দেবতাদের যুদ্ধ

আমাদের দেশের পুরাণে যেমন দেবতা আর অসুরের গল্প আছে, পুরাতন নরওয়ে আর সুইডেন দেশের পুরাণেও তেমনি সব দেবতা আর অসুরের কথা লেখা আছে।

নরওয়ের পুরাণে আছে, সেকালের আগে যখন পৃথিবী বা সমুদ্র বা বায়ু কিছুই ছিল না-তখন কেবল বিশ্ব-পিতা (All Father) ছিলেন। তাঁহাকে কেহ সৃষ্টি করে নাই, কেহ তাঁহাকে দেখিতে পায় না। তিনি যাহা চাহেন, তাহাই হয়। সৃষ্টির আগে চারিদিকে শূন্য আর অকার ছিল, সেই শূন্যের মাঝখানে ছিল গিন্নুঙ্গা নামে গহ্বর। সেই গহ্বরের উত্তরে কুয়াশার দেশ, তাহার মাঝখানে হ্নরগেল্‌মির নামে ঝরণার জল টগবগ করিয়া ফুটিত।

সেই গ্‌হবরের দক্ষিন মস্পেল্‌স্‌হাইম্‌ অথাৎ আগুনের দেশ, সুৎর্র্‌ নামে বিশাল দৈত্য জ্বলন্ত তলোয়ার হাতে সেই দেশে পাহারা দিত।

সেই যে গিন্নুঙ্গা নামে গহ্বর, তাহার ভিতরটা ছিল বড়ই ঠাণ্ডা। হ্নরগেল্‌মির ঝরণার জল তাহাতে পড়িয়া বরফ হইয়া যাইত, সুৎর্রের তলোয়ার হইতে আগুনের ফিনকি পড়িয়া সেই বরফকে গলাইয়া দিত। সেই আগুন আর বরফের লড়াই হইতে গিন্নুঙ্গা গহ্বরের ভিতরে য়ীমির নামক অতি ভীষণ দৈত্য আর আধম্‌লা নামে গাছ জন্মাইল। য়ীমির আধম্‌লাকে পাইয়া তাহার দুধ খাইতে লাগিল, আর আধম্‌লা আশেপাশের বরফে লবনের গন্ধ পাইয়া তাহাই চাটিতে আরম্ভ করিল। চাটিতে চাটিতে সেই বরফের ভিতর হইতে একটি দেবতা বাহির হইলেন, তাঁহার নাম বুরি।

এই য়ীমির হইতে অসুর আর বুরি হইতে দেবতাগণের জন্ম, আর জন্মাবধিই অসুর আর দেবতার বিবাদ। যুগযুগ ধরিয়া সেই বিবাদ চলিতে থাকে, শেষে অনেক যুদ্ধের পর দেবতারা য়ীমিরকে মারিয়া ফেলেন। আর যত অসুর ছিল, য়ীমিরের রক্তের বন্যায় সকলেই ডুবিয়া মরে, বাকি থাকে কেবল বার্গেল্‌মির আর তাহার স্ত্রী। এই দুজনে একখানি নৌকায় করিয়া সকল জায়গার শেষে একেবারে ব্রহ্মাণ্ডের কিনারায় গিয়া ঘর বাঁধিল। সেই স্থানের নাম হইল ‘জোতন্‌হাইম’ বা দৈত্যপুরী। সেই দৈত্যপুরীতে অসুরের বংশ বাড়িতে লাগিল, দেবতা অসুরের বিবাদও আবার জাগিয়া উঠিল।

এদিকে অসুরেরা সব মরিয়া যাওয়াতে দেবতারা কিছুদিনের জন্য যেন একটু আরাম পাইলেন। তখন তাঁহাদের মনে হইল যে, চারিদিকে কেবলই শূন্য আর কুয়াশা আর আগুন আর বরফের লড়াই দেখিতে একটুও ভাল লাগে না। তাই তাঁহারা সকলে মিলিয়া যুক্তি করিলেন যে, চলো আমরা য়ীমিরের দেহ হইতে গাছ-পালা নদ-নদী আর পাহাড় পর্বতের সৃষ্টি করি। এই বলিয়া তাঁহারা য়ীমিরের বিশাল দেহটাকে সকলে মিলিয়া গড়াইয়া গিন্নুঙ্গা গহ্বরে নিয়া ফেলিলেন। তাহাতে গহ্বর বুজিল, এই সৃষ্টি রাখিবার একটা জায়গাও জুটিল। য়ীমিরের রক্তে সমুদ্র ত আগেই হইয়াছিল, উহার মাংশে মাটি গড়িতেও বেশী বেগ পাইতে হইল না, হাড় আর দাঁত হইল পাহাড়-পর্বত, চুল-দাড়ি হইল গাছপালা, মাথার খোলটা হইল আকাশ, মগজগুলি হইল মেঘ, কাছেই আগুনের দেশ ছিল, সেখানে সেই সুৎর্র্‌ নামক দৈত্য থাকিত-সেইখানকার আগুনের ফিনকি দিয়া চন্দ্র সূর্য আর তারা হইল।

এদিকে কিন্তু য়ীমিরের মাংশ পচিয়া তাহাতে পোকা ধরিয়াছে। দেবতারা ভাবিলেন, ‘তাই ত, এই পোকাগুলিকে কি করা যায়? এগুলি হইবে পরী, ভূত আর বামন।’ পরীরা দেখিতে ভারি সুন্দর; তাহারা আকাশ অঅর পৃথিবীর মাঝখানে থাকে, চাঁদের আলোতে খেলা করে, প্রজাপতির পিঠে চড়িয়া ফুলগুলিকে ফুটাইতে আসে, আর নানামতে লোকের উপকার করে। ভূত আর বামনগুলি দেখিতে যেমন বিশ্রী তেমনি দুষ্টু। তাহারা মাটির নীচে থাকে, সোনা-রূপা মনি-মানিকের সন্ধান রাখে, আর লোকের মন্দ করিতে রাত্রে বাহিরে আসে। দিনে তাহাদের মাটির উপরে আসিবার হুকুম নাই, আসিলে পাথর হইয়া যায়।

সকলের মাঝখানে দেবতারা আগেই তাঁহাদের নিজের থাকিবার জায়গা রাখিয়াছিলেন। সেই জায়গার নাম আসগার্ড বা স্বর্গ। সেখানকার রাজা ছিলেন বিশ্ব-পিতা। তাঁহার নাম ওডিন (Odin) বা উওডেন (Woden) যাহা হইতে বুধবারের নাম ওয়েডনেজ ডে হইয়াছে। ইঁহা হইতেই সকল দেবতা আর মানুষের জন্ম। ইঁহার নাম বিশ্ব-পিতা।

স্বর্গের সকলের চেয়ে উঁচু সিংহাসনে ওডিন তাঁহার রানী ফ্রিগ্‌গার (Frigga) সহিত বসিয়া স্বর্গ মর্ত পাতাল কোথায় কি হইতেছে তাহার সংবাদ লইতেন। কিছুই তাঁহার চোখ এড়াইতে পারিত না। ওডিনের একটিমাত্র চোখ ছিল, আর একটি চোখ তিনি মিমির নামে এক বুড়োকে দিয়াছিলেন। সেই বুড়ার একটা ঝরণা ছিল, তাহার জল খাইলে ভূত ভবিষৎ সকল বিষয় জানা যাইত। ওডিন সেই ঝরণার জল খাইতে গেলেন। বুড়া বলিল, ‘তোমার একটি চোখ না দিলে জল খাইতে পাইবে না।’ কাজেই একটি চোখ খুলিয়া দিয়া ওডিনকে সেই জলের দাম দিতে হইল। বুড়া সেই চোখটি নিয়া তাহার ঝরণার জলে ডুবাইয়া রাখিল। সেখানে সেটি দিনরাত ঝিকমিক করিত। ওডিন ঝরণার জল খাইয়া সকলের চেয়ে বেশী জ্ঞানী হইলেন। আর সেই ঘটনার চিহ্ন রাখিবার জন্য ঝরণার ধারে গাছের ডাল দিয়া একটা বল্লম তয়ের করাইয়া লইলেন। সে এমনি আশ্চর্য বল্লম যে কিছুতেই তাহাকে ঠেকাইতে পারিত না।

ওডিনের এক পুত্রের নাম টিউ (Tiu)। ইহার নামে মঙ্গলবারের নাম টিউজ ডে (Tuesday) হইয়াছে। ইনি বীরত্ব এবং যুদ্ধের দেবতা। ওডিনের যেমন একটা আশ্চর্য বল্লম ছিল, ইহার তেমন একটা তলোয়ার ছিল। লোকে এই তলোয়ারকে বড়ই ভক্তি করিত, আর যার পর নাই যত্নে এক মন্দিরের ভিতরে তাহা রাখিয়া দিত। তাহাদের বিশ্বাসই ছিল যে, এই তলোয়ার যাহার কাছে থাকিবে সে কখনো যুদ্ধে হারিবে না। কিন্ত হায়! একদিন কে সেই তলোয়ার লইয়া অনেকে পৃথিবী জয় করিয়াছে, আবার সেই তলোয়ারেই তাহারা মারা গিয়াছে। এমনি করিয়া তাহার দ্বারা কত কাণ্ড হইল। কিন্তু টিউর ঘরে আর তাহা ফিরিয়া আসিল না।

ওডিনের আর-এক পুত্র থরের (Thor) নামে ইংরেজী থার্সডে (Thursday) হইয়াছে। থরের মত জোর কোনো দেবতার ছিল না, দেখিতেও কেহ তাঁহার মত এমন বিশাল ছিলেন না। তাঁহার হাতুড়ি দিয়া যাহাকেই তিনি ঠাই করিয়া মারিতেন, সে পাহাড়ই হউক, আর পর্বতই হউক, তখনই গুঁড়া হইয়া যাইত। স্বর্গে বাইফ্রেস্ট্ নামে বিচিত্র সেতু আছে (যাহাকে তোমরা বল রামধনু) সেই সেতুর উপর দিয়া দেবতারা যাওয়া আসা করিতেন। অর্থাৎ আর সকল দেবতারাই করিতেন-কিন্তু থর্‌ কখনো সেই সেতুর উপর দিয়া যাইতেন না, গেলে তাহা ভাঙ্গিয়া পড়িত।

ফ্রাইডে (Friday, শুক্রবার) যাঁহার নামে হইয়াছে, তাঁহার নাম ছিল ফ্রিয়া (Freya)। তিনি ছিলেন সৌন্দর্যের দেবতা। কেহ বলে, ইনিই ওডিনের রানী ফ্রিগ্‌গা। যুদ্ধে যত বীরের মৃত্যু হইত, তাহাদের অর্ধেক ফ্রিয়ার কাছে যাইত। ফ্রিয়া তাহার সঙ্গিনী ভ্যাল্‌কীরদিগকে লইয়া সেই বীরদিগকে নিতে যুদ্ধ ক্ষেত্রে আসিতেন। তাঁহার সভায় গিয়া বীরদিগের সুখের আর সীমা পরিসীমা থাকিত না। সেখানে হাইদ্রুন্‌ নামে ছাগল ছিল, তাহার দুধ ছিল অমৃতের মত, সে দুধ দোওয়াইয়া শেষ করা যাইত না। আর সেহ্রিম্‌নির নামে যে শুয়োরটি ছিল, তাহার মাংশও ছিল তেমনি মিষ্ট। এলধ্রিম্‌নির নামে পাচক তাহা ততোধিক মিষ্ট করিয়া রাঁধিত। বীরের ক্ষুধা-বুঝিতেই পার, তাহারা খাইত কেমন! কিন্তু সে মাংশ কিছুতেই ফুরাইত না। খাওয়া দাওয়া শেষ হইয়া গেলে আবার যেমন শুয়োর তেমনটি বাঁচিয়া উঠিয়া ঘোঁত্‌ ঘোঁত্‌ করিতে থাকিত।

– উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী