sleep_paralisisমধ্যরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল, অনুভব করলেন আপনার বুকের উপর ভারী কিছু বসে আছে। এতটাই ভারী যে আপনার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আপনি চাইলেও আপনার শরীরের কোন অংশ নাড়াতেও পারছেন না এবার চিৎকারও করতে পারছেন না। এমন সময় ভয় পাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। এই সমস্যার নাম স্লিপ প্যারালাইসিস। সহজ বাংলায় একে বোবায় ধরা বলা হয়।  বোবায় ধরা বা স্লিপ প্যারালাইসিস একটি সম্পূর্ণ ইন্দ্রিয়জনিত ব্যাপার। শরীর যখন ঘুমের এক পরজায় থেকে আরেক পর্যায়ে যায়, তখনই এমনটা ঘটে থাকে। এমন সময় একেকজনের একেক রকম অভিজ্ঞতা হয়।

কেউ ঘরের ভেতর ভৌতিক কিছুর উপস্থিতি টের পান, কেউ দুর্গন্ধ পান, কেউ বা ভয়ানক কোনো প্রাণী দেখতে পান। সোজা কথায় এসময় হ্যালুসিনেশনের সৃষ্টি হয়। গভীর ঘুমের এক পরজায় থেকে আরেক পর্যায়ে যাবার সময় হঠাৎ সতর্ক হয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেলেও, শরীর আসলে তখন ঘুমিয়েই থাকে। ফলে অভিজ্ঞতাটা অন্যরকম হয়। যেহেতু ইন্দ্রিয় তখন আচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে, তাই অদ্ভুত কিছু দেখে শ্বাসকষ্টের অনুভব করে। সাধারনত যাদের ঘুমের সমস্যা থাকে তারাই এই স্লিপ প্যারালাইসিসে ভুগে থাকে।  অনেকেই মনে করেন অলৌকিক কিছু এই অবস্থার সৃষ্টি করে।  কিন্তু আসলে এটি সম্পূর্ণই শারীরবৃত্তীয় একটি ব্যপার।

কী ধরনের অভিজ্ঞতা হতে পারে এবং কেন?
১৯৯৯ সালে স্লিপ প্যারালাইসিস নিয়ে এক গবেষণায় দেখা যায়, স্লিপ প্যারালাইসিসের কারণে মানুষের তিন ধরনের ভ্রম হতে পারে।

প্রথমত, মানুষ বুকে এক ধরনের চাপ অনুভব করে। শ্বাস নিতে না পারার অনুভূতি তৈরি হয়। গবেষকদের মতে, শ্বাস-প্রশ্বাস মূলত মানুষের অভিব্যক্তির উপর নির্ভর করে। মানুষ যখন ভয় পায় এবং চোখের গতিবিধি বেড়ে যায়, তখন তাদের শ্বাসের গভীরতা কমে যায় এবং শ্বাসপথ সরু হয়ে পড়ে। আর তখন মানুষের যতটুকু অক্সিজেন দরকার তার পুরোপুরি সে গ্রহণ করতে পারে না।

দ্বিতীয়ত, এক ধরনের সচেতন উপস্থিতি, আতঙ্ক এবং দৃশ্যমান হ্যালুসিনেশন হতে পারে। স্লিপ প্যারালাইসিসের সময় মস্তিষ্কে এক ধরনের উদ্দীপনা তৈরি হয় যা থেকে আতংক কিংবা হুমকি অনুভূত হয়। আর সেসময় অনেকের মুখ দিয়ে ভীতিকর শব্দ উৎপন্ন হতে পারে।

তৃতীয় ধরনের অনুভূতিটি খুবই সাধারণ। এক্ষেত্রে মানুষ নিজেকে শরীর থেকে আলাদা বলে মনে করে। মানুষের মধ্যে এমন এক ধরনের অনুভূতি হয় যেন সে শয়নকক্ষের ভেতরে উড়ে বেড়াচ্ছে। গবেষকদের মতে, ব্রেনস্টেম এবং কর্টিক্যাল ভেস্টিবুলারের সক্রিয়তার কারণে এ ধরনের অনুভূতি হতে পারে।

কেন শরীরকে নড়ানো যায় না?
মানুষ যখন ঘুম আর জাগ্রত অবস্থার মাঝামাঝি পর্যায়ে অবস্থান করে এবং সেসময় স্বপ্ন দেখা থেকে নিজেকে দূরে সরাতে চায় তখনই মানুষের ঘুম ভেঙে যায়। মানুষ তখন শরীরকে নড়াচড়া করার জন্য ছটফট করতে থাকে। যারা স্বাভাবিক থাকেন তারা নড়াচড়া করতে পারেন। কিন্তু যাদের মলিকিউলার ক্লকে অকার্যকারিতা থাকে তাদের সেসময় স্লিপ প্যারালাইসিস হয়ে থাকে। অর্থাৎ জেগে ওঠার পরও সেসব মানুষ তার ঘুমন্ত অবস্থায় থেকে যায়। আর এ পর্যায়টি কয়েক সেকেন্ড থেকে শুরু করে ১০- ১৫ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

ছায়াটি আসলে কী?
তবে তখন যে ছায়াটি মানুষ দেখতে পায় তা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কোন ব্যাখ্যা দিতে পারেননি গবেষকরা। ইউসি সান দিয়েগোর গবেষকদের মতে, মস্তিষ্কে নিজের সঙ্গে কথোপকথনই ওই ছায়ারূপে হাজির হয়। তাদের মতে, মস্তিষ্কের নিউরনগুলো শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে নড়াচড়া করতে বলে। কিন্তু শরীর যখন নিউরনের সে নির্দেশ মানতে পারে না তখন ওই ছায়ার অনুভূতি হয়।
আবার কোন কোন গবেষকের মতে, মানুষের মস্তিষ্কে অ্যামিগডালা নামে আতঙ্ক তৈরিকারী যে অংশটি থাকে তার অতিরিক্ত সক্রিয়তার কারণে এ ধরনের ছায়া দেখা যেতে পারে। তাদের মতে ঘুমের মধ্যে মানুষের অ্যামিগডালা যখন অতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে তখন মানুষ আতঙ্কিত হয়ে জেগে যায়। মস্তিষ্ক তখন এ আতঙ্কের কারণ নির্ধারণ করার চেষ্টা করে। আর সেসময় ছায়া অনুভূত হতে পারে।

প্রচলিত মিথ ও সংস্কৃতিতে প্রভাব
স্লিপ প্যারালাইসিসজনিত অনুভূতি নিয়ে প্রচলিত মিথ প্রভাব ফেলেছে সংস্কৃতিতেও। বিভিন্ন ডকুমেন্টারি, মুভ্যি এমনকি চিত্রকলায়ও ধরা পড়েছে সে হ্যালুসিনেশন। যেমন- ডেভিল ইন দ্য রুম ডকুমেন্টারিতে স্লিপ প্যারালাইসিসের বিভিন্ন মিথ ধরা পড়েছে। এমনকি ১৭৮১ সালে হেনরি ফুসেলির আঁকা তৈলচিত্র ‘নাইটমেয়ার’-এও পাওয়া যায় স্লিপ প্যারালাইসিসের ব্যাখ্যা।
গবেষকদের মতে সমাজ, সংস্কৃতি আর পরিবেশ ভেদে মানুষ ভিন্ন ভিন্ন জিনিসের উপস্থিতি অনুভব করতে পারে। যেমন- কারো কাছে ভূতের অস্তিত্ব অনুভূত হলেও আধুনিক পাশ্চাত্য সংস্কৃতির লোকরা ওই ছায়াকে সিঁধেল চোর, ধর্ষক কিংবা ভীন গ্রহের প্রাণী হিসেবে মনে করতে পারে।

প্রতিরোধ ও প্রতিকার
স্লিপ প্যারালাইসিস বংশগত হওয়ার কারণে যেকেউই এ ধরনের অসুস্থতায় আক্রান্ত হতে পারে। কম ঘুম, ঘুমের বিঘ্নতা, কর্মক্ষেত্রে শিফট সিস্টেম ইত্যাদির কারণে অনেক সময় স্লিপ প্যারালাইসিসের অনুভূতি বেশি হতে পারে। মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং বিষন্নতাও এক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। গবেষকদের মতে, বিষন্নতা দূর এবং পর্যাপ্ত ঘুমানোর পাশাপাশি আরও কয়েকটি কাজ মানুষ করতে পারে। তাদের মতে, যারা চিৎ হয়ে ঘুমান তাদের স্লিপ প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অন্যদের চেয়ে তিন থেকে চার গুণ বেশি। সেক্ষেত্রে এমন কোন পোশাক পরা যেতে পারে যেন চিৎ হলে পিঠে ব্যথা কিংবা অস্বস্তি হয়। এছাড়াও জেগে যাওয়ার পর যদি মনে হয় শরীর নড়াচড়া করা যাচ্ছে না, তখন সর্বশক্তি দিয়ে আঙ্গুল নাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। যখনই কোন পেশীকে নাড়ানো সম্ভব হবে তখন শরীরের নড়াচড়াও সম্ভব হবে বলেই বিশ্বাস গবেষকদের।  সূত্র: সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার ও ইন্টারনেট