ভদ্রলোকের বাড়ীটা খুঁজে পেতে তেমন একটা পরিশ্রম করতে হয় নি। টেলিফোনে লোকেশনটা বলেছিলেন যখন রওয়ানা হই ঠিক তার আগ মুহূর্তে। গতকালও ফোনে বলেছি, আজ আসবো দেখা করতে, ঠিকানাটা বলুন।

কেন যেন তখনই বললেন না। বললেন, কাল যখন রওয়ানা হোন তখন ফোন করবেন, বলে দেবো।

কাছাকাছি যেয়ে গলিটা পেতে একটু ধন্দে ছিলাম। রাস্তার পাশের ছোট্ট চা’য়ের দোকানের লোকটাকে জিজ্ঞেস করলাম, পানির ট্যাংকের গলি কোন দিকে। তিনি সোৎসাহে বললেন, সামনেই, তিনটা গলি পরই চার নম্বর গলিটা। আরেকজন বসা লোকটি আরও সহজ করার জন্য বললেন, মাঠের পাশ দিয়ে গলিটা চলে গেছে। এলাকার লোকগুলো বেশ সহজ-সরল  মনে হলো। আজকাল মানুষেরা এতটা সময় নষ্ট করেতে চায় না। নির্দেশনা  মতো গলিটা সহজেই পেয়ে গেলাম। তবে ৫/এ  ব্লকটা পেতে একটু ঘুরতে হল।  একটা  ছোট গলি মিস্‌ করেছিলাম। তবে একটু  মোচড়  দিতেই বাড়ীটা পেয়ে গেলাম। একজন ভদ্রলোক গেইটে দাঁড়িয়ে ছিলেন, গাড়ী থেকে নেমে জিজ্ঞেস করাতে নিশ্চিত করলেন।

যার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি তিনি একজন নিউমেরোলোজিস্ট। বাংলা করলে দাঁড়ায় সংখ্যাতত্ত্ববিদ। বাংলাটা সঠিক কি না নিশ্চিত নই। সোজা বাংলায় তিনি একজন গণক। তবে হাতের রেখা দেখে নয় (অর্থাৎ জ্যোতিষ নন), জন্ম সংখ্যা দেখে তিনি ভাল-মন্দের কথা বলে থাকেন। সঠিক জন্ম তারিখ-দিন-ক্ষণ, এই সব জানা জরুরী, তবেই নির্ভুল গণনা সম্ভব। যদিও আমি মনে করি নির্ভুল কথাটা কেবল সৃষ্টিকর্তার জন্য প্রযোজ্য। গেইটে দাঁড়ানো ভদ্রলোক দরজাটা দেখিয়ে দিলেন। ৪/৫ তলা দালানবাড়ী হলেও নীচতলাতেই তিনি বসেন।এর মাঝে হাল্‌কা ইলশেগুড়ি বৃষ্টি হয়ে গেছে, তার কিছুটা রেশ ছিল বলে ভাল করে দালানটা দেখতে পাইনি। দরজায় একটা নামফলক দেখবো ভেবেছিলাম, কিন্তু কিছুই নেই। তাই দোমনা ছিলাম দেখে ভদ্রলোক রেহাই দিলেন। দরজায় দু’বার টোকা দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সাড়া না পেয়ে আবার টোকা দিলাম। এবার দরজাটা সামান্য খুলে এক ভদ্রলোক উঁকি দিলেন এবং এই ফাঁকেই আমি তাকে দেখলাম উদাম গা, স্বল্পকেশী। তড়িঘড়ি হয়ে একটু অপেক্ষা করতে বলে ক্ষণিকেই একটা হাওয়াই সার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে  ফের দরজা খুললেন এবং ভিতরে আসার আমন্ত্রন জানালেন। আমি পরিচয় দিয়ে ঢুকলাম এবং সন্দিহান হয়ে একটু টেনে টেনেই বললাম, মি: ….। ‘জ্বি, আমিই।

একটু বসুন, আমি এক্ষুনি আসছি।’ বসার ঘরটা দেখিয়ে দিলেন। কোনকিছুই আমার ধারণাকে সমর্থন করছে না। টেলিফোনে ভদ্রলোকের ভড়াট গলার কথা শুনেছি এবং সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলেন, যে করনে ধরে নিয়েছিলাম তিনি একজন বড়সড় ভারিক্কি ধরনের মানুষ হবেন। কিছুটা কেতাদুরস্ত্‌  হবেন এরকম ধারনাও হয়েছিল। কিন্তু তিনি সেরকম কেউ নন। সাধারণ গড়ন, কেশকুল বিদায় নেয়া শুরু করেছে অনেক আগেই, গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম। লাগোয়া দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে কিছুই বুঝতে না পেরে ক্ষণিকের তরে দ্বিধা হয়ে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম। সবকিছুই অবিন্যস্ত।  মেঝের উপর বিছানা পাতা, তার চারিদিকেই বালিশ সাজানো। অপরিস্কার না হলেও পরিস্কার বলা যায় না।   দেয়ালে তেল চিটে দাগ বসে গেছে। ওটা দেখে বুঝা যায় বিছানায়  বসেই সব কথা হয়। এখানে শুধু বসাই হয় না ঘুমানোও হয় বুঝার উপায় নেই। এক কোণে ছোট্ট স্টুলের ওপর ১৪ ইঞ্চি সাইজের টেলিভিশন, তার পাশে মেঝের উপর দাঁড়িয়ে আছে একটা টেবিল ফ্যান যার টেবিলের উপর থাকারই কথা ছিল। ঘরের দেয়াল ঘেঁষে মেঝের উপর থরে থরে সাজানো অনেকগুলো সিডি’র পাউচ্‌!!। তার পাশে কিছু বই সাজানো, তার মাঝে একটা ইংরেজী অভিধান উঁকি দিচ্ছে। একটা কবিতার বইও দেখতে পেলাম।  বাকিগুলো বুঝা যাচ্ছে না।

যা আছে সবই ছড়িয়ে ছিটিয়ে মেঝের উপর। কেবল একটা বৈদ্যুতিক পাখা ঘুড়ছে উপরে সিলিং-এ।  কোন টেবিল-চেয়ার নেই। ঘরটা তেমন বড়ও নয়, দশ বাই দশ ফুট হবে। একটা অন্যরকম গন্ধ নাকে এলো। মৃদু একটা সুগন্ধি আর পুরনো বাড়ীর গন্ধের মিশেল। ঢাকা শহরে পুরনো এলাকার অনেক বাড়ীতে এই রকম গন্ধ পাওয়া যায়। গন্ধটা নাকে লাগতেই আমার পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল। অনেক আগে আমার চাচা  যখন বংশালে থাকতেন তখন মাঝে মাঝে মফস্বল থেকে বেড়াতে এসে চাচার বাড়ীতে উঠতাম। বিশাল দোতলা দালান বাড়ি, থাকতাম নীচ তলায়। তখন পুরনো দালানের এই গন্ধটা খুব নাকে লাগতো।

ভদ্রলোক একটু পরই ঘরে প্রবেশ করলেন। আমি দাঁড়িয়ে আছি দেখে বসতে বললেন। ঘরে যেহেতু একটি চেয়ারও নেই, সুতরাং তার বসার অনুরোধে বুঝতে পারলাম মেঝের উপর বিছানাতেই বসতে হবে এবং বসলাম। আমার অবস্থা দেখেই হয়তো তিনি শংকিত হয়ে বললেন, নীচে বসতে অসুবিধা নেই তো!

আমি বললাম, না না, অসুবিধা কি।
তিনি বললেন, না, অনেকেরই হাঁটুতে সমস্যা থাকে।
তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু আমার কোন অসুবিধা নেই। আমি বললাম।
তারপর বলুন কেমন আছেন?
আমি বললাম, ভাল। আপনি কেমন আছেন?
হ্যা, খারাপ না। ভালই আছি, চলে যাচ্ছে। তার মোটামুটি আয়েশি জবাব।
আমি কেন যেন একটা রহস্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না।

কেন তার এই ছন্নছাড়া আয়োজন! যেন মনে হয় অস্থায়ী ব্যবস্থা, হয়তো বাসা বদল করছেন। এই রকম একটা পরিবেশের জন্য আমি আসলে এক রকম অস্বস্তি বোধ করছিলাম। এই অবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্য আমি সরাসরি বলেই ফেললাম, আপনার ঘরের এই অবস্থা কি অস্থায়ী কিছু, নাকি এরকমই!

না না, যা দেখছেন এই রকমই। এখানেই বসা, এখানেই ঘুমানো।
এতে আমার রহস্যের কিছুটা সুরাহা হলেও প্রশ্ন তো রয়েই গেল। বললাম, কিন্তু আপনার পরিবার?
তিনি বললেন, বিয়েই করিনি তো পরিবার কোথা থেকে আসবে।
আমার যা ধারনা হচ্ছিল তাই ঘটে গেল। একজন ঘরবাঁধা মানুষের বসার ঘর এরকম হতে পারে না।
তিনি পঞ্চাশ ছুঁয়েছেন মনে হচ্ছে। সুতরাং ঘরবাঁধার আর সম্ভাবনা নেই ধরে নেয়া যায়।
তিনিই আবার বললেন, আমার কথা ছাড়ুন। আপনাকে তো আরও আগেই আসতে বলেছিলাম, এলেন না যে?

এই গণক সাহেবের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছিল ইমেইলের মাধ্যমে। আমি খোজ পেয়ে তাকে ইমেইল করেছিলাম বিস্তারিত লিখে কিছু পরামর্শের জন্য। কোন জ্যোতিষবিদ বা গণক আমার ভাগ্য বদলে দিতে পারেন এটা আমি খুব একটা বিশ্বাস করি না। তবে এই ভদ্রলোক সম্পর্কে অন্যরকম শুনেছি যিনি নিজেও সৃষ্টিকর্তাকেই সবকিছুর উপরে রাখেন। আর তাই বলতে গেলে আমি আমার সমস্যাগুলো নিয়ে তার সঙ্গে শেয়ার করলাম বলা যায়। আমি বরং উল্টো প্রশ্ন করেছিলাম, বিধাতাই যেখানে আমার জন্য সবকিছু দেবেন বলে সাজিয়ে রেখেছেন, সেই তিনিই যখন আবার সবকিছু ফিরিয়ে নিলেন, তখন আপনি কি পারবেন তার কাছ থেকে সব ফিরিয়ে আনতে? আমার ইমেইল পেয়ে তিনি সংক্ষেপে সব জেনে দুঃখ প্রকাশ করে লিখেছিলেন  সময় করে যেন একদিন ফোন করি। আমি অফিস থেকে বেরিয়ে একদিন পাশের কফি শপে বসে ফোনে এই সব বলেছিলাম। ফোনেও যখন সবকিছু বলা যাচ্ছিল না, তখন তিনি দেখা করতে বললেন। আমি আদৌ দেখা করবো কি না, অথবা তেমন একটা প্রয়োজন আছে কি না, এই সব ভাবতে ভাবতেই তিন মাস পার হয়ে গেছে। একদিন মনে হলো একবার ওর সঙ্গে দেখা করি। বলেছিলেন যেহেতু। কিছু না হলেও  অন্তত: মনটা তো হাল্‌কা হতে পারে! আর তাই শহরের জ্যাম-জট্‌ পেরিয়ে এখানে আসা।

আমি বললাম, একবার ভেবেছিলাম চলে আসি। পরে ভাবলাম এসে কি হবে। একেবারে খারাপ তো নেই। চলে তো যাচ্ছে। যা হয়ে গেছে তাকে বিধির বিধান মেনে নিয়ে বাকি জীবন যুদ্ধ করে যাওয়াই কি ভাল নয়। উপরে যিনি আছেন তিনি তো আমাকে ছেড়ে-ছুঁড়ে দেন নি।

তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার দৃঢ়তা খুব বেশী হয়ে যাচ্ছে কি না এই ভেবে একটু নরম হয়ে বললাম, তবে একটা ভয় আছে। এখন যেমন আছি এর বাইরে যেন ছিট্‌কে না পড়ি।

আমার কথা শেষ না হতেই তিনি বললেন, ভয় নেই। আপনি ছিট্‌কে পড়বেন না। এই বলে তিনি তার নোট বইটা টেনে নিয়ে কি সব লেখালেখি শুরু করে দিলেন। আমি চুপ থাকলাম। শেষ করে বললেন, আপনার সবকিছুই ধীরে হয়। যা হয়নি, তা হয়তো ঘুরে ফিরে আবার হতেও পারে। আপনাকে একটা পাথর দেবো পড়তে, অবশ্য আপনি যদি চান। তবে পাথরে সবকিছু ঘটিয়ে দেবে এমন নয়, তবে বাধাগুলো সরিয়ে দেবে।

আমি বললাম, একটা পাথর কি করে আমার ঘটমান কাজের উপর প্রভাব ফেলবে এটা বুঝতে পারি না।

তিনি বললেন, দেখুন আল্লাহ্‌ তা’লার কোন সৃষ্টিই অর্থহীন নয়। ভাল এবং মন্দ এই দু’টো বিষয়কে সামনে রেখেই তিনি পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। আমরা দিব্য চোখে যা কিছু দেখি, তার বাইরেও অন্তরে ভিতরে কতকিছু আছে। একই বস্তু, হরেক রকমের। আমাদের চোখের সামনে কত পাথর দেখতে পাই, কিন্তু কত বিচিত্র রং-বেরং-এর পাথরও তো আছে। কিন্তু কেন? ওগুলো তো আমরা সহজেই দেখতে পাই না, আহরন করতে হয়। শুধু সৌন্দর্যই নয়, আরো আছে অনেক কিছু। সবই রং-এর খেলা।

তিনি প্রশ্ন করলেন, আপনি কি মনে করেন না কোন এক নির্দিষ্ট রং-এর পোশাক আপনাকে প্রফুল্ল করে?
কি জানি। হয়তো বা ঠিক বলেছেন।কোন কোন দিন তো পোশাকের কারনে নিজেকে একবারেই ন্যাতানো মনে হয়।
আমি আসলে বারবার অমনোযিগী হয়ে পড়ছিলাম। সবকিছু দেখে আমার মাথায় কি সব ঘুরপাক খাচ্ছে।
আমি বললাম, ঠিকই বলেছেন হয়তো। আচ্ছা, আমি কি দু’একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারি?
নিশ্চয়ই পারেন।

আপনার কাছে আসার আগে এরকমটাই ছিল যে আপনার কাছ থেকে কিছু পরামর্শ নেবো। কিন্তু আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর ব্যাপারটা একটু অন্যরকম হয়ে গেছে। আপনার উপর আমার কৌতুহল বেড়ে গেছে। আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার যদিও, তবু জানতে ইচ্ছে করছে, আপনি বিয়েটা করলেন না কেন?

একটু চুপ থেকে বললেন, আমি কিন্তু আমার কথা কাউকে বলি না। কেন যেন আপনাকে বলছি। আমার বয়স যখন বত্রিশ তখন আমার সিভিয়ার হার্ট  অ্যাটাক হয়।

আমি অবাক হয়ে অস্ফুট স্বরে বললাম, বত্রিশ বছরে!

জ্বি, অবাক হওয়ারই কথা। সেবার বেঁচে যাই, কিন্তু চরম সাবধানতার কারনে জীবনটা সীমিত হয়ে পড়ে। এরপর বছর পাঁচেক আগে আবার। এখন রিং পড়ে বেঁচে আছি। আমাকে দেখে কি মনে হয় আমি হার্টের রোগী?

আমি মাথা নাড়লাম, নাঃ, একেবারেই না।

তিনি আবার বলা শুরু করলেন, বত্রিশের পর সীমিত জীবন-যাপনের সঙ্গে কাউকে জড়াবো কি না এই নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হলো যেমন আমার মধ্যে, তেমনি পরিবারের ভেতর। এভাবেই সময় চলে গেছে। আর হয়ে ওঠেনি।

আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে আছি। কথা বলতে বলতে আমাদের মাঝে দূরত্বটা কমে গেছে বুঝতে পারছিলাম।

আমি বললাম, হৃদয়ঘটিত ব্যাপারই বটে!

তিনি হো হো করে এসে উঠলেন। ভারি গলায় গমগম করে উঠলো ঘরটা। বললেন, সত্যিই তো! এযে হৃদয়ঘটিত ব্যাপার। এভাবে তো দেখিনি ব্যপারটা! হৃদয়ের গায়ে অলঙ্কার পড়িয়ে সংসার পারাপার।

শেষের পঙতিটা স্বগোক্তি মনে হলো।

আমি বললাম, আপনার জীবনের জন্য সংখ্যাত্বত্তে হিসাব করে দখেন নি? বিয়ে-শাদি, সংসারকর্ম এইসব ব্যাপারে?

নাঃ, ইচ্ছে করেই করিনি। উপরওয়ালার উপর ছেড়ে দেয়েছি।

কেমন করে কাটিয়ে দিচ্ছেন! নিঃসঙ্গ মনে হয় না?

ইয়েস্‌, আ সিংগেল লাইফ ইজ ক্রিটিক্যাল ইনডিড্‌। তবুও মেনে নিতে হয়। ঐ যে বললাম পৃথিবীর সবকিছুই যেমন একরকম নয়, জীবনটাও। ব্যতিক্রম থাকে।

এমন সময় ওর মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো।

হ্যালো, কে বলছেন…?

জ্বি? বুঝতে পারছিনা…!

কি ব্যাপার বলুন…? ও আচ্ছা…আপনি আমাকে আধা ঘন্টা পর ফোন করতে পারেন? আমি এখন ক্লায়েন্টের সঙ্গে মিটিং-এ আছি…জ্বি? না না, আমি যদি আপনার সমস্যার সমাধান ফোনেই সেরে ফেলতে পারি, তা’হলে তো আর দেখা করবার প্রয়োজন নেই।…আচ্ছা ধন্যবাদ, ভাল থাকুন।

ফোন কেটে দেওয়ার পর আমি বললাম, ডাক্তার-কবিরাজ-জ্যোতিষী যাই বলুন, সবাই চায় ক্লায়েন্ট সশরিরে ভিজিট করুক, তা’হলে ফি থাকবে, চিকিৎসা থাকবে। আর আপনি সেধে সেধেই ফোনে সেরে ফেলতে চাইছেন? তো এইসব পরামর্শের জন্য ফি নেবেন না?

তিনি বললেন, না। আমি ওভাবে ব্যাপরাটাকে দেখিনা কখনো। আমার যা বিদ্যা তা দিয়ে মানুষের সেবা করতেই ভাল লাগে। তা’ছাড়া অনেকেই আছে, যাদের সমস্যা ঘোরতর কিছু নয়,আবার নৈতিকতার দিক দিয়েও সঠিক নয়। তাদেরকে আমি আমি ফোনেই সেরে ফেলি, নয়তো ভাল না লাগলে বিরত থাকতে পরামর্শ দেই। তবে যারা সত্যিকার অর্থে সমস্যায় আছে তাদের বলি দেখা করতে। ডিটেইল শুনি, চিকিৎসা দেই।

তা’হলে কি এটা আপনার প্রফেশান নয়। আর কি করেন তবে?

কিছুই না। আমি কিন্তু এল,এল,বি পাশ। কিছুদিন কোর্টে গিয়েছি, ভাল লাগেনি। তারও আগে এনজিওতে চাকরি করেছি, চাকরি করতে করতেই এই পোকাটা মাথায় ঢুকে যায়। তারপর সব ছেড়েছুঁড়ে এই নিয়ে আছি।

এভাবে আপনার চলে কি করে! একজন মানুষ হলেও তো বেশ খরচ!

ঠিক বলেছেন। তবে মাথাগুঁজার ঠাই হলে বাকি তেমন আর কিছু লাগে না। জুগিয়ে নেয়া যায়। এই বাসাটা আমাদের পৈত্রিক সম্পত্তি। এখন উঁচু দালান উঠেছে। উপরে আমার দু’ভাই থাকে। আমি নিচের এই দু’টো কামড়া নিয়েছি। ব্যস্‌, আর কি? সারাদিন বাইরে বাইরে থাকি। কাজ থাকলে তা সেরে নিই। না’হলে ঘুরি-ফিরি, মানুষ দেখি, জীবন দেখি, জীবনের ভিতরটা খুঁড়তে চেষ্টা করি। আসলে কি জানেন, জীবনের জন্য খুব বেশী কিছু প্রয়োজন হয় না যদি প্রয়োজনগুলোকে প্রশ্রয় না দেন।

তিনি থামলেন। আমি চেয়ে রইলাম। মাগরিবের আযান হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন আমি নামায পড়বো কিনা। মাথা নাড়লে তিনি অযুর জন্য ওয়াশরুম দেখিয়ে দিলেন। ফিরে এসে দেখি তিনি বিছানার উপর জায়নাজ আর টুপি বিছিয়ে রেখেছেন। আমি নামাজ পড়লাম। তিনি পড়লেন না, পাশের কামড়ায় বসে অপেক্ষে করলেন। নামাজ শেষে তিনি জোর করেই কিছু খাবার এনে খাওয়ালেন। খালি মুখে চলে যাওয়াটা তিনি মেনে নিতে পারলেন না।

এবার বিদায় নেবার পালা। আমি শুধু আমার কথাই বলতে এসেছিলাম, কিন্তু একজন অন্যরকম মানুষের কাছ থেকে শুনে গেলাম অনেক কিছু, জানলাম অদেখার কথা। বাইরে অন্ধকার হয়ে গেছে। গলির কোনে আলো জ্বলছে টিম্‌টিম্‌ করে। হাল্‌কা বৃষ্টি এখনো পড়ছে দু’চার ফোঁটা করে, আয়েসী বৃষ্টি। ভেজা চারিদিক। এমনিতেই আমি কিছুটা সম্মোহিত যেন, তার উপর সবকিছু কেমন বিমূর্ত হয়ে আছে!

তিনি গেইট পর্যন্ত এগিয়ে এলেন বৃষ্টির ফোঁটা উপেক্ষা করে। হাত মেলালাম। বললেন, ভাল থাকবেন। এই কথাটা তিনি ফোন রাখবার সময়ও বলে থাকেন। একজন অসম্ভব সাদাসিধে শিষ্ট মানুষ।

আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি এখন রাস্তার জনারন্যের ভিতর দিয়ে ছুটে চলবে। আমি সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজলাম। গভীর থেকে গভীরে কি যেন কি খুঁজতে চাইলাম!