সম্প্রতি বাংলা একাডেমীর ফোকলোর উপবিভাগ থেকে ঢাকা শহর,  মানিকগঞ্জ ও অষ্টগ্রামের মহরম উৎসবের ওপর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে । সংগ্রহিত তথ্য থেকে আমরা অষ্টগ্রামের মহরম উৎসবের উপর একটি তথ্য চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি ।

কিশোরগঞ্জের হাওর বেষ্টিত এলাকা অষ্টগ্রাম , পুরোনো জমিদার বাড়ী-‘হাওলী বাড়ী’ [হাবেলী বাড়ী] কে কেন্দ্র করেই পালিত মহরম। এই জমিদার পরিবারের একজন উত্তরাধিকারী আলাইমিয়া বা সৈয়দ আব্দুল করিমের সময় ১৮৩৬ সালে ইংরেজ সরকার বাকী খাজনার দায়ে  জমিদারী বাজেয়াপ্ত করে । আলাই মিয়া তখন সংসার ত্যাগ করে বিবাগী হয়ে গিয়েছিলেন  এবং পরবর্তীকালে  সাধক হিসাবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন।

সাধক খ্যাতি লাভের পর তিনি ফিরে এসেছিলেন জমিদার বাড়িতে এবং বাড়ির আঙ্গিনায় স্থাপন করেছিলেন একটি ইমামবাড়া । সেই থেকে [আনুমানিক উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে] অষ্টগ্রাম ও আশেপাশের এলাকায় মহরমের কেন্দ্র ‘হাওলী বাড়ী’  এখানে উল্লেখ থাকে যে, বর্তমানে অষ্টগ্রামে  শিয়া সম্প্রদায়ের কেঊ নেই ।সুন্নী মুসলমানরাই তা পালন করেন । যেমনটি তারা করে আসছেন  গত দেড়শত বছর ধরে । এবং এ অনুষ্ঠানে হিন্দুসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজনও অংশ গ্রহন করেন ।

মহরমের চাঁদ উঠার আগে থেকেই অষ্টগ্রাম ও আশেপাশের এলাকায় মহরম পালনের প্রস্তুতি গ্রহন করা হয় । শুধু তাই নয় প্রতিটি বাড়িতে সাধ্যমত  চাল- চিড়া কুটে রাখা হয় । কারণ চাঁদ উঠার পর বারোদিন পর্যন্ত ঢেঁকিতে চাল কোট নিষিদ্ধ । মহরমের চাঁদ দেখার পর খাট-পালং কেঊ ব্যবহার করেন না, মাটিতেই আসন গ্রহন করেন বা শয্যা পাতেন ।  শুধু তাই নয় সে দিন থেকে তারা রোজা রাখেন । বয়স্ক পুরুষরা চুল দাড়ি ছাঁটেন না, বা কেঊ জুতো খড়ম পায়ে দেন না, নখ কাটেন না, ভালো পোষাক ও পরিধান করেন না । প্রতি রাতে সুর করে  শুরু হয় জারি গান । গানের শেষ পর্যায়ে নিজ গ্রাম প্রদক্ষিন করে নিজ নিজ মহল্লা বা দরগার [ইমামবাড়া]সামনে এসে  গান শেষ করেন। মূল অনুষ্ঠান অর্থাৎ আশুরার পূর্ব দিন পর্যন্ত এ ধরনের প্রস্তুতি চলতে থাকে । এ পর্যায়ে আরো আছে  মাটি বা কাগজের ঘোড়া, তাজিয়া ইত্যাদি তৈরী ও শিরনী বিতরণ ।

mohorom

অষ্টগ্রামের প্রতিটি মহল্লায় মহরম পালনের জন্য আছে একটি স্থায়ী দরগা । এ দরগা মাটির উচু বেদী, যার ওপর টিন বা ছনের ঘর তুলা হয় । প্রতিটি দরগায় থাকেন একজন খাদেম এবং মহরমের সময় দরগাগুলি সাজানো হয় । সন্ধ্যায় জ্বালানো হয় মোম বাতি, আর চড়া সুরে বাজানো হয় ডংকা । ডংকার সুর শুনে রোজাদাররা ইফতার করেন ।

আশুরার দিন বিভিন্ন মহল্লা থেকে মহল্লা প্রধানের নেতৃত্বে বিভিন্ন মিছিল এসে জড়ো হয় কেন্দ্রীয় ইমামবাড়া ‘হাওলী বাড়ীতে’। এ দিন আলাই মিয়ার মাজারটি ও সাজানো হয় । প্রতিটি দল ইমামবাড়া ও মাজার প্রদক্ষিণ করে  নির্ধারিত স্থানে গিয়ে প্রায় সারা রাত মাতম করে গান গায় ।  দশই মহরম আবার মাতম করতে করতে  অষ্টগ্রামের পূর্বে ‘কারবালা ময়দানে’ তাবুত, দুলদুল, তাজিয়া উৎসর্গ করেন । কিন্তু সন্ধ্যার পরই সবাই মাজার ছেড়ে চলে আসেন । কারণ, অষ্টগ্রামবাসীর বিশ্বাস, রাত আট টার পর জ্বীনরা এসে কারবালার মাঠে মাতম করেন । মহরমের একাদশ ও দ্বাদশ দিনে মহিলারা মাতম শোক জারি করে মহরম অনুষ্ঠান শেষ করেন । এখানে উল্লেখ্য যে, মহরমের বার দিন, বিভিন্ন অঞ্চলের সম্প্রদায় নির্বিশেষে কারবালার মাঠ দরগা  ও হাওলী বাড়ী দরগায় মনের ইচ্ছা পুরনের আশায় মানত করেন । মানতের মধ্যে আছে, জীবন্ত ঘোড়া, ফল মূল থেকে টাকা পয়সা ।   যে সব জীবন্ত ঘোড়া উৎসর্গ করা হয় সেগুলো পরিচিত দুলদুল নামে । যে সব ঘোড়া উৎসর্গ করা হয় সেগুলো ধর্মের ষাড়ের মত । যত্রতত্র ঘুড়ে বেড়ায় , ফসঅল নষ্ট করে । ফসল নষ্ট করলে ক্ষেতের মালিক ক্রুদ্ধ না হয়ে বরং খুশিই হয়, কারন তা নাকি সৌভাগ্যের লক্ষণ ।

ফটো কার্টেসিঃ  ডা. ঝুটন চন্দ্র বণিক, সহকারী সার্জন, অষ্টগ্রাম উপজেলা হাসপাতাল।