কিশোরগঞ্জের রথখলা সকলের নিকট পরিচিত একটি নাম। এর পেছনের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। আজকের রথখলা আগের রথখলার মধ্যে ব্যবধান ব্যাপক। রথখলা বলতে এখন আমরা  এমন একটা এলাকার কথা বুঝি যেখানে হরেকরকম ব্যবসায়ীর কায়কারবার।কিন্তু প্রকৃত অর্থে রথখলার সাথে জড়িয়ে আছে অনেক স্মৃতি সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের ইতিহাস।

কিশোরগঞ্জের রথখলা যে, মাঠ এর ইতিহাস রথযাত্রার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিবছরই এখানে রথযাত্রা হয় এবং রথমেলা বসে। তখন মাঠ ভরে ওঠে খৈ, গুড় বাতাসা, খেলনা বিভিন্ন হস্তশিল্পের সামগ্রীতে। মেলায় আসে মাটির পুতুল, কাঠ খোদাই জিনিস, বাশঁ বেত শিল্প সামগ্রী।এ সময় রথখলা মাঠ রথ উৎসবে মুখরিত হয়ে উঠে। কিশোরগঞ্জের রথখলা রথ উৎসবের ঐতিহ্যে এ অঞ্চল প্রসিদ্ধ হয়ে আছে।রথখলা মাথ আগে এত ছোট ছিলনা,বিস্তৃত পরিসর ও দূর্বাঘাসে শোভিত ছিল।মনোরম পরিবেশ ও আভিজাত্যের ছোঁয়া ছিল।রথমেলার সময় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যেত এ মাঠ মানুষের পদভারে। মাঠের পাশের পুকুরটিও ছিল অপরুপ সুন্দর। নারী,পূরুষ যুবক,বৃদ্ধ কিশোরের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠতো রথযাত্রা ও রথমেলা।

 মানসী সিনেমা হলের সামনে এখন যে, দোকানগুলি বসেছে এগুলো তখন ছিলনা।সবুজ ঘাসে পরিপূর্ণ ছিল মাঠের আঙিনা। বিকালবেলা আড্ডা বসতো মাটির উপর ঘাসের বিছানায়।

এখন রথখলা নাথ দেখে তা কল্পনায় করা যায়না। ৩০/৪০ বছর আগে যিনি এই শহর ছেড়েছেন তিনি যদি এখন এই শহরে আসেন তাহলে তাকে অবাকই হতে হবে। কারণ চিরচেনা এই কিশোরগঞ্জ ও রথখলার আজ অতীত স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। পৌনে চারয়ানির জমিদার বিরাজ মোহন রায়, আবতাব মাস্টার,সুন্দর আলী, মানিক কাজী ও কালুবাবুরাও আজ নেই,রথখলার সেই ঐতিহ্যও স্মৃতির অতলে হারিয়ে আছে। মানসী সিনেমা হলটি নিয়েও যথেষ্ট ঝামেলা হয়েছিল। অনেকেই এর বিরোধিতা করেছেন। মামলা মোক্কদমাও হয়েছে সিনেমা হল প্রতিষ্ঠা নিয়ে। কিন্তু বিরাজ মোহনের সাথে অন্যরা কুলাতে পারেনি। মানসী হল টিকে রয়েছে। হারিয়ে গেছে রথখলার ঐতিহ্য। এখন রথখলার চারপাশে গড়ে উঠেছে বাড়ি ঘর,দোকান পাঠ।

এমন একদিন হয়তো আসবে রথখলা মাঠের অস্তিত্বই আর খুঁজে পাওয়া যাবেনা এমন আলামতই লক্ষনীয়। সময়ই সব বলে দেবে। যাক আসব কথা, আমি আজ রথখলার অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে লিখতে চাই। কারণ রথখলা মাঠ ঐতিহ্যমন্ডিত হয়েছে অন্য একটি কারণে। রথখলা মাঠ মনে হলেই স্মৃতিতে ভেসে ওঠে জনসভা, উচ্চকিত সমাবেশ ও বিদ্রোহের কন্ঠস্বর। এ মাঠেই পরতে পরতে লুকিয়ে রয়েছে গনতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাস। একটি সুতীব্র আকাঙ্খা ও বাসনা আজো কালের সাক্ষী হয়েবার বার ফিরে আসে।এই রথখলা হয়ে ওঠে আন্দোলন সংগ্রাম আর মুক্তির ময়দান। রাজনীতি বজ্রকন্ঠ হাজার জনতার মিছিলে মিছিলে উপচে পড়া রথখলা ময়দান আমাদের চেতনার বহিঃপ্রকাশ। মুক্তির ইতিহাসে অভিন্ন স্পন্দিত এক রণাঙ্গন।

সেদিনের সেই ঐতিহাসিক রথখলা আজ নতুন প্রজন্মের নিকট গবেষণার বিষয়বস্তু মাত্র। ষাটের দশক আর সত্তরের গনআন্দোলনের দিনগুলোতে এখানে ছত্রজনতা রুদ্ররোষে ফেটে পড়তেন। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান  শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনের দিনগুলিতে কিশোরগঞ্জের ছাত্র নেতৃবৃন্দ এই মাঠে উচ্চকিত হয়েছেন।এ মাঠ থেকেই প্রায় প্রতিটি সিদ্ধান্ত গৃহীত ও বাস্তবায়নের শপথ নেওয়া হতো।এই মাথের কথা মনে হলেই মনে পড়ে যায় ছাত্রনেতা লতিপুর রহমান খান মরু,কবির উদ্দিন ভূঁইয়া, আনম তোফিক, মোজাম্মেল হক খান রতন,বিমলাংশু রায়,রাজনীতিবিদ গঙ্গেস সরকার, চুন্নু মিয়া,আবদুস সাত্তার উকিল,জমিয়ত আলী আরো অনেক নাম যারা এই কিশোরগঞ্জের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রিত করেছেন।রথখলা মাঠে বৃটিশ আমলেওজনসভা হয়েছে।এখানে নেতাজী সুভাষ বোস বক্তৃতা দিয়েছেন। পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বজ্রকন্ঠে কথা বলেছেন জননেতা মাওলানা ভাসানী। অনলবর্ষী বক্তা আওমালীগ নেতা আবু তাহের খান পাঠানের বক্তৃতাও মাঠে অনেকেই শুনেছেন।বাংলাদেশের জন্মের পরও ন্যাপ নেতা আয়ুব রেজা চৌধুরীর বজ্রকন্ঠ এখানে ধ্বনিত হয়েছে।স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি কিশোরগঞ্জের কৃতি সন্তান সৈয়দ নজরুল ইসলাম এখানে দাঁড়িয়ে জনতাকে পথনির্দেশনা দিয়েছেন।বর্তমান সরকারের মাননীয় স্পীকার তখনকার দিনের ছাত্রনেতা আবদুল হামিদ সর্বপ্রথম এই মাঠেই স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। এখানে বক্তৃতা করেছিলেন উপনেতা নগেন সরকার, ন্যাপ নেতা আধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। এসব স্মৃতি আজো অনেক্কে আলোড়িত করে।

কিশোরগঞ্জের রাজনৈতিক প্রতিটি আন্দোলনের পাদপীঠ এই রথখলা ময়দান আজ হারিয়ে যাচ্ছে।