প্রত্যেক নারীই বিবাহিত জীবনের শুরুতেই মনের গহিনে একটা স্বপ্ন বুনতে থাকে। আর তা হলো একদিন সে মা হবে। ভূমিষ্ঠ শিশুর মুখে কবে প্রথম মা ডাক শুনবে! কিন্তু তার জন্যও প্রয়োজন যথার্থ স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ একটি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা। পৃথিবীতে আসার আগ পর্যন্ত সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত একটি প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে গর্ভেই যার অবস্থান। যে ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে একজন নারী গর্ভবতী হওয়ার পর দশ মাস দশ দিন তার জঠরে ধীরে ধীরে একটি শিশুর অস্তিত্ব বেড়ে ওঠে। সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সময়ে একজন প্রসব সহায়তাকারীর মাধ্যমে ভূমিষ্ঠ হয় বহু প্রত্যাশার নাড়িছেঁড়া ধন। কিন্তু যেখানে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুসহ মাকে নিয়ে গোটা পরিবার খুশির জোয়ারে ভাসার কথা, অনেক ক্ষেত্রেই সেখানে সুখকে নির্বাসনে পাঠিয়ে শুরু হয় কান্নার রোল। স্বজন হারানোর ব্যথায় হাহাকার করে পরিবারগুলোতে।

ma

ভাবতেও কষ্ট হয় শুধু সচেতনতার অভাবে এখনও অনেক মাকেই সন্তান প্রসব করতে গিয়ে নিজের প্রাণটিকেই বিসর্জন দিতে হয়। তবে এ ক্ষেত্রে একজন নারী যদি গর্ভবতী হওয়ার পর থেকে একজন দক্ষ সেবাদানকারী দ্বারা হাসপাতালে বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চেকআপগুলো করেন, তাহলেও ওই নারীর গর্ভকালীন জটিলতা অনেকাংশে নির্ণয় করার পাশাপাশি সমস্যা সমাধানে অগ্রিম প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয়। কিন্তু প্রতিবন্ধকতা সেখানেও বিরাজমান। প্রথমত, সামাজিক কুসংস্কারাচ্ছন্ন বদ্ধমূল ধারণা; দ্বিতীয়ত, গর্ভকালীন সময়ে গর্ভবতীর খাদ্যে অপুষ্টি ও শারীরিক অযত্ন; তৃতীয়ত, প্রসূতিবান্ধব প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অভাব।

মা ও শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ে কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী, করিমগঞ্জ, পাকুন্দিয়া, ইটনা, বাজিতপুর, অষ্টগ্রাম উপজেলায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীনে অসুস্থ শিশুর সমন্বিত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা (আইএমসিআই) কর্মসূচির মা ও শিশু স্বাস্থ্য সুরক্ষা (এমএনসিএস) প্রকল্পের আওতায় কমিউনিটি পর্যায়ে মা ও শিশু স্বাস্থ্য সমস্যায় তাদের সেবা কেন্দ্রমুখী করা ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে সেবা গ্রহণের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি করা হচ্ছে। বাড়িতে প্রসবের ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ ধাত্রীর সেবা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি বাড়িতে প্রসবের চেয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসব করানোর জন্য অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে। কারণ তাদের আশ্বস্ত করা হয়, সেবাকেন্দ্রে এলে মা ও সন্তানের স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমে ও নিরাপত্তা বাড়ে এবং সেবার মান ভালো হয়। কিন্তু যে পরিমাণে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করানো হচ্ছে, সে অনুযায়ী সরকারিভাবে প্রদত্ত প্রসূতিসেবার মান খুবই নগণ্য ও হতাশাব্যঞ্জক। এর মধ্যে অধিকাংশ আর্থিকভাবে সচ্ছল সচেতন পরিবার ও নারীই নিরাপদ প্রসবের জন্য জেলায় অবস্থিত বেসরকারি ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো থেকে উচ্চমূল্যে প্রসূতিসেবাই বেছে নিচ্ছেন। কিন্তু উপজেলাগুলোর প্রত্যন্ত গ্রামের প্রসূতি নারীরা এখনও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গ্রাম্য হাতুড়ে চিকিৎসক ও প্রশিক্ষণবিহীন ধাত্রীর দ্বারস্থ হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ প্রসব সেবা নিচ্ছেন।

কিশোরগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র অনুযায়ী, ২০১১ সালে কিশোরগঞ্জ জেলায় প্রসবকালীন জটিলতায় বা প্রসব-পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ৮৯টি মাতৃমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। ২০১০ সালে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান ৮৮ জন মা। তবে গর্ভবতী মা ও নবজাতকদের নিয়ে কিশোরগঞ্জে কাজ করে যে কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা তাদের কমিউনিটিভিত্তিক ডাটাবেজ প্রতিবেদনের সঙ্গে সরকারি মাতৃমৃত্যুর এই পরিসংখ্যানের যথেষ্ট পার্থক্য লক্ষণীয়। এ ছাড়া মা ও শিশুর মৃত্যুহার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কিশোরগঞ্জ সদর, করিমগঞ্জ, নিকলী, মিটামইন ও ভৈরবে জরুরি প্রসূতিসেবা (ইওসি কর্মসূচি) চালু হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। বর্তমানে কিশোরগঞ্জ ২৫০ শয্যার জেলা হাসপাতাল এবং ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেল্গক্স ছাড়া বাকি তিনটি হাসপাতালে এই সেবা কাগজপত্রে বহাল থাকলেও বাস্তবে অকার্যকর আছে।