বাবলু ভঞ্জ চৌধুরী

তককো বেশ উৎসাহ নিয়ে বলতে থাকে। গুছিয়ে বলার চেষ্টা করে। স্মরণ করে করে বলে।

‘বুঝলি, একবার খুব বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম। জষ্টি মাসের শেষ। ভীষণ গরম। ঢাকা শহরের পিচের রাস্তায় ডিম ভেঙে দিলে মামলেট হয়ে যাবে-এতো গরম।’

ফককো কী একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তককোর মুখের ভাব দেখে গুলিয়ে গেল।

‘মনোযোগ দিয়ে শুনবি ঘটনাটা বুঝলি?’
‘জ্বি ভাই!’

তককো বলতে থাকে- একবার সে ধানমন্ডির এক রাস্তায় হাঁটছিল। দুপুরবেলা। গরম আর যানজটে অতিষ্ঠ মানুষ। রাস্তার পাশে ছিল এক ডায়াগনস্টিক সেন্টার। প্রচুর ভিড় সেখানে। তককোর পেটের পরিবর্তে পা জ্বলছিল। কারণ পায়ে কোনো জুতো নেই। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কাঁচঘেরা দেওয়ালের ভেতরে অসংখ্য জুতো দেখা যায়। লোকজন সব ব্যস্ত। যে যার তাল সামলাচ্ছে। তককো ভাবল, ‘এই সুযোগ!’ ভেতরে ঢুকলে কেউ সন্দেহ করবে না। কারণ তার চেহারাটাও রোগীর মতো হয়ে গেছে।

তককো কাঁচের দরজা খুলতে পারছিল না। যতই চাপ দিচ্ছিল- কিছুতে বেধে যাচ্ছিল। খাঁকি ড্রেস পরা দারোয়ান তা দেখতে পায়। দারোয়ান একটু চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল। ভেতর থেকে এসি’র এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস লাগে তককোর মুখে।

দারোয়ান কেমন একটা মুখে তাকায় তককোর দিকে। চোখে জিজ্ঞাসা আর সন্দেহ। তককোর ড্রেস-পত্তর মনে হয় তার পছন্দ হয়নি। তককোও তাকিয়ে পড়ে দারোয়ানের চোখে। বাহ! এ তো পুলিশ নয়! এ তো আনসার! কিন্তু ভাব পুলিশের চেয়ে বেশি। তককো হঠাৎ ‘ও মাগো’ বলে পেট চেপে ধরে। বোঝাতে চায় তার দারুণ পেটে ব্যথা। এখনই টেস্ট করাতে হবে। দারোয়ান একটু সহজ হয়। কিন্তু সন্দেহ একেবারে যায় না। পথ ছেড়ে দেয়। তককো দ্রুত ভেতরে ঢোকে।

বড় হল রুম। দেওয়াল ঘেঁষে দুটো কাউন্টার। একটায় টাকা নেওয়া হচ্ছে। অন্যটায় রিপোর্ট ডেলিভারি দেওয়া হচ্ছে। রিপোর্ট ডেলিভারি কাউন্টারের সামনে একটা কালো সোফা। সোফায় মাত্র একজন লোক বসে আছেন। কাঁচা-পাকা গোঁফ। পাকা চুল। বয়স ৬০-৬৫ বছর হবে। তার পায়ের কাছে কালো এক জোড়া জুতো। একেবারে খাঁটি চামড়ার। জ্বলজ্বল করছে। মুখ দেখা যায়। তককোর নজর জুতোর দিকে। লোকটার হাতে একটি পত্রিকা। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন। ১০-১২ জন ছেলেমেয়ে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। দুজন পুলিশও রয়েছে। এর মধ্যে লোকটার ঠিক পাশে হুট করে একটা কাচের দরজা খুলে গেল। একজন মহিলা আর চার পাঁচটা ছেলেমেয়ে তড়ফড় করে বেরিয়ে এলেন। লোকটার সাথে আলাপ করছেন। বেশ ভিড় জমেছে জায়গাটায়। তককো জুতোর দিকে এগিয়ে গেল। ভদ্রলোক মহিলার দিকে একটু তাকিয়ে তাদের সাথে কাঁচের ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন। জুতোজোড়া ওইভাবে পড়ে আছে।

তককো দেরি করল না। এদিক-ওদিক তাকিয়ে জুতো জোড়ায় পা ঢোকাল। দ্রæত বেরিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে ‘অ্যাই! অ্যাই! তুই কেরে? জুতো নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস? স্যারের জুতো নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস? চোর চোর চোর!’ প্রথমে একজন। পরে চার পাঁচটা ছেলে মেয়ে চেঁচামেচি শুরু করল। আর সাথে সাথে চারদিক থেকে রি-রি করে লোকজন ছুটে এসে তককোকে ধরে ফেলল। তককো বের হওয়ার দরজা পর্যন্ত কেবল আসতে পেরেছে। দারোয়ানটা চান্স পাচ্ছে না। কারণ প্রায় ২০ জনের মতো চেপে ধরেছে তককোকে। একজন চুলের মুঠি ধরে টান দিচ্ছে। কিল-চড়-থাপ্পড় পড়ছে সমানতালে। একজন আচমকা কষে চড় বসাল তককোর পিঠে। সে কোনো ছাত্রনেতা হবে। সাথে সাথে তককোর পিঠ তিনহাত বসে গেল। জ্যান্ত চামড়া খুলে গেল। তককোর পায়ের জ্বালা পিঠে গিয়ে ঠেকল। তার দাঁত বেরিয়ে গিয়েছে। চোখ বন্ধ। কপাল ফুলে শিঙের মতো হয়েছে।

হঠাৎ সবাই চুপ। কিল চড় বাগিয়ে ধরে সব ফ্রিজ। কাকে যেন দেখছে। ‘আহাহাহা! ওভাবে কেউ মারে!’ বলতে বলতে একজন ভদ্রলোক ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে আসছেন।

‘স্যার আপনার জুতো চুরি করেছে!’ বলল অনেকে।
‘তাই বলে ওভাবে মারবে? ও তো মরে যাবে!’
তককো ঘাড় সোজা করতে পারছে না। তবুও এমন সহৃদয় ব্যক্তিকে দেখার ইচ্ছে হল। ঘাড় বেঁকিয়ে ভিড়ের মধ্যে সে তাকায়। আরে এ তো সেই ভদ্রলোক! যার জুতো চুরি করেছে তককো।

ফককো দম ছাড়ল। মুখটা হাঁ।…
‘বল তো লোকটা কে?’
‘এমন লোক তো দেখা যায় না! কে ভাই?’
‘মুহম্মদ জাফর ইকবাল।’
‘মুহম্মদ জাফর ই…!’ থেমে গেল ফককো। চোখ মোটা। ‘যে ছুরি মেরেছিল!’
‘দূরর! উনি ছুরি মারতে যাবেন কেন! ওনাকে ছুরি মারা হয়েছিল,’ গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আহারে এমন ভালো মানুষকে কেউ ছুরি মারতে পারে?’
‘তারপর কী হলো ভাই?’

‘তারপর উনি সকলকে সরিয়ে দিলেন। আমাকে নিয়ে ছুটলেন ডাক্তারের রুমে। ডাক্তার কী একটা খাচ্ছিল। ওনাকে দেখেই হুড়মুড় করে দাঁড়িয়ে গেলেন। চেয়ার-টেয়ার সব উল্টে পড়ল। বুঝলাম উনি খুব দামী লোক। পরে জানলাম উনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লেখক, উনি আহত হলে শেখ হাসিনাও দেখতে গিয়েছিলেন।’

ফককো হঠাৎ মুখ নিচু করে হাসতে থাকে। ঠোঁটচাপা হাসি। ফোঁপানোর মতো লাগছে। তককো প্রথমে বুঝতে পারেনি।
‘কীরে তুই হাসছিস?’

তককো হো হো করে মুখ আকাশে তোলে। হাসি ছেড়ে দেয়। সামলে নিয়ে বলে, ‘ভাই আপনি আর লোক পাননি! শেষ পর্যন্ত কি না…হো হো…জাফর ইকবাল সাহেবের জুতো চুরি!…খি-খি-খি…।’

‘দূরর!’ ফককোর গায়ে ছোট ঠেলা দেয় তককো। ‘আমি কী জানতাম নাকি! আমার নজর ছিল জুতোর দিকে।…তারপর কী হলো মন দিয়ে শোন!’

তককো বলতে থাকে- মুহম্মদ জাফর ইকবাল সাহেব তাকে গাড়িতে তুলে নিলেন। গাড়ির মধ্যে এসি। তককো বসেছে জাফর ইকবাল সাহেবের বামপাশে। জানলার ধারে। আর একেবারে ডান পাশে বসে আছেন জাফর ইকবাল সাহেবের স্ত্রী।

তককোর মুখ হাত-পায়ে ব্যান্ডেজ করা। ড্রাইভারটা মিচকে মিচকে হাসছে। জাফর ইকবাল সাহেব তককোর দিকে ঝুঁকে এলেন। স্বচ্ছকন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার কি খিদে পেয়েছে?’

তককো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, ‘খিদের জন্যই তো ওই কান্ড করেছিলাম, আপনার সাথে বলতে শরম নাই।’
‘খিদের জন্য!’
‘হ্যাঁ, আমি দুমাস খাই না।’

মুহম্মদ জাফর ইকবাল সাহেব যখন চুপ থাকেন- খুব গম্ভীর লাগে তাঁকে। বোঝাই যায় না তিনি কত দয়ালু। তাঁর বুদ্ধি কত মানবিক, কত রসালো। তাঁর দৃষ্টিও প্রখর। সেই দৃষ্টি দিয়ে তিনি দেখছেন তককোকে। তককো আড় চোখে এক ঝলক দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিল। জাফর ইকবাল সাহেবের চোখের চারপাশে পাতলা চামড়া ভাঁজ হয়ে রয়েছে। সেটা ঠিক হাসি না। তিনি সত্যটা দেখতে পাচ্ছেন।

ড্রাইভার কটমট করে বলল, ‘ওই ব্যাটা ওই! দুই মাস না খাইয়া বাইচ্চা আছস কেমনে?’

‘স্যার ভুল হয়েছে স্যার!’ ভ্যা-করে জাফর ইকবাল সাহেবের দিকে তাকিয়ে পড়ে তককো, ‘আসলে আমি দুদিন না খেয়ে আছি, কথার টানে দুমাস বলে ফেলেছি।’

মুহম্মদ জাফর ইকবাল সাহেব এবার স্মিত হাসলেন। নাক দিয়ে একটা লম্বা শ্বাস নিলেন। ড্রাইভারকে বললেন, ‘রমজান, সামনে স্পিডব্রেকার আছে, খেয়াল করে চালাও!’ ‘জ্বি স্যার’ বলে ড্রাইভার চুপ হয়ে গেল। আর একটি কথাও বলেনি।
‘তোমার বাড়িতে আর কে কে আছে?’ জিজ্ঞেস করলেন ইকবাল সাহেব।

‘কেউ নেই স্যার! মা-বাবা, ভাই-বোন কেউ নেই।’
ইকবাল সাহেব স্ত্রীর সাথে ফিসফিস করে কী একটা আলাপ করলেন। বেগম ইকবাল ড্রাইভারকে কোনো খাবারের দোকানের সামনে দাঁড়াতে বললেন।

‘না না, ও এখন এসব খেতে পারবে না, তরল খাওয়াতে হবে।’ বললেন জাফর ইকবাল সাহেব। তককোকে বললেন, ‘তুমি সাতদিন আমার বাসায় থাকবে, সুস্থ হবে, তবেই ছেড়ে দেবো, আমরাও সাত দিন ঢাকাতে আছি, তারপর সিলেট চলে যাব।’
প্রস্তাবটা ভালো লাগল না তককোর। পরাধীন হয়ে থাকতে মন চায় না। স্বাধীন থেকে লোকের হাতে মার খাওয়া ভালো । মনে মনে বলল, ‘দয়া করছেন ভালো, কিন্তু বাড়ি নিয়ে সেবা করার দরকার কী? এতো ভালো ভালো নয়।’
‘কিছু বলছ না যে!’

‘জ্বি স্যার! বলছিলাম আপনাদের ঝামেলা হবে।’
‘ঝামেলার চিন্তা করছ কেন? ওটা আমাদের বিষয়।’ বললেন বেগম ইকবাল। ‘আর আমাদের তো মাঝে মাঝে বাইরে আসতে হবে, সে সময় তুমি বাড়িটা চৌকি দিলে।’ বললেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

তককো ভাবে, ‘একটা চোরের হাতে চৌকি দেয়ার ভার দিচ্ছেন, লোকটা তো আসলেই বড় মনের।’

সামনের গøাসে ড্রাইভারের মুখ দেখা যায়। ড্রাইভার ঠোঁটটা বেঁকিয়ে রেখেছে। তককো লক্ষ করল। ড্রাইভারের বেঁকা ঠোটের ভাষা তককোর কাছে অন্যরকম লাগে। এর ভাষা ‘কুকুরের পেটে কি ঘি সয়!’

ফককো হঠাৎ করে জানতে চায়, ‘ভাই এই ড্রাইভারের চেহারা কেমন বলেন তো?’
‘কেন? চেহারা নিয়ে কী করবি?’
‘সেদিন হাইকোর্টের সামনে এক ড্রাইভার আমার কান ধরে টেনেছিল। কালো বেঁটে।’

‘দূরর! সে থাকে সিলেটে। মাঝেমধ্যে ঢাকায় আসে, ও শোন! এবার আসল ঘটনা বলি! আমি তো মুহম্মদ জাফর ইকবালের বাসায় থেকে গেলাম। আমার কাজ শুধু খাওয়া আর ঘুমানো। ওনারা স্বামী-স্ত্রী রাতে খাওয়ার পর ড্রইং রুমে বসে আলাপ-আলোচনা করেন। আমি মনোযোগ দিয়ে শুনি।’
ফককো কিছু বলতে গিয়েও বলল না।

তককো একটু থেমে মাথা টেনে বলল, ‘এক রাতে উনারা আলাপ করছেন, আমার একটু ঘুম ঘুম এসেছিল, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে আমার ঘুম হাওয়া!’
‘কেন?’
‘ওনারা আলাপ করছেন হিরে নিয়ে!’
‘হিরে!’ মাথা ঝুঁকে বলল ফককো।
‘হ্যাঁ, হিরে ঝরে পড়ছে আকাশে!’
‘ধুস!’ অবজ্ঞার সুরে বলল ফককো।
‘দূরর! আগে শোন না!’ ধমকের সুরে বলল তককো। ‘দুটো নিউট্রন স্টারের সংঘর্ষ হয়েছে…।’
নিউট্রন স্টারের কথা শুনে ফককো চোখ-মুখ কুঁচকায়।
‘কী স্টার?’
‘নিউট্রন, আমি ভালো করে শুনেছি, নিউটন না নিউট্রন। একেবারে নতুন তথ্য। কেউ জানে না।’ নড়েচড়ে বসে তককো। বলে, ‘দুটো নিউট্রন স্টারের সংঘর্ষ হয়েছে, আর সেখান দিয়ে হিরের খন্ড ঝরে পড়ছে…নিউট্রন স্টার কী রে?’
ফককো মাথা চুলকায়। মুখ সিঁটকোয়। আমতা আমতা করে। ‘ঠিক জানি না, তবে জেনে নেওয়া যাবে।’
‘আমিও জানি না, পরে অবশ্য জানা যাবে।’
‘ভাই আপনার লেখাপড়া কতদূর?’ জিজ্ঞেস করে ফককো।
তককো হঠাৎ থেমে যায়। গম্ভীরভাবে উত্তর দেয়, ‘অ-নে-ক, অষ্টম শ্রেণি।’

ফককো ভাবে, ‘তাইতো! আমার চেয়ে পাঁচ কেলাস বেশি।’
তককো জিজ্ঞেস করে, ‘নিউট্রন স্টার কোথায় থাকে বলতো?’
‘নিউট্রন স্টার?’ ঢোক গিলে বলে ফককো, ‘আকাশে না ভাই?’
‘আকাশ তো অবশ্যই, তোর ঘরে তো আর থাকবে না।’
তককো দুই হাতের তালু ঘষে। চোখে-মুখে খুশি। ‘তাহলে কী হলো! নিউট্রন স্টারের সংঘর্ষ হয় আকাশে, মানে শূন্যে। তাহলে ‘শূন্য থেকে’ পেয়ে গেলাম! আর সংঘর্ষের ফলে হিরে ঝরছে-মানে কোটি টাকা। হা-হা-হা।’ আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে তককো।

ফককো ভ্যাবাকান্ত হয়ে বসে থাকে। ‘আসলে কি জিনিসটা সত্য?’ ভাবতে থাকে সে। বলে,‘এই জিনিসটা যদি সত্যি হয় তাহলে আমরা বসে আছি কেন?’
তককো বলে, ‘শতভাগ সত্যি! আমি ছবিও দেখেছি, ওনাদের হাতের মোবাইলে ছিল সেই ছবি!’
‘হিরের খন্ড দেখতে পেয়েছিলেন?’

‘সাদা সাদা আলোক রশ্মি, তার আড়ালে ছিল টন টন হিরে!’ তককো ঘাড় বেঁকিয়ে অন্য দিকে তাকায়। কী একটা ভাবে। বলে, ‘এখন এ বিষয়ে লিখে ফেলতো! তাড়াতাড়ি লিখে ফেল!’
ফককো মাথা নিচু করে ভাবছিল। হঠাৎ মুখ তুলে বলে, ‘ভাই এটা তো এক পাতার মধ্যে লেখা হয়ে যাবে! বই হবে কী করে?’

‘দূরর! তুই আসলেই একটা টিকটিকির ডিম! শুধু কী এটা লিখবি নাকি?’ একটু ঠিকঠাক হয়ে বসে তককো। গলাটা ঝেড়ে নেয়। বলে, ‘শোন, প্রথমে গরিব কাকে বলে, গরিব হওয়ার কী জ্বালা, টাকা না থাকলে কী হয়, গালাগালি শুনতে হয়, স্বাধীনতা থাকে না, তোর জীবনেই তো এসব ঘটনা আছে, ওইসব নিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে কুড়ি পঁচিশ পাতা লিখে ফেলবি। তারপর দু এক পাতার মধ্যে নিউট্রন স্টারের সংঘর্ষ ও হিরের খÐ পাওয়ার কথা লিখবি, তারপর উপসংহার দিয়ে শেষ করে দিবি।’

ফককো মাথা নাড়ে। আইডিয়াটি পছন্দ হয়েছে। এক ঝলক টাকা-পয়সার স্বপ্ন দেখে ফেলে।
‘ভাই বইটা ক পাতার হলে ভালো হয়?’
‘ত্রিশ-চল্লিশ পাতা হবে, সব লিখতে না পারলে সমস্যা নেই। ছবি দিয়ে ভরানো হবে।’
‘ছবি!’

‘হ্যাঁ ছবি।’ একটু ভেবে নেয় তককো, ‘ওই নাসা না কী একটা আছে না?’

নিচের ঠোঁটটা মেলে ধরে ফককো। মানে- ‘কে জানে?’ চোখ গোল গোল করে ভেবে বলে, ‘নাসা? নাসা মানে তো নাকের রোগ, ওই যে লোকে বলে- ‘তোর নাসা হয়েছে’।’
তককো নাক মুখ কুঁচকে কী একটা ভাবে।
‘দুরর! ও নাসা না, এ নাসা মানে অন্য একটা কী, আমি ঠিক জানিনে, সেই নাসাই ছবি তোলে, ইন্টারনেটে পাওয়া যায়, ওই সব ছবি দিয়ে বইয়ের পাতা ভর্তি করা হবে- বুঝলি? বেশ সহজ করে দিলাম হা হা হা…’

তককো ফককোর হাত ধরে টেনে তোলে। ‘ওঠ! আর দেরি করা যাবে না, কাগজ-কলম কিনতে হবে, এখনই কল্যাণপুরের বাস ধরব।

ফককো উঠতে অনীহা দেখায়। ‘ভাই একটু সন্ধ্যে হোক, পায়ে জুতো নেই, শরম লাগে।’

‘দূরর! জুতো কতো হবে! হাজার হাজার কোটি কোটি জুতো কিনতে পারবি! জুতোর মধ্যে শুয়ে থাকতে পারবি!’
ফককো দাঁত বের করে হেসে পড়ে। ফককোর একটা হাত টেনে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে তককো। ফককো ওঠেনি, মাটিতে বসা। ফককো বলে, ‘ভাই কেমন লাভ হতে পারে?’

‘বলছি, আগে ওঠ!’ তককো ফককো পথ চলতে থাকে। এক নম্বর গেটের দিকে যেতে থাকে। তককো হাত নেড়ে নেড়ে ফককোকে বোঝায়। ‘একটা বই ছাপানো ও বাঁধানো সব মিলিয়ে খরচ হবে পঁচিশ টাকা, আর বিক্রি হবে পাঁচশ টাকা, তাহলে বোঝ লাভ কতো হবে!’

ফককো দাঁড়িয়ে পড়ে। লোভ আর বিস্ময় চোখে মুখে। ‘বলেন কী! পাঁচশ টাকা!’
‘এঃ! এটা যেই সেই বই নাকি! অন্যধরনের বই! পড়লে মানুষ বড়লোক হবে, এর দাম তো ঠিকই আছে।’
ফককো দুবার খামোখা নাক টানে। মানে-আশার আলো দেখছে। কিন্তু হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে যায়।
‘ভাই লোকে কি পড়ে দেখে বই কিনবে?’

‘না না, সে সুযোগ দেওয়া যাবে না! তাহলে বই একটাও বিক্রি হবে না। স্যামসাং বা নোকিয়া মোবাইল সেটের মতো পুরো প্লাস্টিক দিয়ে মোড়ানো থাকবে প্রতিটা বই! না কিনে পড়ার উপায় নেই।’

ফককো মাথা নাড়ল। বুদ্ধির তারিফ করল তককোর।
তককো বলল, ‘প্লাস্টিক কোটের বাড়তি খরচটা অন্যভাবে তোলা যায় কিনা ভাবছি।’
‘কীভাবে ভাই?’
‘বাই প্রোডাক্টের নাম শুনেছিস?’
‘বাই প্রোডাক্ট!’
‘হ্যাঁ, আমরা বইয়ের মধ্যে মোটা-মোটা অক্ষরে বিজ্ঞাপন দেব। কী বিষয়ে জানিস তো?’
‘কী বিষয়ে ভাই?’

‘ধর, যারা পড়বে তারা কবে কখন নিউট্রন স্টারের সংঘর্ষ হবে- জানতে চাইবে। আমরা বিজ্ঞাপন দেব- কবে কোথায় নিউট্রন স্টারের সংঘর্ষ হবে তার দিনপঞ্জি পেতে বিকাশ করুন এই নম্বরে…।’

‘হে-হে-হে’ করে হেসে ওঠে তককো। ফককো জিজ্ঞেস করে, ‘ভাই কবে সংঘর্ষ হবে তা কি আপনি জানেন?’
‘ঠিক জানিনে, তবে ওনাদের কথাবার্তা থেকে যেটা বুঝতে পেরেছি , তা হলো চার পাঁচ হাজার বছর কিংবা তারও বেশি সময় পরপর সংঘর্ষ হয়।’

‘ভাই!…’ কেঁদে ওঠে ফককো। ‘চার পাঁচ হাজার বছর ধরে কি মানুষ হা করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে?’

‘ওহ হো!’ জিব কাটে তককো, ‘আচ্ছা সময়ের উল্লেখ করার দরকার নেই, আর ওই বিজ্ঞাপনও বাদ।’