস্তায়। আপনি বেচে থাকবেন হাওরের নির্মল পুবালী বাতাসে, চান্নী পসরে গ্রামের “বাউলা গানের” আসরে – অনেক রাতে আধো আধো ঘুম জড়ানো “গাতকের” উদাত্ত কন্ঠে। ভাটি অঞ্চলে- হাওরের সোনার কইন্ন্যার দেশে। আপনি অনেক ভালো থাকুন, চান্নি পসরের গল্পকারিগর ।