হতদরিদ্র জেলে সম্প্রদায়ের আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৫২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ‘দি ময়মনসিংহ জেলা কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেড’। কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে অবস্থিত সেই সমিতি এখন জেলেদের পেট কাটছে (আয় রোজগারের পথে বাধা সৃষ্টি)।

kuliyarchar

স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে জেলেদের শতাধিক সমিতি ছিল। এসব সমিতির নামে বিভিন্ন জলমহাল ইজারা দেওয়া হতো। সমিতিগুলোর মধ্যে সমন্বয় এবং জেলেদের উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় সমিতি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ৬৩ বছর পর সেই সমিতি এখন প্রভাবশালী অমৎস্যজীবীরা কুক্ষিগত করে রেখেছে। কুলিয়ারচর বাজারে সমিতির ৫১ শতাংশ জায়গায় অবস্থিত বিশাল ভবন ও মার্কেটের আয় কয়েক নেতা ইচ্ছামতো ভাগ-বাটোয়ারা করে নিচ্ছেন।

অমৎস্যজীবীদের নিয়ন্ত্রণ : সমিতির নীতিমালা অনুযায়ী, প্রকৃত মৎস্যজীবী ছাড়া কেউ কেন্দ্রীয় সমিতির আওতাধীন প্রাথমিক সমিতির সদস্য হতে পারবে না। তিন বছর পরপর প্রাথমিক সমিতির সভ্যদের ভোটে কেন্দ্রীয় সমিতির নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে। কিন্তু এ নিয়ম মানা হচ্ছে না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমান সমিতির একজন কর্মকর্তাও মৎস্যজীবী নন। নিয়ম-নীতি না মেনে প্রায় ২০ বছর ধরে এসব অমৎস্যজীবী নেতা কেন্দ্রীয় সমিতির নেতৃত্বে আছেন। এসব দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত সমবায় বিভাগকে ম্যানেজ করে অনিয়ম চলছে।

কেন্দ্রীয় সমিতির বর্তমান সভাপতি মুকুল চন্দ্র দাস কাপড় ব্যবসায়ী। সাধারণ সম্পাদক সালুয়ার রবীন্দ্র কিশোর বর্মণ আগে জলমহালের ব্যবসা করতেন। সহসভাপতি আলীরচরের শিশু দাস মাছের আড়তদার। সাবেক সভাপতি ও কোষাধ্যক্ষ দেবেন্দ্র চন্দ্র দাস সাবেক সরকারি কর্মচারী। সাবেক সভাপতি ও বর্তমান সদস্য দাসপাড়ার রুহিনী কুমার দাস স্কুলশিক্ষক। সদস্য সুব্রত কুমার দাস সাবেক পৌর কাউন্সিলর। সাবেক সদস্য দাসপাড়ার ডা. মুকুল চৌধুরী কুলিয়ারচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার (সাকমো)। সাবেক সভাপতি আলীরচরের দেবেন্দ্র চন্দ্র দাস বর্তমানে কেন্দ্রীয় সমিতির কোষাধ্যক্ষ পদে চাকরি করছেন। বর্তমান সভাপতি মুকুল চন্দ্র দাস তাঁর ছেলে।

সম্পদ ও আয়-ব্যয় : সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, সমিতির কার্যালয়টির অবস্থান কুলিয়ারচর উপজেলা সদর বাজারে। ৫১ শতাংশ ভূমির মাঝামাঝি স্থানে সোসাইটির বিশাল একতলা দালানঘর। দালানের পেছনের দিকে ছোট্ট একটি কুঠুরি। এ ছাড়া অন্তত ১০টি কক্ষ। এসব কক্ষ এনজিও, হোমিও ফার্মেসি, রড-সিমেন্টের দোকান, মেস, উপজেলা প্রেসক্লাবসহ বিভিন্নজনের কাছে ভাড়া দেওয়া। সামনের অংশে সদর রাস্তা ধরে ১১টি পাকা দোকানঘর ও ভেতরে আরো দুটি কাঠের ফার্নিচার ও আইসক্রিম ফ্যাক্টরি ভাড়া দেওয়া। পেছনের কুঠুরিটি কেন্দ্রীয় সমিতির কার্যালয়। এখানে দুই-তিনটি কাঠের চেয়ার, একটি টেবিল ও একটি ভাঙা চৌকি ছাড়া আর কিছু নেই।

এলাকাবাসী ও অন্তর্ভুক্ত সমিতির কয়েকজন সদস্য জানান, এসব দোকারঘর থেকে সব মিলিয়ে প্রতি মাসে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা ভাড়া তোলা হয়। এ ছাড়া এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে জামানত হিসেবে অগ্রিম নেওয়া হয়েছে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা। মার্কেটের মামা-ভাগ্নে হোটেলের মালিক বেপারীপাড়ার বাচ্চু মিয়া জানান, তিনি জামানত দিয়েছেন এক লাখ টাকা। আর ভাড়া দিচ্ছেন দুই হাজার টাকা।

ভাগ-বাটোয়ারা : কেন্দ্রীয় সমিতির সামনের ১১টি দোকানঘর সম্পূর্ণ অনিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সমিতির কর্মকর্তাদের নামে বরাদ্দ দেওয়া বলে অভিযোগ রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, সভাপতির নামে বরাদ্দ আছে দুটি দোকান। তাঁর কোষাধ্যক্ষ বাবার নামে আছে আরো দুটি। এ ছাড়া প্রত্যেক সদস্যের নামে, এমনকি তাঁদের স্ত্রী-সন্তানের নামেও দোকান বরাদ্দ দেওয়া আছে। সাবেক সদস্য মুকুল চৌধুরীর স্ত্রী কুলিয়ারচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সিনিয়র নার্স পূরবী বিশ্বাসের নামে আগে দোকান বরাদ্দ ছিল। অভিযোগ রয়েছে, জামানতের টাকাও কথিত কর্মকর্তারা ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন। এ ছাড়া সাবেক সদস্য স্বপন কুমার দাস, বিমল চন্দ্র দাস ওরফে কাঠ বিমল, সুখলাল দাস ও বিষ্ণু দাস একটি করে দোকানের ‘মালিক’। প্রভাবশালীদের পক্ষে রাখার কৌশল হিসেবে শেষের চারজনকে দোকান বরাদ্দ দিয়ে রাখার তথ্য এলাকায় প্রচলিত।

সাধারণ সম্পাদক রবীন্দ্র কিশোর বর্মণ ও কোষাধ্যক্ষ কাম হিসাবরক্ষক দেবেন্দ্র চন্দ্র দাসের দেওয়া তথ্য মতে, সমিতির দোকানপাটের ভাড়া দিয়ে মামলার খরচ চলে। ভাড়ার আয় থেকে কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। প্রতি মাসে মূল ভবনসহ ১৬-১৭টি দোকানের ভাড়া আসে মোট ১৫ হাজার টাকা। তাঁরা জানান, কেন্দ্রীয় সমিতির সভাপতির সম্মানী ভাতা দুই হাজার টাকা, সাধারণ সম্পাদক নেন আড়াই হাজার। কোষাধ্যক্ষ পান দেড় হাজার টাকা। কার্যকরী কমিটির ছয় সদস্যকে দুই মাস পরপর ৬০০ করে টাকা দেওয়া হয়। এ ছাড়া আপ্যায়ন খরচ বছরে ১০ হাজার টাকা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে দেওয়া হয় এক হাজার। প্রতিবছর যাতায়াত খরচ হিসেবে ব্যয় হয় পাঁচ হাজার টাকা। বছরে ১২ হাজার টাকা আছে চা-পানের খরচ। সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ মোবাইল খরচ নেন বছরে ছয় হাজার টাকা। সাধারণ সভায় খরচ হয় ২০ হাজার টাকা। অডিট বাবদ খরচ হয় ১০ হাজার টাকা। ভূমি উন্নয়ন কর হিসেবে দিতে হয় চার হাজার টাকা। চারটি মামলা চালাতে প্রতি মাসে ১০ হাজার হিসাবে বছরে এক লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়। সে হিসাবে বছরে আয় আছে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা। এরা ব্যয়ের মোট হিসাব দেখান বছরে এক লাখ ৯৭ হাজার ৬০০ টাকা। তবে স্থানীয়দের ভাষ্য, সমিতির প্রকৃত আয় এ হিসাবের প্রায় দ্বিগুণ। যথারীতি ব্যয়ও দ্বিগুণ করা হয়। কেবল লুটপাটের উদ্দেশে খাতাপত্রে মনমতো আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলানো হয়। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে কোষাধ্যক্ষ দেবেন্দ্র চন্দ্র দাস খেপে গিয়ে বলেন, ‘কোন অধিকারে আপনি এসব জানতে চান? সমবায় অফিসারের অনুমতি ছাড়া তথ্য দেওয়া যাবে না।’

বেহাত হচ্ছে সম্পত্তি : প্রায় এক একর ৭৮ শতাংশ জমি রয়েছে সমিতির। এর মধ্যে এক একরের বেশি জায়গা কুলিয়ারচর বাজারে। এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় সমিতির সম্পদের পরিমাণ হবে এর দ্বিগুণের বেশি। বর্তমান সমিতির মূল ভবনের জায়গাটি ৫১ শতাংশের। এর মধ্যে ৯ শতাংশ জায়গা সাবেক সাধারণ সম্পাদক দেবেন্দ্র চন্দ্র দাস তারাকান্দির মাসুমের কাছে মাত্র সাড়ে চার লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন। উপজেলার কাপাসাটিয়ায় কেন্দ্রীয় সমিতির ২০ শতাংশ ভূমি এওয়াজ বদলমূলে একটি দলকে দিয়ে দেওয়া হয়। দাসপাড়ায় আরো সাড়ে ২৫ শতাংশ জায়গা বিক্রি করে দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের রাস্তার পূর্ব পাড়ে আরো ৯ শতাংশ জায়গা স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখল করে নেয়। কেন্দ্রীয় সমিতির বরফকলের ২০ শতাংশ জায়গা জাতীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির কাছে বিক্রি করা হয়। এ ছাড়া ১৯৭৫ সালের পর প্রেসক্লাব, অফিসার্স ক্লাব ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নামে তিন শতাংশ করে এবং একটি পাক্ষিক পত্রিকার নামে আট শতাংশ জায়গা ‘দান’ করে দেওয়া হয়। এসব নিয়ে বেশ কয়েকটি মামলা আদালতে চলমান।

কেন্দ্রীয় সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালুয়ার বাদল বর্মণ বলেন, ‘সমিতির কল্যাণের নামে কিছু ব্যক্তি এগিয়ে এসে যা ইচ্ছে তাই করছে।  নামে-বেনামে সমিতির জায়গা বিক্রি করা হচ্ছে।’

কেন্দ্রীয় সমিতির সভাপতি মুকুল চন্দ্র দাস বলেন, ‘আমি একটি কাপড়ের দোকানের কর্মচারী। কেন্দ্রীয় সমিতির আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসাব বলতে পারছি না।’ তবে আয়-ব্যয় ‘সমান-সমান’ দাবি করে তিনি তাঁর বাবা সমিতির কোষাধ্যক্ষ দেবেন্দ্র চন্দ্র দাসের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

জেলা সমবায় কর্মকর্তা আবু ইউসুফ মিয়া বলেন, ‘সাধারণ জেলেদের অভিযোগের সত্যতা রয়েছে।  কেন্দ্রীয় সমিতি এখন অমৎস্যজীবীদের দখলে।  সমবায় অধিদপ্তরের আইন শাখায় অমৎস্যজীবীদের নেতৃত্বের বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে।’