train_ar_manosh
রাতের মোহনগঞ্জ গামী ট্রেন’টি ময়মনসিংহ জংশনে দাড়িয়ে, ছেড়ে যাচ্ছে যাচ্ছে করেও কেনো জানি ছেড়ে যাচ্ছে না সময়মতো। শ্রাবণের একপশলা বৃষ্টী শেষে, গুড়ি গুড়ি ঝরেই চলেছে।  ব্রক্ষ্মপুত্র পারের বাতাস আর ইলশেগুঁড়িতে মিলেমিশে গাদলা। প্লাটফর্ম টা একদম জনমানব শূন্য, কোথা থেকে ক্ষীণ কন্ঠের- এই চা…গরম চা ছাড়া তেমন কিছুই শোনা যাচ্ছে না।

দ্বিতীয় শ্রেণী্র কামরাটি মোটামোটি জনাকীর্ন। উন্মুক্ত দুটো বাল্ব দুর্বল আলোতে জ্বলেছে; সিলিং ফ্যানদুটো থেমে থেমে ঘ্যারত ঘ্যারত আওয়াজ উদ্গিরনে প্রানান্তর যাত্রীসেবায় ব্যতিব্যাস্ত। আধবন্ধ দরজা জানলা কামরাটি গুমোট পরিস্থিতিতে মানবদেহের বিভিন্ন রন্ধ্রের বিভিন্ন সুবাস/কুবাসে আমি মোটামুটি ওষ্ঠাগত অবস্থায় হলেও মধ্যসারিতে আমার আসনটি বেশ “এক্সট্রা লেগ স্পেস” সম্বলিত হওয়াতে অনেক কিছুই সমঝোতা করে নিয়েছি।

জানালা সারিতে আমার ঠিক মুখোমুখি আসনে আছে খুবি অল্পদিনের দম্পতি, দুজনের হাতের মেহেদির রঙ শুকোয়নি। বার কয়েক চোখাচোখিতে বোরখার সামনে মাথা থেকে গলা পর্যন্ত যে দুপাট্টা খানি ঝুলছে তার উপরে জালবদ্ধ চক্ষুকোটরের ভিতর থেকেও বালিকা বধুটির সৌন্দর্য্য র্দ্যুতি ছড়াচ্ছে এটা বুঝতে বেশী বেগ পেতে হচ্ছে না। হটাত করেই বালিকাবধু সিট এর উপর পা তুলে আসন করে জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয় সাথে সাথে স্বামীও। একটা পুটলি থেকে দুটো টিফিন বাটী বের করে বউ। সাথে সাথে নাকে লাগে ফ্রেশ চ্যাপা শুটকি ভর্তার ঘ্রান। আহা। গাদলা রাতে চ্যাপা ভর্তা! বৌ আরেক বাটী’ থেকে পিঠা বের করে ভর্তা মাখিয়ে স্বামীকে কে দেয় আর বৌ’টি ও অভিনব পদ্ধতিতে, ঐ ঝোলা নেকাবের নীচ দিয়ে দেদারচ্ছে খেয়ে নেয় ভর্তা মাখানো পিঠা! পদ্ধতিটি দেখার জন্য চোখাচোখি হই বেশ কয়েকবার। বউ’টি এবার স্বামীর কানে ফিসফিসিয়ে কে যেনো বলে শ্বামী কিছুক্ষন বৌ এর দিকে তাকিয়ে আমার দিকে বিনীত ভাবে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করে-

-বাইছাব, হিদল বর্তা আর ম্যারা পিডা দেই? খাইবাইন!
আপনাদের হয়ে থাকলে দিতে পারেন, খাবো।  জাবাব দেই।
কথা শুনা মাত্র বৌ টি তরিঘরি করে একটা ছেঁড়া ঠোংগায় ওদের ভাগ রেখে দুই বাটি শুদ্ধ ভর্তা পিঠা দিতে চাইলে আমি বারন করে বলি-
-আরে না না বাটির ভাগ আপনারা রেখে আমাকে ঠোংগার ভাগ দিলেই চলবে, বেশী খেতে পারবো না।

গোগ্রাসে সাবার করি ভর্তা পিঠা। বোরখার নীচ থেকে ফুল হাতা ব্লাউজে মেহেদি হাতে এক বোতল পানি জানলা সারি আর মধ্য সারির দূরত্বটুকু নিমিষে ঘুচিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসে। বোরখা জালে আবদ্ধ বৃস্টিস্নাত জানালা কাচের প্রতিসারিত আলোতে আবারো ধরা পরে মায়াবী চোখের দ্যোতনা।

ইতিমধ্যে কামরার ভিতরে বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাতে বাংলাদেশ রেলওয়ে কতৃপক্ষের মা বোন চৌদ্দগুষ্টির নিকাহ, হাঙ্গা/বিবাহ, তালাক প্রায় সম্পন্ন করে আবক্তা কুবক্তা খিস্তি খেউরে জনগন যখন ব্যস্ত ঠিক তখনি উদ্বীগ্ন ও বিক্ষিপ্ত ভাবে প্লাটফরমে কাউকে যেনো খুজতে দেখা যায় এক যুবতীকে। দলের দুর্বল ভেড়া চিতকার সম আওয়াজে হুইশেল বাজিয়ে ধিরে ধিরে নড়তে শুরু করে মোহনগঞ্জ গামী ট্রেন, ঘড়ির কাটা রাত এগারোটা ছুই ছুই তখন।  মেয়েটি দৌড়ে কোনরকমে আমাদের কামরাতে উঠে।
শৌচাগার সংলগ্ন দেয়ালটা ঘেঁসে দাঁর করানো আছে প্যাকেট করা সম্ভবত ন্যাশনাল ব্র্যান্ডের একটি ফ্রিজ। এটার ডান পাশ ঘেঁসে জায়গা করে নিয়ে দারিয়েছে মেয়েটি। আর বাপ প্বার্শে যিনি উনি সম্ভবত ফ্রিজটির মালিক।

আমাদের ট্রেন্ টি শম্ভুগঞ্জ আউটার ব্রীজ সিগন্যালে আটকিয়েছে। ফ্রিজের মালিক বাথরুম ব্যবহার শেষে, হেলান দিয়ে সিগারেট ফুকছেন। আর ঘনঘন মেয়েটির আপাদমস্তক নিরীক্ষন করছে। মেয়েটি অস্বস্তিকর মনোভাবে নাকে হাত চাপা দিয়ে দাঁড়িয়ে ।
কামরার অনেকের মতো আমার সামনে বসা স্বামী বেচারা হা মুখে ঘুমাচ্ছে। বউ’টি জেগে, অনেক কথার বলার ইচ্ছা থাকলেও নিজেকে সামলে নিয়েছি। ভাবছিলাম একবার বলবো যদি দাড়িয়ে থাকা মেয়েটীকে ওর পাশে বসতে দিতে পারে।
ট্রেন চলতে শুরু করেছে, মেয়েটি আস্তে আস্তে মধ্যসারি ধরে এগিয়ে আসছে। ফ্রিজ মালিক আমার দিকে আলুথালু চোখে তাকিয়ে মৃদু হাসছে। ভালো করে দেখছি, মেয়েটি অদ্ভুত সুন্দরী। গাঢ় শ্যাম বর্নের। সাদা শাড়ী, ঈষৎ হিলের জুতো, ম্যাচিং পার্ল এর গয়না রুচিসম্পন্ন প্রসাধনী তে হাল্কা রাতের সাঁজে এক কথায়-এলিগ্যান্ট।
অনেক কিছু থেকে বিরত থাকার জন্য আমি তখন রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম এর পাতাতে চোখ নিবন্ধন করেছি-
-এই খানে এই তরুতলে তুমি আমি কতূহলে
আর কটা দিন কাটিয়ে যাবো প্রিয়ে-
শুনতে পাই মেয়ে টা বলছে
-বাহ কি দারুন কবিতা’টা পড়ছেন, একটু বসতে দেবেন পাশে!
দেরী না করেই বলি-
-আপত্তি না থাকলে আমার অসুবিধা নেই।
-মোটেও না।
সুন্দরি মেয়েদের নাকি সবকিছুই সুন্দর হয়। কি যে দুর্দান্ত খুশবু ছড়ানো পারফিউম মনে হয় বদ্ধ কামরার বোটকা গন্ধ উপচিয়ে মৌ মৌ সুবাসে সুবাসিত হচ্ছে আস্ত রাতের ট্রেন! জিজ্ঞাস করি-
-কি ব্যবাহার করেছেন! জ্যাসমিন!
-আপনি কি করে জানেন?
মৃদু হেসে ভালো করে ওর চোখের দিকে তাকাই, টানা চোখে আনপ্লাকড মোটা ভ্রু চোখে এবং নেত্র পাতার সমানুপাতিকতায় বেশ মানানসই।
-জানেন, ফ্রিজের পাশে দাঁড়ানো লোকটা বারে বারে বাথ রুমে যাচ্ছিলো আর পকেটের শিশি থেকে মদ খেয়ে খেয়ে আসছিলো, কি যে দুঃসহ গন্ধ, বমি এসে গিয়েছিলো-ভাগ্যভালো আপনি বসতে দিলেন। ধন্যবাদ।
জানতে চাই
-এতরাতে যাবেন কোথায়?
-আর বলেন না ভাই, ঢাকা থেকে এসেছি, ময়মনসিংহ স্টেশনে ছোটভাইটি আমাকে রিসিভ কথা ছিলো- ওর পাত্তা নাই। যাবো গৌরীপুর গ্রামের বাড়ী।
-তাহলে তো কাছেই, বড় জোর ঘন্টা ঘানেক।
-তবুও অনেক রাত হয়ে যাবে ষ্টেশন থেকে বাড়ী খানিকটা দূরে বাড়ী থেকে কেউ আসবে কিনা এত রাতে-
লক্ষ্য করি আমাদের আলাপচারীতায় বোরখা নেকাবের জাল বদ্ধ অক্ষিকোটরে দুষ্টুমির হাসি নেচে যাচ্ছে বালিকাবধু চক্ষে।
কেনো জানি হটাত করেই মেয়েটি কথা বলা বন্ধ করে দেয়। ভ্যানেটি থেকে নোটবুকের পাতা বের করে ওমর খৈয়াম এর উপর রেখে লিখতে শুরু করে ওর নাম, ঢাকার বাসার ঠিকানা, ফোন নাম্বার ইত্যাদি। এক সময়ে লিখে-
-আসুন না আজকে রাতে আমাদের বাড়ীতে নিমন্ত্রিত অতিথি হয়ে।
ওর হাত থেকে কলমটা নিয়ে লিখি-
-পুর্ব পরিকল্পিত প্ল্যান না থাকলে, নিঃসন্দেহে এত আন্তরিকতার নিমন্ত্রন কখনো হাতছাড়া করতাম না।
ও লিখে চলে,
-রাত এগারোটায় ট্রেন ছাড়বে, যুবতী মেয়ে পাশে বসবে-এগুলু সবই কি পুর্বপরিকল্পিত?
আমি উত্তর লিখতে পারি না। প্রসঙ্গ পরিবর্তনে বলি-
-আচ্ছা আপনাদের ষ্টেশনে অন্ধ এক বাউল ভিক্ষুক মাঝে, মাঝে অনেক রাত গান করে উনাকে কে কি আপনি চেনেন!কানা বশির
-না আমি তো অনেক দিন পর পর বাড়িতে আসি, দাদা দাদু কে দেখতে।
আস্তে আস্তে ট্রেন গৌরীপুর কবরস্থানের বাক ঘেঁসে জংশনে পৌছে। সুন সান নীরবতা।
-আচ্ছা তাহলে যাই, আবার হয়তো দেখা হবে কোনদিন
বুকের কথাও যেনো একটা সুচালো ব্যথা টের পাই, বলি-
-আমি নামবো ষ্টেশনে, আপনাকে অন্ততঃ একটূ হলেও এগিয়ে দিয়ে আসি।
ওর দেরী দেখে ততক্ষণে ওর বাড়ী থেকে লোকজন ষ্টেশনে উপ্সথিত।
কুপি বাতিতে ময়মনসিংহগামী ট্রেনের অপেক্ষায় দুই চারজন কে নিয়ে গান গাইছে বাঊল কানা বসির। কাছে গিয়ে বসে ডাক দেই-
-বসির চাচা
-আরে বা’জান রাত দুপুইরা বেলা আফনে কই যাইন-দারো আইয়া বইন বা’জান।
কাছে গিয়ে বসতেই বরাবররে মতো আমার মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে মুর্শিদী বাণী শেষে আস্তে করে বলতে থাকেন-
-বা’জান আইজক্যা আফনে বড়ই সুগন্ধি। কাছের মানুষের পরশ না পাইলে, মানুষ অত সুগন্ধি হয় না। আফনে কি মনের মানুষের পরশ পাইছেন?
আমি মুহূর্ত নীরব থেকে বলি –
না চাচা, ট্রেনের মানুষ।
বসির বাউল গান ধরে-
-হাতের কাছে হয়না খবর, কি দেখতে যাও দিল্লী লাহোর,
সিরাজসাই কয় লালন রে তো সদাই মনের ঘোর গেলো না
কে কথা কয়’রে দেখা না…।।
রাতের নিঃস্তব্ধতা ভেদ করে হুইসেল বাজিয়ে আস্তে আস্তে চলতে শুরু করে মোহনগঞ্জগামী রাতের ট্রেন।