বাংলার এক শ্রেণির স্বশিক্ষিত-অল্পশিক্ষিত, একতারা-দোতরা আশ্রয়ী, ভাববিদ্রোহী গায়ক, স্বাধীন সমন্বয়মূলক মরমি সাধকদের আত্মোপলদ্ধিমূলক গানের নাম ‘বাউল গান।’ আঠার শতকের শেষার্ধ হতে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত পরাধীন উপমহাদেশের নতুন পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে উদ্ভূত সাংস্কৃতিক, সাহিত্যিক, সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, এমনকি রাজনৈতিক পটভূমিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি কামনা করে গানে এই ধারার জন্ম হয়। ধর্ম-দল-মত-বর্ণ-গোত্র-সম্প্রদায় নির্বিশেষে কোনও এক বা একাধিক সহজ-সরল ব্যক্তির দুঃখময় জীবনের কথা, মানুষের অন্তরতম গভীর সত্য ও মিলনের চিরন্তন বাণী, মানুষের সাথে মানুষ ও জগৎ কারণের মিলন, জীবনের সাথে জগৎ স্রষ্টার সহজ সম্পর্ক, আত্মার মুক্তি ও অন্তিম পরিণামের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এই বাউল গান। বৃহত্তর ময়মনসিংহে তথা নেত্রকোণা অঞ্চলে বাউল গানকে বলা হয় বাউলা গান। আর এই বাউল গানের ধারায় নেত্রকোণা অঞ্চলে সর্বপ্রথম নতুন সংযোজন হলো ‘মালজোড়া বাউল গান।’ মালজোড়া বাউল গানের স্রষ্টা হলেন ‘বাউল কবি রশিদ উদ্দিন’ (১৮৮৯ -১৯৬৪)।

রশিদ উদ্দিন একজন সিদ্ধ বা খাঁটি বাউল কবি। তবে তিনি মূলত সঙ্গীত আশ্রয়ী বাউল কবি। সেইসাথে তিনি লোকজ দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক, সাম্যবাদী মরমি সাধক। কারও কারও চিন্তায় তিনি আরও ভিন্নভাবে মূল্যায়িত হতে পারেন। তবে নেত্রকোণা অঞ্চলে বাউলগানের প্রসারকালে রাষ্ট্র ও সমাজের শাসক শ্রেণির নিকট বাউল সমাজ যখন খুব একটা সমাদৃত ছিলেন না, উপর শ্রেণি তাঁদের বাতুল বা ব্যাকুল বা অর্ধ উন্মাদ রূপে অবজ্ঞা করত; অথচ সেই সমাজ পরিবেশে সম্ভবত রশিদ উদ্দিন তাঁর নিজ নামের পূর্বে ‘বাউল’ বিশেষণটি ব্যবহার করেন। যেখানে বাউল সমাজের পূর্বসূরী লালন নিজেকে শাহ-সাঁইজি-ফকির, হাছন নিজেকে রাজা ইত্যাদি বলে নিজের গানে নিজেদের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন এবং পরে তাঁর প্রধান শিষ্য ও সহচর জালাল খাঁ, উকিল মুন্সী সহ সকলেই নিজেদের ‘বাউল’ বলে পরিচয় দিয়েছেন। অর্থাৎ এটা ছিল বাউল কবি রশিদ উদ্দিনের ঘুণেধরা সমাজের প্রতি প্রকাশ্য বিদ্রোহ। আর সেই বিদ্রোহের পথ ধরে রশিদ উদ্দিন সৃষ্টি করেন নতুন ধারার তর্কধর্মী ও তথ্যমূলক ‘মালজোড়া বাউল গান।’ নেত্রকোণার বাউল জগতের মধ্যমণি ছিলেন বাউল কবি রশিদ উদ্দিন আর তাঁর নিত্যসঙ্গী ছিলেন বাউল জালালউদ্দিন খাঁ, বাউল মিরাজ আলী, বাউল কমল মিয়া,বাউল উকিল মুন্সী, ইদ্রিস মিয়া, বাউল আব্দুল মজিদ তালুকদার, বাউল আলী হোসেন সরকার, বাউল আবেদ আলী, বাউল চান মিয়া, বাউল ইস্রাফিল, বাউল খোর্শেদ মিয়া, বাউল প্রভাত, বাউল আলী হোসেন, বাউল পীতাম্বর নাথ, বাউল তৈয়ব আলী, বাউল মিয়াহুব, বাউল উমেদ আলী প্রমুখ এবং নেত্রকোণার বাইরের বাউলগণের মধ্যে বাউল আব্দুল বারেক, বাউল শাহ আব্দুল করিম, বাউল আবু তাহের, বাউল আব্বাছ উদ্দিন ও বাউল উপেন্দ্র সরকার প্রমুখ। এ বাউল গোষ্ঠী মূলত নেত্রকোণার বাউল জগতের ‘মালজোড়া’ বাউলগানের নির্মাতা। আর বাউল রশিদ উদ্দিন ছিলেন তাঁদের ঘরানার ওস্তাদ।

আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে বাউল কবি রশিদ উদ্দিন আমাদের ছেড়ে স্বর্গবাসী হয়েছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাঁর মৃত্যুর পর সঠিকভাবে সংরক্ষণের অভাবে রশিদ উদ্দিনের সৃষ্টিকর্ম ও তাঁর কালজয়ী গানগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। নতুন প্রজন্মের লোকদের কাছে রশিদ উদ্দিনের গানগুলো পরিচিত হলেও গানের গীতিকার নিয়ে রয়েছে নানান ধরণে বিভ্রান্তি। স্বাধীনতার পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেরই রশিদ উদ্দিন সম্পর্কে কোনও পরিষ্কার ধারণা নেই। পঞ্চাশ-ষাট দশকের লোকদের কাছেও রশিদ উদ্দিনের সৃষ্টিকর্ম এখন অনেকটা অস্পষ্ট হতে বসেছে। তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত একমাত্র গানের বই ‘স্বররাজ লহরী’ আমাদের হাতে নেই। আর্থিক দীনতায় তিনি এবং পরে তাঁর পরিবার তাঁর সব গান প্রকাশ করতে পারেন নি। তাঁর বেশিরভাগ গান মানুষের মুখেমুখে প্রচারিত এবং শিষ্যদের কাছে সংরক্ষিত ছিল। আর এই সুযোগটি গ্রহণ করে তাঁর জনপ্রিয় গানগুলো অনেকে নিজ নামে চালিয়ে দিয়েছেন কিংবা অনেকে নিজে গেয়ে ‘সংগৃহীত’ বলে উল্লেখ করেছেন। রশিদ উদ্দিনের জীবদ্দশাতেই যখন তাঁর গানগুলো তাঁর খুব কাছের কজন শিষ্য নিজের গানের বই-এ ছেপে দিয়েছেন; এমনকি ওস্তাদ রশিদ উদ্দিনকে না জানিয়ে তাদের বইয়ের মুখবন্ধে রশিদ উদ্দিনের নাম ব্যবহার করে ছেপে দিয়েছেন; তখন রশিদ উদ্দিন রাগে, দুঃখে কবি রওশন ইজদানীকে পত্র লিখে বিষয়টির প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং তাঁর গানের সমালোচনা পত্রিকায় প্রকাশ করতে অনুরোধ করেছেন। তাঁর এই অনুরোধে কবি রওশন ইজদানী মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকার, বাংলা ১৩৬২ সালের আশ্বিন মাসের সংখ্যায় ‘বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে সমস্যাটি তুলে ধরেন। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর বাংলা একাডেমির সংগ্রহশালা থেকে উক্ত প্রবন্ধটি সংগ্রহ করতে সমর্থ হই। পাঠকের জানার সুবিধার্থে পরবর্তী অধ্যায়ে তা সংযোজন করার চেষ্টা করেছি।

আমি অনেকটা নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকেই প্রায় হারিয়ে যাওয়া রশিদ উদ্দিনের গানগুলো সংগ্রহ করে সম্পাদনা করার চেষ্টা করেছি। আর এ দায়বদ্ধতা তখনই প্রবল হয়, যখন আমি রশিদ উদ্দিন সাহেবের বাড়ি সংলগ্ন ‘রাজুর বাজার কলেজিয়েট স্কুল’-এর প্রধান শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতার কাজ শুরু করি। প্রায় বিশ বছর ধরে এখানে শিক্ষকতা করছি। এ গ্রামের বয়স্ক মুরুব্বীদের কাছে থেকে রশিদ উদ্দিনের প্রায় শত বছর বয়সী বর্তমানে জীবিত দ্বিতীয় স্ত্রী আমিরজান বেগম, ছোট ছেলে আবু আনসার মোঃ কালা মিয়াসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে রশিদ উদ্দিনের গান ও তাঁর কৃতকর্মের সম্পর্কে অবগত হই, তখন আমার আগ্রহ ও কর্তব্যবোধ আরও প্রবল হয়। এই দেশের কিংবদন্তী তুল্য একজন বাউল গীতিকারের অমূল্য সম্পদ গানগুলো যাতে একেবারে হারিয়ে না যায়, সেই সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই যতটা সম্ভব হয়েছে গানগুলো সংগ্রহ করে এই গ্রন্থটি সম্পাদনা করার চেষ্টা করেছি। তাছাড়া ২০০৯ খ্রি. বাহিরচাপড়া গ্রামে রশিদ উদ্দিনের স্মৃতি রক্ষার্থে স্থাপিত হয় ‘বাউল রশিদ একাডেমি।’ এই সমিতির পক্ষ থেকেও আমাকে এ গুরু দায়িত্বটি পালন করতে অনুরোধ করা হয়।

১৯৬৪ সালে রশিদ উদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁকে তাঁর বাড়ির সামনে পুকুরপাড়ের যে স্থানটিতে সমাধিস্থ করা হয়; সেই স্থানটির মালিকানা রশিদ উদ্দিন বা তাঁর পরিবারের কেউ নন। পরিবারের লোকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সেই কবরের স্থানটি ক্রয় করে নেওয়ার মতো আর্থিক সামর্থও এখন তাদের নেই। বিষয়টি আমার মনে খুব কষ্ট দিয়েছে। আশা করি তাঁর ‘রশিদ গীতিকা’ বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁর ভক্ত ও পাঠকদের সহযোগিতায় রশিদ উদ্দিনের কাছ থেকে কিছুটা দায়মুক্ত হতে পারব।

গানগুলো সংগ্রহ ও সম্পাদনা করতে গিয়ে যে সমস্যা হয়েছে তা হলো, রশিদ উদ্দিনের প্রথম জীবনে প্রকাশিত একমাত্র গানের বই ‘স্বররাজ লহরী’ প্রকাশিত হয়েছিল, তা সংরক্ষিত নেই এবং তা আমার দ্বারা পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। ফলে তাঁর ওই সকল গান উক্ত গ্রন্থেও আছে কি-না বা এগুলো ‘স্বররাজ লহরী’ গ্রন্থের পরে লেখা কি-না, তা আমার জানা নেই। তবে পরিরারের লোকদের কাছে থেকে হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, পারিবারিক ডায়েরি, বাংলা একাডেমি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, কবি রওশন ইজদানীর প্রবন্ধ, বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকদের প্রকাশিত গ্রন্থ-প্রবন্ধ, পুরোনো সাময়িকী, নেত্রকোণার লোকজ প্রতিষ্ঠান ‘শিকড়’ উন্নয়ন কর্মসূচি সংগ্রহশালার কাগজপত্র, নেত্রকোণার লোকজ গবেষক গোলাম এরশাদুর রহমানের বিভিন্ন গ্রন্থ ও প্রবন্ধ এবং রশিদ উদ্দিনের ভক্ত জীবিত বাউল শিল্পীবৃন্দ, রশিদ উদ্দিনের শত বছরের জীবিত বৃদ্ধা দ্বিতীয় স্ত্রী আমিরজান, ছোট ছেলে কালা মিয়া এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকে গান ও প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছি। তবে উক্ত গ্রন্থের তথ্য সংগ্রহ করতে অনেকে আমাকে সহযোগিতা করেছেন, যাঁদের মধ্যে গোলাম মোস্তফা (লাল মিয়া ভাই), গোলাম এরশাদুর রহমান, আ. ফ. ম. রফিকুল ইসলাম খান আপেল ভাই, বাউল আব্দুর রহমান, বাউল সয়াল শাহ প্রমুখ। আমি সকলের কাছে কৃতজ্ঞ। হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিটি কালির কলম দিয়ে লেখা, ফলে অনেক অংশ অস্পষ্ট শব্দ মুছে গেছে প্রায়; তাই পাঠোদ্ধার করতে গিয়ে বুঝতে অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছে। ফলে বারবার পড়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে বাউল শিল্পীদের সাথে আলোচনা করে সেই অংশের পাঠোদ্ধার করতে চেষ্টা করেছি। আবার অনেকগুলো গানের অংশবিশেষ পাঠোদ্ধার করতে পেরেছি এবং যতটুকু পাঠোদ্ধার করতে পেরেছি তার কোনও পরিবর্তন বা সংযোজন না করে অবিকল ছাপার চেষ্টা করেছি। এসব প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যতটুকু পেরেছি অনেকটা সতর্ক থেকেই গানগুলো সংগ্রহ করেছি। তবে সঙ্গত কারণেই লেখায় শব্দে, বাক্যে, বানানে ও ছাপায় ভুল-ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। তাছাড়া আমি নিজে কোনও লোকশিল্পী বা লোকগবেষক নই। একজন সাধারণ মানুষ ও রশিদ ভক্ত হিসেবে গানগুলো সংগ্রহ করে পাঠক ও গবেষকদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি মাত্র। কাজেই অনিচ্ছাকৃত বা অজ্ঞতাবশত যদি কোনও ভুলত্রুটি থেকে থাকে তবে পাঠকগণ নিজগুণে ক্ষমা করবেন। তবে আশা করি বাউল কবি রশিদ উদ্দিনকে নিয়ে আরও গবেষণা হবে। তাঁর গান ও কৃতকর্ম সম্পর্কে সমাজ অবগত হয়ে একটি অসম্প্রদায়িক ও মুক্ত চিন্তার বিকাশ ঘটবে।