একটা স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাব সাম্প্রতিক কালের ঘটনা হলেও বাংলাদেশ একটি প্রাচীন সভ্যতার আবাসভূমি। সুপ্রাচীন কাল থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নরগোষ্ঠী বাংলাদেশে এসে বসবাস করতে শুরু করেছে। এই সকল নরগোষ্ঠী তাদের সঙ্গে নিয়ে এসেছে তাদের নিজস্ব বিচিত্র সাংস্কৃতিক উপাদান। এই সকল বহিরাগত উপাদান বা উপকরণের সঙ্গে বাংলার দেশজ উপাদানের সংমিশ্রন ও সমন্বয় সাধিত হয়েছে এবং এর ফলেই বাংলার সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটেছে ফুলে ফুলে।

খৃষ্টীয় আট শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত বাংলাদেশ ও তার নিকটবর্তী অঞ্চল প্রথমে মৌর্য এবং পরে গুপ্ত সাম্রাজ্যের  অধীনে ছিল। এই সময়কালে ঐ সমস্ত অঞ্চলে হিন্দুধর্মের প্রাধান্য ছিল। কিন্তু উত্তর ভারতকেন্দ্রিক আর্য বা হিন্দু শক্তি বাংলাদেশে বেশি  আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। খুব সম্ভব শশাঙ্ককে প্রথম বাঙালি বলা যায় যিনি সাত শতকের প্রথমদিকে বঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যার উপর আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হন। যদিও শশাঙ্ক ছিলেন হিন্দু এবং হিন্দু দেবতা শিবের উপাসক, তার সময়কালে রাজ্যের সর্বত্র বৌদ্ধ ধর্মের বেশ প্রসার ও প্রতিপত্তি ছিল। সাত শতকের মাঝামাঝি থেকে আট শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশে এক অরাজক অবস্থা বিরাজ করছিল।  পাল রাজত্বের প্রতিষ্ঠা এই অবস্থা অবসান ঘটায়। পাল রাজারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন এবং তাঁদের রাজত্বকাল প্রায় চার শ’ বছর স্থায়ী হয়; পাল আমলে বাংলার সংস্কৃতির অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছিল। অতীশ দীপঙ্কর ছিলেন সে যুগের বাঙলার মনীষার এক আশ্চর্য নিদর্শন। তার জন্ম হয়েছিল বিক্রমপুরের অন্তর্গত বজ্রলোমিনী গ্রামে। দশম পাল রাজা ন্যায় পালের সময় এই প্রখ্যাত ভিক্ষু এবং পণ্ডিত বর্মা (বর্তমান মায়ানমার), শ্রীলংকা, নেপাল এবং তিব্বত ভ্রমন করে বৌদ্ধ ধর্মের বানী প্রচার করেন। বার শতকের মাঝামাঝি পাল রাজত্বের অবসানের পর দক্ষিণ ভারত থেকে আগত সেন রাজবংশ বাংলাদেশের উপর আধিপত্য স্থাপন করে। সেন রাজারা ছিলেন নিষ্ঠাবান হিন্দু এবং এদেশে ব্রাহ্মণ ধর্মকে সুদূঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য উত্তরভারত থেকে বেশ কিছু সংখ্যক ব্রাহ্মণদের এনে তাদের বসতি স্থাপন করান। কিন্তু সনাতন হিন্দু ধর্ম বাংলাদেশে গভীরভাবে শেকড় গাড়তে পারেনি।

তের শতকের প্রথম দিকে মুসলিম বিজয়ের সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ধর্মমতে তান্ত্রিক বৌদ্ধ উপাদানের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। বস্তুত বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মের সামাজিক ভিত্তি কিছুটা দুর্বল ছিল বলেই তুর্কী সমরনায়ক ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর পক্ষে মুষ্টিমেয় সৈন্য নিয়ে অতি সহজে বাংলাদেশ জয় করা সম্ভব হয়েছিল।

অনেকের ধারণা বাংলাদেশে ইসলামের আগমনের সূচনা তের শতকের মুসলিম অভিযানের অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। চট্টগ্রাম, নোয়াখালি ও বাংলার সমুদ্র উপকুলীয় অঞ্চলে খৃষ্টীয় আট শতক থেকেই কিছু সংখ্যক আরব ব্যবসায়ী ও বনিকদের আনাগোনা ছিল বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। সে সময় কিছু আরব বসতিও স্থাপিত হয়ে থাকতে পারে ঐসব অঞ্চলে। ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে আরবদের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না।  তের শতকে মুসলিম বিজয়ের পর এ দেশে ইসলাম ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করে।  সমাজের, বিশেষ করে নিম্নবর্গের মানুষ রক্ষণশীল হিন্দুধর্মের জাতিভেদ প্রথা ও অন্যান্য অনুশাসনের উৎপীড়ন থেকে মুক্তি পাবার জন্য ইসলামের সহজ সরল বানী ও সামাজিক সাম্যের আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।  কিন্তু ধর্মান্তরিত হওয়ার ফলে এ দেশের মানুষ নিজস্ব দেশজ সংস্কৃতিকে বিসর্জন দেয়নি।

তের শতকের প্রথম দিক থেকে চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশ দিল্লী সালতানাতের অধীনে ছিল। চৌদ্দ শতের মাঝামাঝি নাগাদ আফগান (পাঠান) সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারব শাহ্ বাংলার প্রায় সমস্ত অঞ্চল জয় করে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং বাংলাদেশে স্বাধীন সুলতানী যুগের সূচনা করেন। বাংলার স্বাধীন সুলতান “শাহী বাঙ্গালা” উপাধী ধারণ করেন। পরবর্তী প্রায় দুশ বছর বাংলাদেশে স্বাধীন পাঠান সুলতানরা রাজত্ব করেন। এই সব পাঠান সুলতানরা বহিরাগত হলেও এ দেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। হুসেন শাহী আমলে বাংলার ভাবজগতে এক অভুতপূর্ব আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল।

একদিকে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের ফলে হিন্দু ভক্তিবাদ ও অন্যদিকে মুসলিম মরমী সুফী সাধকদের দ্বারা প্রচারিত আধ্যাত্মিক মানবতাবাদ বাংলার গোটা সমাজ জীবনকে উজ্জীবিত করে তুলেছিল। গোড়া পত্তন হয়েছিল এক নতুন সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতির যার নিদর্শন সমকালীন বাংলা সাহিত্যে পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যের উন্নতির জন্য এসেছিল স্বর্ণ যুগ। মুসলমান সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘মহাভারত’ ও ‘ভগবদ গীতা’ প্রথমবারের মত সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়। বস্তুত এই সময়কাল থেকেই বাঙালির জীবনে এই উদার সমন্বয়ধর্মী মানবতাবাদী ধারা প্রবাহিত হতে শুরু করেছিল যার পরিচয় পাওয়া যায় সে কালের কতিপয় হিন্দু মুসলমান কবিদের রচনায়।

“শুনহ মানুষ্ ভাই
সবার উপরে মানুষ সত্য,
তাহার উপরে নাই”

পনের শতকের বৈষ্ণ কবি চন্ডিদাসের এই অমর বানীতে যেমন আমরা মানবতাবাদের জয়গান শুনতে পাই তেমনি সতের শতকের মুসলিম কবি আবদুল হাকিম রচিত ‘নূরনামা’য় এক উদার সমন্বয়ধর্মী মতাদর্শের প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। হিন্দু-ধর্ম ও ইসলামের প্রতি সমানভাবে এই বাঙালি মুসলমান কবি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন এইভাবে:

“য়াল্লা(আল্লাহ) খোদা-গোঁসাই
সকল তান (তাঁর) নাম
সর্বগুনে নিরঞ্জন প্রভু গুনধাম।”

সতের শতকের প্রথম দিকে বাংলাদেশ মূঘল সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায় এবং ’সুবা বাঙ্গালা’ নামে পরিচিত হয়। আঠার শতকে মূঘল সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ার পর বাংলাদেশ আবার স্বাধীন রাজ্য হিসেবে আবির্ভূত হয়।

আঠার শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশক শাসন প্রতিষ্ঠার পর এদেশের মানুষ পাশ্চাত্য বা ইউরোপীয় সভ্যতার সংস্পর্শে আসে। ব্রিটিশ শাসন আমলে এদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী বিবর্তন সাধিত হয়। এই বিবর্তনের প্রতিফলন দেখা যায় এদেশের মানুষের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন চিন্তায় চেতনায়, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে এবং গোটা জীবন যাত্রায়। বস্তুত বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনটি ধারাকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্ণিত করা যায়: (১) প্রাচীন হিন্ধু-বৌদ্ধ ধারা; (২) ইসলামী ধারা এবং (৩) আধুনিক পাশ্চাত্য বা ইউরোপীয় ধারা। এই ত্রিধারার সমন্বয়ের ফলে আমাদের গোটা সংস্কৃতি বহুরূপে এবং বহুগুণে সমৃদ্ধ হয়েছে।

ব্রিটিশ আমলে নানাবিধ ঐতিহাসিক কারণে ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের মনে এই অলীক ধারণা বদ্ধমূল হয়েছিল যে এই উপমহাদেশের মুসলমানরা  এক অভিন্ন জাতি, এক স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। সুতরাং তাদের আশা আকাংখা এক স্বতন্ত্র মুসলেম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পূরণ হওয়া সম্ভব। অবশ্য এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে প্রতিবেশী হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রথা এবং সাধারণত হিন্দু ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণীর মধ্যে কিছুটা উন্মাসিক ও মুসলিম বিরোধী সাম্প্রদায়িক মনোভাব মুসলমানদের মধ্যেও বিচ্ছিন্নবাদী মনোভাব ও হিন্দু বিরোধী সাম্প্রদায়িকতা জাগ্রত করতে সাহায্য করেছিল।

ভারত উপমহাদেশের গোটা মুসলিম জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশী ছিল বাঙালি মুসলমান এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পেছনে তাদের অর্থাৎ বাঙালি মুসলমানদের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশী।

কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কিছুদিনের মধ্যেই বাঙালি মুসলমানরা পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হতে শুরু করল যখন তারা দেখল যে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী– যারা ছিল অধিকাংশই  অবাঙালি– তারা ধর্মের জিকির তুলে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ বাংলাদেশকে তাদের অবাধ শোষণের ক্ষেত্রে পরিণত করেছে। বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিকে উপলক্ষ করে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালু করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে বাঙালিরা মরীয়া হয়ে উঠল।  এভাবে শুরু হয়ে গেলো আমাদের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলনের ফলে জাগ্রত হল বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে এক নতুন ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয় চেতনা।  বস্তুত ইসলামী ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে এই বোধ জাগ্রত হতে শুরু করেছিল যে কেবলমাত্র ধর্মের উপর ভিত্তি করে বর্তমান যুগে কোন রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না।  তারা উপলব্ধি করতে লাগল যে বাঙালিরা মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ বা খৃষ্টান– তারা যেকোনো ধর্মাবলম্বী হোক না কেন তারা এক অভিন্ন জাতি এবং এক অভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী।  

এ কথাই মনীষী ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উচ্চারণ করেছিলেন ১৯৪৮ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির ভাষণ দিতে গিয়ে। তাঁর ভাষায় “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বেশী সত্য আমরা বাঙালি”। এই ঐতিহাসিক ঘোষণার মধ্যে  নিহিত ছিল বাঙালি জাতিসত্বার মর্মবাণী। পাকিস্তানের অবাঙালি শাষকগোষ্ঠি যখন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল তখন এদেশের জনগণ বিশেষ করে ছাত্র ও যুব সমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী ঢাকার রাজপথ লাল হল ভাষা শহিদদের রক্তে। এই ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলের বাঙালি জনগনের মধ্যে এক অভুতপূর্ব স্বদেশপ্রেম জাগ্রত হল। উন্মেষ ঘটল এক নতুন ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয় চেতনার। এই জাতীয়  চেতনা জাগ্রত করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫)-এর অবদান ছিল অসামান্য। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তুরের  গণঅভুত্থান এবং ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচন–এই সব ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জনগণের অবিসংবাদিত জাতীয় নেতা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে এই বাংলাদেশের সকল সম্প্রদায়ের মানুষ হিন্দু-মুসলমান বৌদ্ধ-খৃষ্টান প্রকৃত অর্থে এক ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতিতে পরিণত হয়েছিল যেটা আগে কখনও হয় নি। সেই অর্থে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বাঙালি জাতির জনক বলে অভিহিত করা যায়। তাঁর  বলিষ্ঠ নেতৃত্বে পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে যে অহিংস গনতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হয়েছিলো তার চুড়ান্ত পরিসমাপ্তি ঘটেছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এই মুক্তিযুদ্ধের ফলেই আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়েছে।

বাংলাদেশের মানুষের জীবন ধারা ও সংস্কৃতির মধ্যে এমন কতকগুলি দিক আছে যেগুলি আমাদের স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বাংলার মানুষকে ধর্মের বাহ্যিক আচার-বিচারের চেয়ে ধর্মে অন্তনিহিত মর্মবাণী বেশী আকৃষ্ট করেছে। তাই এদেশে সংকীর্ন সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা কখনও জনমনে দানা বাঁধতে পারে নি। উনিশ শতকের মরমী সাধক ফকির লালন শাহ-এর একটি গানে এই উদার মনোভাব চমৎকারভাবে প্রতিফলিত হয়েছে:

“সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে
লালন বলে জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে।”

বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে মৌলবাদী রক্ষণশীল মোল্লাদের প্রচারণার চেয়ে উদারমনা সুফী -দরবেশ, পীর-ফকির, আউল-বাউলদের অবদান এ দেশে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে অধিক কার্যকর হয়েছে। এই সব মরমী সাধক তাদের ব্যক্তিগত চারিত্রিক গুণাবলির জন্য সকল শ্রেনীর এবং সকল সম্প্রদায়ের জনগণের শ্রদ্ধাভাজন হয়েছিলেন। ধর্মীয়ক্ষেত্রে তাঁরা যে ঐতিহ্যের সূত্রপাত করেছিলেন সেটা ছিল আধ্যাত্মিক মানবতাবাদের ঐতিহ্য, পরমত সহিষ্ণুতার ঐতিহ্য, যেটা বাঙালির মন ও মানসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেও যে ধারাটি প্রাধান্য পেয়ে এসেছে সেটি সংঘাত বা বিরোধের ধারা নয়; সেটি হল বিভিন্ন মতবাদের শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের ধারা এবং সমন্বয়ের ধারা। উনিশ শতকের পশ্চাদমুখী ও প্রতিক্রিয়াশীল ওয়াহ্হাবী ও ফরায়জী আন্দোলন এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক জৌনপুরের মৌলানা কেরামত আলির অনুসারীদের হিন্দু-বিরোধী সাম্প্রদায়িক ও বিচ্ছিন্নবাদী প্রচারণা এবং বিশ শতক ও বর্তমান সময়কালের ধর্মীয় মৌলবাদ ও হিংসাত্মক জঙ্গীবাদ এবং রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক বাঙালির চিরন্তন উদার মানবতাবাদী সংস্কৃতিকে একেবারে নির্মূল করতে পারেনি। বাঙালির এই সুমহান সাংস্কৃতিক ঐহিহ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধারক ছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) যাঁকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে। নজরুলের বিদ্রোহ ছিল সকল প্রকার অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতা বিরুদ্ধে, সকল প্রকার অবিচার, শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তাঁর একটি কবিতায় সর্বজনীন মানবতাবাদের জয়ধ্বনি সুন্দরভাবে প্রতিধ্বনিত হয়েছে।

“গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে
সব বাধা ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম ক্রীশ্চান
গাহি সাম্যের গান।”

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের উদার মানবতাবাদী এই অনবদ্য কবিতায় বাংলার ঐতিহ্যের মর্মবাণী নিহিত রয়েছে।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে উনিশ ও বিশ শতকের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের পূর্বে কেবল বাংলাদেশে নয়, সমগ্র ভারত উপমহাদেশে ধর্ম নিয়ে সাম্প্রদায়িক বিরোধের কোন নজির দেখা যায় না। সাম্প্রদায়িক বিরোধ বা ধর্ম নিয়ে হিংসাত্মক দাঙ্গা হাঙ্গামা বা হানাহানি নানাবিধ ঐতিহাসিক কারণে বিশেষ করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে ব্রিটিশ আমলের সৃষ্টি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের মধ্যদিয়ে আমরা যেন আমাদের আবহমান মানবতাবাদী ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি।

সালাহউদ্দীন আহমদ

সালাহউদ্দীন আহমদ


সালাহউদ্দীন আহমদ
অধ্যাপক, গবেষক ও লেখক

প্রথম প্রকাশ –
মে ২৮, ২০১১/ বিডিনিউজ২৪ডটকম