হাওর অঞ্চলে নববর্ষে অনুষ্ঠিত মেলাগুলোর মধ্যে এ মেলা সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় ও প্রাচীন। পৌর শহরের বাঁশমহালে মূল মেলা বসে। এতে পাওয়া যায় গ্রামের মেয়েদের বিচিত্র সব প্রসাধন, কাঠ ও মাটির খেলনা, তৈজসপত্র। ঘুড়ির মেলা বসে বড় সড়কে। অনেক আগে থেকেই ঘুড়িওয়ালাদের প্রস্তুতি শুরু হয়। কাচ গুঁড়া করে আঠার মিশ্রণে রিল রিল সুতা ‘মাঞ্জা’ দিয়ে ধারালো করা হয়। ঘুড়ি কাটাকাটি শুরু হলে আকাশজুড়ে শত শত ঘুড়ি একটি অন্যটিকে ধাওয়া করে। হঠাৎ সূতা কেটে গিয়ে এক-একটি ঘুড়ি আকাশের সঙ্গে যেন মিশে যায়। কেটে যাওয়া ঘুড়ি কবজা করতে কঞ্চি, এমনকি কঞ্চিসুদ্ধ আস্ত বাঁশ নিয়ে খোলা হাওর জুড়ে ছেলেরা দৌড়ায়! আগে মূল মেলা দুই-তিন দিন চললেও ঘুড়ি কাটাকাটি হতো সাত দিন ধরে।

imageশোনা যায়, একসময় কলকাতা থেকে শৌখিন ঘুড়িওয়ালারা এসে এ মেলায় অংশ নিত। প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, একসময় নানা ধরনের ঘুড়ি ওড়ানো হতো। এর মধ্যে ছিল সাপঘুড়ি, মাছঘুড়ি, প্রজাপতিঘুড়ি, চোঙঘুড়ি, ঢোপঘুড়ি, চিলিঘুড়ি, ফিংগিঘুড়ি, উড়োজাহাজঘুড়ি, মানুষঘুড়ি, কোয়াড়ে বা সংঘুড়ি। এখন এতটা বৈচিত্র্য না থাকলেও গাছে বাঁধা ‘ঢাউস’ ঘুড়ি চোখে পড়ে। মেলার আরেক আকর্ষণ টকজাতীয় পাকা গাব ও বেতফল। মেয়েদের লোভনীয় বেতফলকে স্থানীয়রা ‘বেতগুডা’ বলে। বেতগুডা এ অঞ্চলে প্রচুর জন্মায়। মেলায় ৩০-৪০ টাকায় এক থোকা বেতফল পাওয়া যায়। আরো মেলে আলতা, লাল-নীল ফিতে, খেলনা লঞ্চ, লবডংকা, খেলনাগাড়ি, টেমটেমি, কাঠের ঘোড়া, কাগজের কুমির, চরকা, বেলুনবাঁশি, প্লাস্টিকের সাপ, মাটির জন্তু-জানোয়ার, মাটির ফলমূল, মাটির ‘ব্যাংক’, মিষ্টান্ন তিল্লা, উখরা, মঠ, বিন্নি, খই ইত্যাদি।

কয়েক বছর আগেও মেলায় বসত পুতুলনাচের আসর। এখন পুতুল নাচ না থাকলেও নাগরদোলা আসে। শিশুরা তাতে চড়ে। মাঝেমধ্যে লাঠিখেলাও চোখে পড়ে। তবে এখন আর ঘাটুনৃত্য, হিজরানৃত্য বা জমিদারবাড়িতে পুণ্যাহ উৎসব হয় না। ব্যবসায়ীরা বিপুল উৎসাহে শুভ ‘হালখাতা’ পালন করে। বাজিতপুরের ঘুড়ির মেলার গোড়াপত্তন কবে হয়েছে, তা সুনির্দিষ্টভাবে কেউ বলতে না পারলেও অন্তত ৩০০ বছর ধরে এ মেলা প্রচলিত রয়েছে।

প্রবীণ ব্যক্তিত্ব মো. ছানাউল্লাহ মিয়া মেলার ঐতিহ্যের কথা বলতে গিয়ে ত্রিশ ও চলি্লশের দশকের অনেক গল্প শোনান। তিনি জানান, আগে বয়স্ক ব্যক্তিরা ঘুড়ি কাটাকাটিতে অংশ নিতেন। নাটাইয়ে জুড়তেন কলকাতার ‘কৃষ্ণ মার্কা সুতা’। তাঁদের ছেলেবেলায় অনেকে সং সেজে, তীর-ধনুক হাতে আনন্দ মিছিল করত। সংরা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান শুনিয়ে ‘দক্ষিণা’ তুলত। জমানো টাকায় পরে আয়োজন হতো ভূরিভোজের। এসব কর্মকাণ্ডে সামনের সারিতে থাকতেন সে সময়ের তরুণ শিক্ষক (পরে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদা লাভের পর অবসরপ্রাপ্ত) বিমল চন্দ্র পাল। ছানাউল্লাহ মিয়া বলেন, ‘আগে উৎসব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়েই আমরা ব্যস্ত থাকতাম। এখনকার যুবকরা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যস্ত থাকলে বিপথগামী হতো না।’

একসময় যারা বাজিতপুরের সাংস্কৃতিক অঙ্গন জমিয়ে রাখত, তাদের কেউ আর বেঁচে নেই। তবে মেলা উপলক্ষে বাড়ি বাড়ি নতুন খাবার ও পিঠা তৈরি হয়। ছোটরা পরে নতুন জামাকাপড়। বউ-ঝিয়েরাও নাইয়র আসে। নাগরিক আমেজের পান্তা-ইলিশ না খেলেও গ্রামের মানুষ এ দিন আমভর্তা, গিমা-পাটশাক ভাজা ও সজনে-ডাল খায়। আগের মতো প্রাচুর্য না থাকলেও হাওর জনপদের এ উৎসব ভিন্ন আনন্দ দেয়।