কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী পুরান বাজারে এবারও জমবে ৫’শ বছরের ঐতিহ্যবাহী দেশের একমাত্র ঢাক -ঢোলীর হাট। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব সারদীয় দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে আগামী ০১ অক্টোবর সকাল থেকে বসবে এ ঢাকঢোলীর হাট। এ হাট চলবে টানা দু’দিন। শেষ হবে দূর্গাপূজার শুরুর দিন ০৩ অক্টোবর। বাংলাদেশের কোথাও এ ধরণের বাধ্যযন্ত্রের হাট নেই জানান আয়োজকরা।

আয়োজকরা জানান, এ হাটে কেনাবেচা হয় না। পূজা মন্ডবে বাজনা বাজিয়ে আরতী দেয়া, দুর্গা মাকে খুশি করা আর দর্শক ভক্তদের আকৃষ্ট করতেই বাদকযন্ত্রীক বা ব্যান্ড পার্টি চুক্তিভিত্তিক ভাড়া দেয়া নেয়া হয় এ হাটে। দুর্গোৎসবের শেষ দিন প্রতিমা বিষর্জন পর্যন্ত বাদ্য বাজিয়ে যন্ত্রীকদের বিদায় দিতে হয়। আর এর জন্যই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পূজা আয়োজকরা এ হাটে এসে দরকষাকষি শেষে চুক্তিতে বাধ্যযন্ত্রীদের নিয়ে যায়। পূজা মন্ডপে বাদ্যের বায়না ধরতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শতশত বাদক যন্ত্রীক স্বস্ব বাদ্যযন্ত্র নিয়ে এ হাটে এসে হাজির হয়।

আশপাশের বাদকযন্ত্রীক ছাড়াও রাজধানী ঢাকা, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, নারায়নগঞ্জ, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, হবিগঞ্জ, কুমিল্লার বিক্রমপুর থেকেও বাদক যন্ত্রীকরা এসে থাকেন এ হাটে। ঢাক ঢোল, সানাই, নানা জাতের বাঁশি, কাসি, কত্তাল, মঞ্জুরীসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের হাট উপচে পড়ে। যন্ত্রীকরা দলে দলে দফায় দফায় বাজায় বাদ্যযন্ত্র। বাজনার তালে তালে নাচ আর রং ঢং এর অঙ্গীভঙ্গীতে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে প্রদর্শন করে কার হাতের সাফাই কত। এ সময় পুরো বাজার এলাকার আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে বাজনার সুরে। প্রত্যদর্শীরা জানান, প্রদর্শনী বাজনার পরই শুরু হয় চুক্তির দর কষাকষি। সাধারণত একজন ঢাকী বাদকের চুক্তিভিত্তিক ভাড়া হয় ৫ হাজার টাকা, ঢুলি ২ হাজার টাকা, বংশী বাদক প্রকারভেদে ২ থেকে ৩ হাজার টাকায়। ৫ যন্ত্রের ছোট ভ্যান পার্টি ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকায়, বড় পার্টি ৩০ হাজার থেকে ১ ল টাকায় ভাড়ার চুক্তি হয়। দুর্গা পূজা শুরুর দিন থেকে প্রতিমা বিসর্জন পর্যন্ত টানা ৫ দিন তাদের বাজনা বাজাতে হয়।

কটিয়াদী পুরান বাজারে ঢাকাঢোলীর হাটের পিছনে ৫শত বছরের ইতিহাস রয়েছে। জনশ্র“তি আছে ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায়ই সর্বপ্রথম তার রাজ প্রাসাদে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। উপজেলা সদর থেকে ২ কিলোমিটার উত্তরে চারিপাড়া গ্রামে ছিল রাজার রাজপ্রাসাদ। আজও রাজার আমলে খনন করা কোটামন দীঘিটির মনোরম দৃশ্য দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। পূজা উপলে রাজা প্রাসাদ থেকে সূদুর বিক্রমপুর পরগনায় (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ) বিভিন্ন স্থানে বার্তা পাঠানো হয় ঢাকঢোল বাঁশিসহ বাদকযন্ত্রীকদের আগমনের জন্য। তৎকালীন সময়ে নৌপথে বাদকযন্ত্রীকরা কটিয়াদী মঠখোলা সড়কের পাশে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে যাত্রাঘাট নামক স্থানে পূজার দু’দিন আগে এদের আগমন ঘটে।

পরবর্তী সময়ে পার্শ্ববর্তী মসুয়া গ্রামে বিশ্বনন্দীত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পূর্ব পুরুষ হরিকিশোর রায় চৌধুরীর বাড়ীতে মহা ধুমধামে দুর্গাপূজা শুরু হয়। সেই সঙ্গে চলে বিভিন্ন মন্ডপে বাদ্যযন্ত্রের প্রতিযোগিতা। দিন দিন পূজার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন জমিদারদের মাঝে ঢাকঢোলীর হাট নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। অবশেষে যাত্রাঘাট থেকে স্থান পরিবর্তন হয়ে ৫ কিলোমিটার দূরবর্তী আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরে কটিয়াদী পুরান বাজারে বসে এ ঢাকঢোলের হাট। সে থেকেই প্রতি বছর এখানে নিয়মিত ঢাকঢোলীর হাট বসে আসছে।

এলাকাবাসী কটিয়াদী বাজারে এ ঢাকঢোলীর হাট বসায় তারা গর্বিত। তবে তাদের দুঃখ প্রতি বছর এ হাটে আগত বাদকযন্ত্রীকদের থাকার সুনির্দিষ্ট কোন সুব্যবস্থা নেই। নেই নিজস্ব স্থান। ফলে নানা সমস্যায় ভোগতে হয় তাদের। তারা সরকারের কাছে সকল সমস্যা সমাধানের দাবী জানান।
কটিয়াদী উপজেলার চেয়ারম্যান লায়ন আলী আকবর বলেন, ৫শত বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকঢোলের হাট কটিয়াদী উপজেলার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।

উপজেলা প্রশাসন আগত ঢাকঢোলীদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। কিশোরগঞ্জ- ২ (কটিয়াদী-পাকুন্দিয়া) আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য ডাঃ আব্দুল মান্নান বলেন, এ ঐতিহ্য জেলার ও দেশের গর্ব। তিনি কটিয়াদীতে প্রতিমা বিসর্জনের জন্য একটি স্থায়ী দশমী ঘাট নির্মাণে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। এ ব্যাপারে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনদের এগিয়ে আসার আহবান জানান।

– পোষ্টটি সংগ্রহীত স্বত্ব পাওয়া যায়নি।