আলেয়ার কবরে এখন প্রতিদিন বকুল ফুল ঝরে পড়ে। সকালের সূর্য আলেয়াকে আলো দেয়। ওর কবরেই বকুল ফুল ঝরে পড়া উচিৎ। মৃত্যুর আগে ও আমাকে ওর ভাল লাগা ভালবাসার কথা লিখে গেছে। শুধু জেনে যেতে পারেনি আমিও ওকে ভালবাসি এবং এখনো ওকে ভালবাসি। আলেয়ার লেখা শেষ চিঠি পড়ে আমি যখন জ্ঞান হারাচ্ছিলাম তখন সেকেন্ডের ভিতরে বিগত সময়ের সব স্মৃতি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেই একবারে সব অন্ধকার হয়ে গেল। তার পর আমার আর কিছুই মনে নেই। আমি জ্ঞান হারানোর পর সবাই ধরাধরি করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে তিনি চিকিৎসা করেন এবং আমার জ্ঞান ফিরে আসে। মা এবং অন্যদের মূখে শুনেছি জ্ঞান ফেরার পর আমি কোন কিছুই মনে করতে পারিনি। শুধু মাবার চেহারাটা মনে ছিল। প্রায় দেড় বছর চিকিৎসার পর আমি সৃস্থ হয়ে উঠি।

এক রাতে আলেয়া তার মায়ের সাথে ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ দুড়ুম দাড়াম শব্দ। ভয়ে ওরা কেপে উঠলো এবং সাথে সাথে ওদের দরজায় লাথির আঘাত লাগলো। ওরা তখনই বুঝতে পারলো মিলিটারি এসেছে। আলেয়ার মা অনেক চেষ্টা করেও ওকে বাচাতে পারেনি। চোখের সামনে রাজাকার এবং পাকিস্তানী মিলিটারীদের বর্বরতা দেখেছে আলেয়ার ছয় বছরের ভাই আলাদীন। রক্তাক্ত ক্ষত বিক্ষত আলেয়া সেই অবস্থাতেই তার প্রিয় মানুষটিকে চিঠি লিখে তার মায়ের হাতে দিয়ে বলেছে “ ও যদি ফিরে আসে এই চিঠি যেন ওকে দেয়া হয়।‘

এটুকু ছিল আলেয়ার শেষ কথা। রাস্তার মোড়ে বড় বটগাছে যে কংকালটা ঝলছে সেটা আর কারো নয় রাজাকার শরাফত আলীর। যে বদমাইশটার কারণে আমার জীবন থেকে আলেয়ার আলো নিভে গেছে চিরতরে। এর মাঝে আমার ছোট ভাইও ফিরে এসেছে। মা ভীষণ আনন্দিত। বলতে গেলে দেশের এই বিরাট অর্জনে যত ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে এবং যত ক্ষতি হয়েছে আমার মায়ের তেমন একটা ক্ষতি হয়নি। প্রতি রাতে আলেয়ার লেখা চিঠি গুলি একবার করে পড়ি শুধু রক্তমাখা চিঠিটা পড়ি প্রতি চাদনী রাতে যখন চাদ তার সমস্ত জোছনা ঢেলে দেয়। তখন আমি আলেয়াকে ভাবি এবং তার জন্য চোখের জল বিসর্জন দেই। সুস্থ হবার পর আমি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাই। রাশেদের মা বাবাকে লেখা চিঠিটা আমার পকেটে। ওর দেখা পেলে ওর চিঠিটা ওকে ফেরৎ দেব। রাশেদের বাড়িতে গিয়ে কাউকে না পেয়ে খোজ নিয়ে জানতে পারি মিলিটারিরা ওদের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল এবং ওর বাবা মা এবং ছোট ভাইকে গুলি করে হত্যা করেছিল। ওর অতি আদরের বোনকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গিয়ে পাশবিক অত্যাচার করে বেয়নেট চার্জ করে খুচিয়ে খুচিয়ে মেরে ফেলেছিল। আমি কিভাবে রাশেদকে এসব কথা বলবো ভেবে পাইনি।

আমি যে রাশেদকে তার বাবা মায়ের এবং অতি আদরের বোনের সংবাদ দিতে পারবোনা বলে পালিয়ে বেড়াচ্ছি সেই রাশেদ আমাকে মুক্তি দিয়ে গেছে। মুক্তির নামে দিয়ে গেছে আজীবনের মত শিকল পরা ব্যাথা। রাশেদের লেখা চিঠি পড়ে ভাজ করে পকেটে রেখেছি। যেখানে আগে থেকেই আরেকটা রক্তমাখা চিঠি ছিল,চিঠিটা আলেয়ার। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। স্বাধীন দেশে সূর্য ডুবছে। এস এম হলের বারান্দায় মাহমুদের পাশে বসে আমি শুণ্য দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। সে আকাশে কোন মেঘ নেই,এক ঝাক পাখি ডানা ঝাপটে নীড়ে ফিরছে। তারাও আজ স্বাধীন। হল মসজিদ থেকে আজানের ধ্বণি ভেসে আসছে, হাতের তালু দিয়ে চোখ মুছে আমরা দুজন উঠে দাড়িয়েছি। মাহমুদ নির্বিকার। যতই মুছছি চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছেই। এখন আর অশ্রু মুছতে ইচ্ছে করছেনা।

ও ওর মত করে ঝরতে থাক। এখন আমার পকেটে রক্তমাখা দুটো চিঠি। একটি মুক্তিযোদ্ধার,অন্যটি মুক্তিযোদ্ধাকে ভালবাসা এক বীরাঙ্গনার। চিঠি দুটোয় হাত বুলিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেব। মসজিদের দিকে হাটছি আর মুখ দিয়ে বিড় বিড় করে বেরিয়ে আসছে একটি কথা এখন আমার কাছে দুটো চিঠি রক্ত মাখা দুটো চিঠি।আমি অনেকটা পালিয়ে থাকতাম যেন রাশেদের সাথে আমার দেখা না হয়। আমার আর পালিয়ে থাকতে হলোনা। সত্যি এক জীবনে আর কোন দিন রাশেদ আমার সামনে এসে দাড়াবেনা। আমাকে জিজ্ঞেস করবেনা আমার বাবা মাকে চিঠিটা দিয়েছিলি কিনা। একদিন এস এম হলের বারান্দায় বসে আছি। হঠাৎ আমার পাশে কারো অস্তিত্ব টের পেলাম। ফিরে দেখি মাহমুদ আমার পাশে দাড়ানো। প্রথমটাতে আমি চমকে উঠেছিলাম। আমার অবচেতন মন আমাকে বলছিল হয়তোবা রাশেদ এসে দাড়িয়েছে। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি মাহমুদ। রাশেদ আর মাহমুদ দুজনেই আট নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছিল। মাহমুদকে দেখে আমি কিছুটা শান্ত হলাম।

আমার পাশে বসে মাহমুদ আমার কাধে হাত রাখলো। আমার অসুস্থতার দিনগুলোতেও ও সারাক্ষণ আমার পাশে ছিল। আমার এবং আলেয়ার সব বিষয় ও জানতো বলেই হয়তো আমাকে নানা ভাবে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখার চেষ্টা করতো। কিন্ত বিষয়টা হয়ে গিয়েছিল শরীরের একটা ব্যাথা স্বরূপ। ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারিনি। আসলে আমি স্মৃতিগুলো কোন দিন ভুলতে চাইনা। পাশে বসে মাহমুদ পকেট থেকে একটা চিঠি বের করলো। এই চিঠিটাও রক্ত মাখা। বুকের মধ্যে আবার প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলাম। চিঠিটা খুলে পড়লাম এবং সাথে সাথে আমার চোখ আবার অশ্রুতে ভিজে ঝাপসা হয়ে উঠলো। রাশেদের লেখা চিঠি। রাশেদ যখন চিঠিটা লিখছিল মাহমুদ তখন ওর পাশে বসা। মাহমুদ নিজ চোখে দেখেছে রাশেদের মৃত্যু দৃশ্য। রাশেদ ছিল আমার ভীষন ভাল বন্ধু। সারাক্ষণ আমরা একসাথে থাকতাম। কথা ছিল একই সেক্টরে যুদ্ধ করবো তা আর হয়ে ওঠেনি। রাশেদ আমাকে অনুরোধ করেছে আমি যেন ওর বাবা মাকে দেখে রাখি। এবং ও যে মারা গেছে এটা যেন তাদের বুঝতে না দেই। রাশেদ আরো অনুরোধ করেছে ওর বোন মিতুকে আমি যেন ভালো ঘরে বিয়ে দিই।