জেলেদের নৌকা হেলে দুলে চষে বেড়াচ্ছে নদীতলদেশ।  জালটার আসে পাশে অতি ঘন ঘন ডিগবাজী দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছে গোটা কয়েক  শুশুক।  হটাত  করেই নদীর ও পার টা ভাঙতে শুরু করেছে প্রচণ্ড খারা হয়ে গেছে নদীর কাছাড় (পার) ।  পড়ন্ত  দুপুরে  ঝপাৎ ঝপাৎ করে ভাংছে  দইর, শুনশান নদীর পারে দইর ভাঙ্গার আওয়াজটা কেমন জেন অসম্ভব আস্বাভাবিক শব্দ করছে, পার ভাঙ্গা মাটি পানিতে যতবার শব্দ করে পরছে  ভুল্লা দৌড়ে  গিয়ে পানির দিকে তাকিয়ে ঘেঊ ঘেউ করছে অযথাই।

সুবিধার মত ঢাল খুঁ জছি  নীচে নামার জন্য। আমার স্নানের সাথী সুমন্ত  জলে নামায় ইতস্তত বোধ করছে। বারে বারে পারে  দাঁড়িয়ে আমাকে সতর্ক করছে – আশঙ্কা  ধপাস করে দইর ভাঙ্গা আমার উপড়ে পরলে দাফন এবং সলিল সমাধী  দুটোই সমপাদিত  হবে একই সাথে ।

ইতিমধ্যে আমার স্নান সঙ্গী সুমন্ত  কাছার ঘেশে নেমে গেছে নীচে, তীব্র স্রোতে ঘুর্নমান  স্রোত  কুণ্ডলী তে তলিয়ে যাচ্ছে আবর্জনা।   অন্তত ১০-১৫ ফিট  উচু খারা নদীর পারে সূর্য আলোকের  বিপরতে বসে থাকা ভুল্লার সিলহোউট দেখা যাচ্ছে। কোনভাবে ডুবটা দিয়ে যেইমাত্র মাটির কার্নিশে  উঠে  দাঁড়িয়েছি  ভুল্লার ছায়া মু র্তির পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে গলায় ঝুলানো দোতারা সমেত আরেক দু’পায়ের  ছায়া মুর্তী । ভুল্লা বসেই বসেই লোকটা কে ভীষন শাসাচ্ছে। লোকটা প্রানপনে দ্রুতপা’য়ে হেটে যাচ্ছে।

যেনো তেনো ভাবে, কাপড় বদলিয়ে পিছু নিলাম গাতকের । হটাত করে উদিত হওয়া পিছু নেয়া আমাদেরকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে ভ্যবাচ্যাকা চেহারায় হাটার গতি বাড়িয়ে দিলো গাতক । ভুল্লুও চলার গতিও প্রায় দৌড়ের কাছাকাছি।  দোতারা বেচারা প্রান নিয়ে দৌড় এর উপক্রম। দোতারা ভাই দৌড় দিলে ভূল্লা যে কিভাবে লোকটা  লুঙ্গী ছাড়া করবে তা ভেবে ডাকলাম-

-ও ভাই- দৌড় দিয়েন না-
ফিরে তাকালেন- এই প্রথমবারের মতো  লোকটার চেহারা দেখা  গেলো

ভদ্রলোক ঘাড় ঘু ড়িয়ে আমাদের দাড়ি, গুম্ফ সম্বলিত অবয়বের দ্রুত একটা স্ন্যাপশট নিয়ে নেয়  । আমি তখন ভুল্লা কে বেশ শাসচ্ছি।  লোকটা মধ্যম গতিতে চলছে। আশে পাশে  কেউ নেই।  কাধে ঝু লানো ঝুলা ব্যাগ বেশ ভুষা  আর  হাটু অব্দি পা’ দুটো  শুকনো কাদামাটির ছাপ ছোপরে জানিয়ে দেয়,  নদীর পাড় ঘেসে  হেটে চলা এ  “গাতকের দীর্ঘ পদযাত্রা।

ভুল্লা এখন সবার আগে, আমি আর সুমন্ত নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছি-

 -লোকটা মনে হয় ভালো গায়-
– আরে রাখো, গলায় একটা দুতরা লটকাইলেই ভালা গাতক! জবাব দেয় দেয় আমার বন্ধুটি
-না, তা ঠিক না, তবে এই বেলা ভাটিতে নদীর পাড় ধরে হাটা তো যেনো তেনো বাউলের কাজ নয়, পালটা জবাব দেই আমি।
-জিগাইতাম আমি, বলে উঠে সুমন্ত।

আমাদের কানাকানি’তে  বারে বারে ঘাড় ঘু রিয়ে তাকাচ্ছে গাতক।  মারত্মক ভয়ার্ত চেহারা।  শুকিয়ে যাওয়া  ঠোট দুটো ফ্যকাশে জিহবাতে  ভিজিয়ে নিচ্ছে বারে বার ।  ভুল্লু কিছু দুর  দৌরে  গিয়ে রাস্তা আগলিয়ে বসে থাকছে আমাদের অপেক্ষা তে। শুধু ভুল্লুর ভয়েই লোকটা দৌড় দিচ্ছে না।
এই পড়ন্ত বেলায় লোকটা কই বা  যেতে পারে।  গ্রামের আশে পাশে বাউলা গানের আসর হবে বলেও  তো জানা নেই।

-হয় আজমিরীগঞ্জ নতুবা জয়সিদ্ধি

 কারন সন্ধ্যাব্দি হেটে যাওয়ায় এদুটো ছাড়া আর গন্তব্য স্থল হতে পারে না। আর ভাটি অঞ্চলে সাধারনতঃ “বায়না” (চুক্তিবদ্ধ) গায়করা শেষ বেলাতে গিয়ে রাতের আসর করে অনেক কম। অনেক কিছুই ভাবছি লোকটা সমন্ধে। আমাকে বারে বারে ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখে নিচ্ছে  বারংবার হেতু হয়তো- দাড়ি গোঁফের পাশাপাশি আমার এলোমেলো ফকিরালী কেশরাজী বেচারার মনে শংকা সৃষ্টি করেছে দ্বিগুন।

লোকটার কোন মোবাইল নাম্বার আছে কিনা জানতে পারো- জিজ্ঞাস করলাম সুমন্ত কে

জিজ্ঞাস করছি- বলেই হাটার গতি বাড়লো ও । কোথা দেখে যেনো ভেসে আসছে পুরানো বাউল গানের সুর “নিরীখ বান্ধোরে দুই নয়নে, ভুইলো না মন তাহারে…” নিমিষে ফতুয়া পাঞ্জাবীর ডান পকেটা’ টা গলা টিপে শ্বাসঃরুদ্ধ করার মতো নির্মম ভাবে চেপে ধরে, হাটার গতি বাড়িয়ে দেয় গাতক। ভুল্লা গানের উৎস সন্ধানে খেপেছে ভীষন।  ভুল্লুর কোন অঘটন ঘটায় ভাবনাতে আমরা দুজনই গতি বাড়িয়ে গাতক এর পাশাপাশি-

আপনার কি মোবাইল আছে? জিজ্ঞাস করে  সুমন্ত
ভীষন ক্লান্ত, পাংশুটে শুকনো কণ্ঠনালী থেকে কাঁদো কাদো স্বরে জাবাব আসে-

– কেরে ভাই!
-ডরাইন না যে ভাই আমরা আপনার মোবাইল নিতাম না

আফনের যে রিং টোন বাজতেছে  সেইটাতে  ভুল্লা চেতছে।

রিংটোন বেজেই  চলে, লোকটা অজানা অপরাধ প্রবণতায় প্রাণপণে ডান পকেটটা চেপে ধরে কাঁদো কাঁদো চোখে তাকিয়ে থাকে ভুল্লূর ঘেউ ঘেউ মুখের  দিকে।  দু’ কদম বাড়িয়ে  ওদের সাথে, বলি –

– অবেলায় কই যাবেন !
– আমীরগঞ্জ পার হইয়া
– কোন বায়না আছে ?
-না বাইছাব

চোখের পানি টলমল করছে,  বলে –
বাইছাব, আমি গানবাজনার লোক না, বেসুরো গলায় এই  দোতারা মানায় না। গান বাজনা মোটেও জানি না।
-তা হলে গলায়  ঝুলাইয়া ঘুরেন ক্যান।
প্রসঙ্গ এড়িয়ে বাষ্পরুদ্ধ ধরা গলায় বলে যেতে থাকে
– ভাইছাব,  একটু  তরাতরি হাডি (হাঁটি) অনেক দুরার পথ, হাইঞ্জা র ( সন্ধ্যা ) সাথে  সাথে  যদি   মৃগা  পাড় হইতাম পারি । টর্চ লাইট এর ব্যাটারিও বড়ই দুর্বল। এলেকার লোকজন মোবাইলে জানাইছে ,  গেরামে আসলে কিছু  সাহায্য  ঊগাইয়া  (তূলে) দিবো।
আমরা কথা বলতে বলতে ততক্ষণে  আমাদের বাড়ীর কাছাকাছি।  সাহস করেই বলে ফেলি

-যাবেনই  যখন আমাদের সাথে বসে কি চারটা ভাত খেয়ে যাবেন !
চোখে  মুখে  বিরাট  কৃতজ্ঞতার হাসি খেলে যায় গাতকের
-থাকুক  ভাইছাব আফনেরারা আবার বিরক্ত …  মুখ  থেকে কথা কেড়ে নিয়ে সুমন্ত বলে উঠে
-ধুর মিয়া, বিরক্ত অইলে কি আর জিগাইনি, চলেন-

বাড়িতে আমাদের গান বাজনার ঘরে  গাতক কে বসতে দেই। ঘর ভর্তি  সব বাদ্যযন্ত্র দেখে গাতককের চোখ ছানাবড়া হয়।  নিমিষে গাতকে র পালটে  যায়  মুখ বয়ব ।  খেতে  খেতে  কথা হয় শীতলং শাহ্‌ , দূরবীন শাহ্‌, আজিম ফকির রাধারমনের গান নিয়ে অল্প সময়েই গাতক হয়ে উঠে আমার স্বগণ। লোকটি আমার কাছে তাঁর  শিল্পী  স্বত্বার পরিচয় টি  লুকিয়ে রাখলে ও আমি বেশ বুঝে যাই  আমাদের ভাটি এলাকার লোকজ সঙ্গীতের উপর তাঁর জ্ঞানের অগাধ পরিধি।  জানতে চাই-

 – মনে  কিছু  না  করলে বলবেন কি, কি সাহায্যের জন্য এতো তাড়াহুড়া করে অবেলায় নিজ  গ্রামে যাচ্ছেন-
-বাইছাব, যদি গাঙের পারে আমারে এই কথাগুলি  জিগাইতেন  তবে  উত্তর দিতাম না।  আপনাদের চেহারা ছবি, ভাবসাবে তো মনে করছিলাম আপনারা  আমার  মোবাইল টাকা পয়সা নিয়া দিন দুপুরে আমার চৌদ্দটা বাজাইয়া দিবাইন। মনের আর গানের যখন এতই মিল হইলো   মনের  কথা গুলু  না কইলে যে সারাটা পথ শান্তি পাইতাম  না ।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে থাকে গাতক –

ছেলেটা আমার কাছ থাইক্যা বাউলা,  মু র্শিদী গান শিখছিলো ছোটবেলা। আমি দোতারাটাও শিহানোর চেষ্টা করছিলাম পারে নাই-  একদিন একটা সারিন্দা নিয়া হাজির অনেক ঘষাঘষির   পরে  কি যে  সুন্দর  বাজাইত আমার বা’জান।  রাইত নিশীথে বিচ্ছেদ গানের লগে সারিন্দাটা কাঁচা  বাছুরের  লাহান বেম্রাইতো (আওয়াজ) করতো।  সুরে আর বাজনাতে লোকজন পাগল  হইয়া যাইতো।    চারিদিকে নাম ছড়াইয়া পরলো ওর।  মাজার,  ওরশ এ বায়নায় গাইতে লাগলো।  আমরারে না জানয়া ভালোবাইসা বিয়াটাও কইরা ফালাইলো।   কিন্তু   ওর  সুখ  বেশি দিন সইল না বাইছাব-

উদ্গ্রীবতায় জিজ্ঞাস করলাম

– কি হলো !

একদিন ভোর সকালে বায়না গাইয়া ফিরার পথে  গুলশান নতুন বাজার রাস্তা পার হইতে গিয়া একটা বাস আমার বাজানেরে ধাক্কা দিয়া চইলা গেলো, লোকজন মেডিক্যাল এ নিয়া যায়, একটা বছর এই হাসপাতাল ঐ  হাসপাতাল  চিকিৎসাতেও কোন ফল  হইলো না । আমার জায়গা জমি সঞ্চয়  ওর চিকিৎসায়  সব শেষ। জীবনে ভিক্ষা করতে শিখি নাই, দোতারা  বাজানো টা শিখছিলাম। গলায় আবার ঝুলাইছি , শহর বন্দরের রাস্তায় রাস্তায় গান গাই, যা পাই আমার বাজানের চিকিৎসায় চালাই। ডাক্তার সাহেব বলছেন মেরুদণ্ড নষ্ট হয়া  গেছে।  বিছানাতেই কাটবো  বাকীটা জীবন। মাস দুয়েক আগে  ওর বউটাও চইল্ল্যা গেছে বাপের বাড়ী। আমি আশা ছাড়ি নাই।  আফনেরা গান বাজনা’র  বড়ই  ভা বুক  মনের মা নুষ।  ভক্ত ভাবের মানু ষ  এর  আশীর্বাদ  নাকি অনেক কাজের হয়। আমার বাজানের জন্য একটু আশির্বাদ চাই।।

গাতকের বেনিয়াম গেঞ্জির বুক‘টা  তখন চোখের জলে একাকার ।  বুকে জড়িয়ে খানিকটা স্বান্তনা দিয়ে বলতে থাকি-

– বেলা তো প্রায় শেষ আজ রাত’টা কি আমাদের সাথে থেকে ভোর সকালে যাবেন।
সাথে সাথে বলে উঠে-
-আপনাদের বাড়ীর মঞ্চ’টা অনেক মনে ধরছে, আইজ রাইতে দুই চারটা গান যে এই মঞ্চে গাইতেই হয়।

রাতে গানের আসর এর আয়োজন করি, যথারীতি পাড়া প্রতিবেশী লোকজন জড়ো হতে থাকে, গাতক কে সঙ্গত করার জন্য মঞ্চে ডুগডুগ’টি  নিয়ে পাশে বসে ফিসফিসিয়ে বলি,  আপনার অসুস্থ ছেলের কথা কি দর্শক দের কিছু  জানাবো , সাথে আমার হাত দুটো চেপে ধরে বলতে থাকে-

– বাইছাব, আইজ্জ্যা (আজকে) রাতে ,আফনাদের  দর্শক শ্রোতা’গো কোন মন খারাপের কথা বলবো না।
দখিনা বাতাসে বাড়ী উঠানের  কামিনী  ফুলের  মৌ মৌ গন্ধ আর অদ্ভুত জোছনায় – উদাত্ত  গলায় “গাতক” গেয়ে উঠে –

হায়রে পাগল মন বিচার কইরা চাও-
যতনও  করিয়া ধরো  মু র্শিদেরও  পা’ও.
ক্ষণে মন সাধুভক্ত,  ক্ষণে  মন চোর –
চৌদ্দ ভুবনের রা জা   বচনের ঠাকুর।
আমার মন মজো রে ও’রে রঙ্গিলার চরণে মন মজো….