230px-Kayser-Fleischer_ringউইলসন’স ডিজিজ। এটি এমন একটি জেনেটিক তথা বংশগত রোগ যাতে মানুষের লিভার এবং কখনও কখনও ব্রেইনের একটি অংশে (ব্যাসাল গ্যাংলিয়া) অতিরিক্ত কপার জমা হওয়ার কারণে আক্রান্ত হয়। কপার একটি ধাতব পদার্থ। যার মেটাবলিজম একমাত্র লিভারই করে থাকে। সুস্থ্য শরীরে কপার মেটাবলিজম-এর পর বিলিয়ারী পথ দিয়ে নি:সরিত হয়। উইলসনস ডিজিজ-এ এই নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়া ব্যহত হয়। ফলে লিভার ও শরীরের অন্যান্য অঙ্গে কপার জমা হয়। উপরোক্ত কাজটি মৌলিকভাবে নিয়ন্ত্রণকারী জিন ATP7B মানবদেহের ক্রোমোজম ১৩-তে অবস্থিত। উইলসনস ডিজিজ-এ উক্ত জিনে মিউটেশন হয়। ফলে লিভারের উক্ত কাজে ব্যাঘাত ঘটে এবং রক্তে মুক্ত কপারের পরিমাণ বেড়ে যায়। এই কপার মানুষের লিভার, ব্রেইনের ব্যাসাল গ্যাংলিয়া নামক জায়গায়, কিডনি, হাড় ইত্যাদি স্থানে জমে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করে। বিশেষ করে লিভার-এ কপার জমা হয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ সৃষ্টি করে ক্রনিক একটিভ হেপাটাইটিস করে, যার পরিণামে লিভার সিরোসিস করতে পারে। এছাড়া লিভারের প্রদাহ থেকে হেপাটিক ফেইলিউরও হতে পারে।

কিনিয়ার উইলসন সর্বপ্রথম উইলসনস ডিজিজ সম্পর্কে বর্ণনা করেন। তিনিই এটিকে জেনেটিক তথা বংশগত রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেন। মানবদেহে ২৩ জোড়া ক্রোমোসোম আছে। এর মধ্যে ২২ জোড়া ক্রোমোসোম দেহের গঠন নির্ধারণ করে। এদেরকে বলে অটোসোম। অন্য এক জোড়া ক্রোমোসম (xx বা xy) দেহের গঠনের পাশাপাশি লিঙ্গ নির্ধারণ করে। যাদেরকে বলে সেক্স ক্রোমোজম। উইলসনস ডিজিজ একটি অটোসোমাল রিসেসিভ রোগ। অর্থাত্, একজন ব্যক্তির দুটো ক্রোমজোমই উইলসনস ডিজিজের জিন বহন করলে এই রোগটি হয়। একটি ক্রোমোজোম আক্রান্ত থাকলে তাকে উইলসনস জিন-এর বাহক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেহেতু মা এবং বাবার একটি করে ক্রমোজম সন্তানে প্রবেশ করে, সেহেতু জন্মের সময় মা এবং বাবা দুজনই উইলসন জিনের বাহক হলে সন্তানে রোগটি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় এবং মা অথবা বাবা কেউ একজন এই রোগে আক্রান্ত হলে তাদের সন্তানদের মধ্যে উইলসন ডিজিজের বাহক হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। উইলসনস ডিজিজে আক্রান্ত রোগীর আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে অনুসন্ধান করলে একই রোগে আক্রান্ত অন্যান্য ব্যক্তিরও খোঁজ পাওয়া যায়।

উইলসন ডিজিজ পাশ্চাত্যের মানুষদের মধ্যে বেশী দেখা যায়। তবে আমাদের উপমহাদেশেও এই রোগের প্রাদুর্ভাব আছে। একটি গবেষণা অনুযায়ী পৃথিবীব্যাপী প্রতি ৩০০০০ প্রসূত জীবিত বাচ্চার মধ্যে ১ জন এই রোগে আক্রান্ত হয়। নারী ও পুরুষ সমান হারে আক্রান্ত হয়। উইলসনস ডিজিজের রোগীদের রোগের প্রকাশ হয় লিভার অথবা ব্রেইন প্রদাহের মাধ্যমে। রোগীরা বিভিন্ন ধরণের লক্ষণ প্রকাশ করতে পারে। ৩ থেকে ৬০ যে কোন বয়সে এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। তবে অধিকাংশ রোগীদের রোগ ধরা পরে বয়:সন্ধি কালে।

যাদের লিভার আক্রান্ত হয়, তাদের দীর্ঘমেয়াদী লিভার প্রদাহ (হেপাটাইটিস) হয়। ফলে, রোগীদের অনেকেরই জণ্ডিস লেগেই থাকে এবং ক্ষুধামন্দা, বমি বমি ভাব ও পেটে ব্যথা হয়। এই রোগীদের একটি অংশের প্রথমে মিটমিটে জ্লসি, শরীরের দূর্বলতা থাকে যা থেকে হঠাত্ অনেক বেশী জণ্ডিস, পেটে পানি আসা, জ্ঞান হারিয়ে ফেলা ইত্যাদি সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে। এ অবস্থাকে বলে লিভার ফেইলিউর। এছাড়াও, আরেকটি অংশ দীর্ঘমেয়াদী লিভার প্রদাহের কারণে লিভার সিরোসিস পর্যায়ে চলে যায়। লিভার সিরোসিস হলে রোগীর ক্ষুধামন্দা, পেটের সমস্যা, বদহজম ও পেট ফুলে যাওয়া জাতীয় লক্ষণ হয়। এদের মধ্যে যারা দীর্ঘদিন চিকিত্সাবিহীনভাবে থাকে তাদের জণ্ডিস বেড়ে যাওয়া, পেটে পানি আসা, রক্তবমি হওয়া এবং কালো পায়খানার হতে পারে। এমনকি রোগী অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে।

যাদের মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয় তাদের রোগ ধরা পড়ে বুদ্ধি ও স্মরণশক্তি কমে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। অত:পর, হাত-পা শক্ত হয়ে যাওয়ার কারণে লিখতে না পাড়া, মুখের পাশ দিয়ে লালা পড়া এবং কাঁপুনি ও হাত-পায়ের এলোমেলো অনিয়ন্ত্রিত ছোড়াছুড়ি প্রভৃতি লক্ষণ দেখা দেয়। এছাড়া আচার-আচরণে পরিবর্তন, অত্যধিক হতাশা ইত্যাদি লক্ষণও প্রকাশ পেতে পারে।

আমাদের দেশে বিশেষ করে ছোট বাচ্চা ও প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী লিভার প্রদাহ এবং লিভার সিরোসিসের কারণ হিসেবে যদি কোন ভাইরাসকে চিহ্নিত করা না যায় তখন উইলসনস ডিজিজকে অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষানিরীক্ষা করার মাধ্যমে রোগটি নির্ণয় করা যায়।

লিভার বা ব্রেইন যা-ই আক্রান্ত হোক, উইলসনস ডিজিজের রোগীদের অনেকের ক্ষেত্রে চিকিত্সকগণ পরীক্ষা করে কর্ণিয়াতে কপার জমা হয়ে সৃষ্ট এক ধরণের ব্লুইশ-ব্রাউন রিং পান। যাকে বলে কাইসার-ফ্লেসার রিং। এছাড়াও তারা রোগ নির্ণয়ের জন্য রক্তে সেরুলোপ্লাজমিন, মুক্ত কপার ও প্রস্রাবে কপার নির্গমণ পরীক্ষা করেন। সিরোসিস হয়েছে কিনা বুঝতে রক্তে বিলিরুবিন, এএলটি, এএসটি, প্রথ্রোম্বিন টাইম এবং পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাম করা হয়। এন্ডোস্কোপির মাধ্যমে ইসোফেজিয়াল ভ্যারিক্স নির্ণয় করা হয়। চোখের কর্ণিয়াতে কপার জমা হয়ে তৈরী হয় কাইসার-ফ্লেসার রিংকারো কারো ক্ষেত্রে লিভার থেকে মাংস নিয়ে পরীক্ষা করার (বায়োপসি) প্রয়োজন পড়তে পারে। বিশেষ করে, টিস্যু ডায়াগনসিস তথা লিভার সিরোসিসের অন্যান্য কারণ থেকে পৃথক করার জন্য লিভার বায়োপসি করা লাগতে পারে। উইলসনস ডিজিজে লিভার বায়োপসি করলে লিভার টিস্যূতে অধিক পরিমাণ জমাকৃত কপার দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া, চিকিত্সা গ্রহণ করলে লিভার-এ জমাকৃত কপার কমতে থাকে বিধায় চিকিত্সার অগ্রগতি বোঝার জন্যও অনেক সময় লিভার বায়োপসি করতে হয়।

লিভারে অতিরিক্ত কপার জমা হওয়ার কারণে সৃষ্ট প্রদাহ যদিও উইলসনস ডিজিজ লিভার ও ব্রেইন-কে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত করতে পারে, তথাপি খুশীর কথা হলো নিয়মতান্ত্রিক চিকিত্সায় উইলসনস ডিজিজ থেকে আরোগ্য হওয়া এবং নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। ডি-পেনিসিলামিন, জিংক এসিটেট ইত্যাদি ওষুধ সেবনের মাধ্যমে এই রোগ চিকিত্সা করা হয়। এ রোগের চিকিত্সায় নিয়মানুবর্তিতার সাথে আজীবন চিকিত্সা গ্রহণ করতে হয়। নিয়মিত চিকিত্সা গ্রহণ করলে একজন রোগী পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবন যাপনও করতে পারে। এমনকি উইলসন ডিজিজে আক্রান্ত রোগীর সিরোসিস হয়ে গেলেও নিয়মিত ওষুধ সেবনে উল্লেখযোগ্য উন্নতি পাওয়া যায়। কিন্তু রোগ যখন অনেকখানি অগ্রসর হওয়ার পর ধরা পড়ে তখন চিকিত্সা গ্রহণ খুব একটা কাজ নাও করতে পারে। যেহেতু কপার শুধুমাত্র লিভারে পরিপাক হয় এবং উইলসনস ডিজিজ মূলত লিভারের রোগ, সেহেতু লিভার ট্রান্সপ্লেন্ট করলে রোগী পুরোপুরি আরোগ্য লাভ করতে পারে।

উপরের সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে আমরা উইলসন ডিজিজের ধরণ, সংক্রমণের পদ্ধতি, রোগের লক্ষণ, রোগ নির্ণয় এবং রোগের চিকিত্সা সম্পর্কে জানতে পারলাম। আমাদের উচিত্ এই রোগটির লক্ষণ সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং যাদের মধ্যে এই লক্ষণগুলো দেখা যাচ্ছে তাদের সময়মত বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সরণাপন্ন হয়ে চিকিত্সা গ্রহণ করতে বলা। আমাদের দেশে অনেক সময় সম্ভাব্য উইলসনস ডিজিজ-এর রোগীদের মাথায় সমস্যা মনে করে ওঁঝা, কবিরাজদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। কবিরাজরা জীন-ভূতের আছর ভেবে ঝাড়ফূঁক করেন। কিন্তু ঝাড়ফূঁকে কাজ না হলে তাদের ডাক্তারদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। রোগ নির্ণয় এবং চিকিত্সা গ্রহণে এই অনাকাংখিত বিলম্ব অনেক সময় রোগীদের ক্ষতি করে। অথচ, একটু সচেতন হলেই এই রোগের মারাত্মক পরিনতি থেকে অনেক রোগীকেই রক্ষা করার সুযোগ আছে। অতএব, আসুন আমরা এই রোগটি সম্পর্কে সচেতন হই এবং আমাদের আপনজন, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও পরিবার-পরিজনকে এই রোগটি সম্পর্কে অবহিত করি এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করে রোগ থেকে মুক্তি লাভে সহযোগিতা করি।

লেখক:মির্জা গোলাম হাফিজ রোড
দি লিভার সেন্টার, ঢাকা, বাংলাদেশ