মেয়ের নাম রেখেছিলেন – গুরুদাসী। “গুরুদাসী”-কি অদ্ভুত নাম! গুরুদের দাসী। ছেলের নাম রেখেছিলেন হরেন্দ্র সাহা । নিজের নাম মালতী রানী সাহা। ছেলের বয়স ষাট, মেয়ের বয়স পয়ষট্টি। স্বামী গত হয়েছেন অনেক গুলো বছর আগে কোন বর্ষন মুখর রাতে। অবহেলায় অনহারে অর্দ্ধাহারে মালতী রানী বসবাস করেন মেয়ে গুরুদাসীর সাথে। গুরুদাসীর নিজেরই চলেনা, ঝি এর কাজ করে বাড়ি বাড়ি। রসমনদের বাড়ীর পেছনের ছোট ঘরে ভাড়া থাকে। ছেলে হরেন্দ্র, খোজ খবর নেয় না তেমন। তবুও চুপি চুপি হরেন্দ্রের ছেলেদের, লেবেঞ্ছুস বাতাসা, মোয়া মুরকী দিয়ে অন্য গাঁ থেকে অনেক কষ্টে গিয়ে নিয়ে আসেন গুরুদাসীর বাড়িতে, নাতি দের সাথে হাসি তামাসা করেন মালতী রানী। গুরুদাসী উষ্মা দেখায়। বকাঝকা করে। মালতী রানী ফোকলা দাঁতে কখনো হাসেন, কখনো কাদেন।
বছর ঘুরে “সন্ন্যাস” এর সময় এসেছে। সনাতন ধর্মালম্বী মা, বাবা যদি আতুর ঘরে ছেলে বাচ্চার জীবন বিপন্নতা আশংকায় “সন্ন্যাস” পালনে “মান্নত” করে থাকে, সেই হিন্দুধর্মালম্বী ছেলেদের কে বয়ঃসন্ধি কালের পর থেকে নিদৃষ্ট বয়স পর্যন্ত, বছরে একমাসের জন্য সন্নাসব্রতী হতে হয়। এ সন্ন্যাস দল, ভিন্ন ভিন্ন এলাকা থেকে বছরের একটা সময়ে একত্রিত হয়ে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে ভজন কীর্তন করে বাড়ী বাড়ী। এক কাপড়ে থাকতে হয় প্রায় একমাস। মাটিতে ঘুমাতে হয়। সারাদিন উপোস। সন্ধ্যাতে ফলাহার, অনেক রাতে খিচুরী, নিরামিষ ভোজন।
আমার প্রতিবেশী রসমন সাহা সারজীবন ছোটবেলা থেকেই এ কাজটা করে আসছে। এ বছর আমাদের রসমন বিয়ে করেছে অতএব আমি এবছর কৌতুহল ভরে লক্ষ্য রাখছি ওর সন্ন্যাসামীতে। যতই দিন যাচ্ছে রসমন এর অস্থিরতাও বাড়ছে। শুনছি নতুন বৌ ফেলে রেখে রসমন এবছর অসন্ন্যাস হওয়ার জন্য নানা প্রকার শারীরিক প্রতিবন্ধকতার ফন্দি ফিকিরে করছে। রসমনের বড় ভাই, বৌ দিদিরা এ নিয়ে রসমনের সাথে বাক বিতন্ডতাও করছে। বেচারা রসমনের জন্য আমার কোথায় যেন একটা অনূভুতি চিন চিন করছে ।
এক গভীর রাতে “মা” এর ভজন গাইতে গাইতে ঢোল করতালের সন্ন্যাস দল রসমনদের বাড়ীতে উপস্থিত । মঙ্গল উলুধ্বনিতে আলোড়িত হলো রাতের আকাশ। দরজাটা খুলে আমি বাইরে এসে দাড়ালাম, চলতে থাকলো সন্ন্যাসীদের কীর্তন,ভজন। সন্ন্যাসীদের কে রসমন পরিবার থেকে দেয়া হতে থাকলো চাল ডাল এর ভিক্ষা।। তিন জন সন্নাস ইতিমধ্যা রসমনের দরজাতে- কড়া নাড়তে থাকলো। রসমন বেড়িয়ে এলো গেরুয়া বসনে। এই প্রথম বারের মত আমাদের রসমন সন্ন্যাস কে কাদতে দেখলাম। সন্ন্যাস বেশে রসমন বিদায় নিচ্ছে, বৌ মুখে কাপড় গুজে কান্না লুকানোর চেস্টায় ব্যস্ত। দলনেতা হরেন্দ্র এর নেত্রীত্বে “মা” এর ভজনে সন্ন্যাস দল রাতের রাস্তায় অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ আমার পাশে কারো যেনো ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজ পেলাম। ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলাম, মালতী রানী (হরেন্দ্রের মা) হরেন্দ্রের গলার আওয়াজে অসুস্থ শরীরে চুপিসারে দরজা খুলে চলে এসেছেন সন্ন্যাস ছেলে হরেন্দ্রকে এক নজর দেখতে। মালতী রানী কাদছেন আর ছেলেকে দেখছেন। খোল করতলের আওয়াজ আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেলো ।আমি শুয়ে পরলাম। মালতি রানী তখনো কাদছেন। গুরুদাসী বকছে- “যেই পুতে একবেলা বাত (ভাত) খাইতে দেয় না, আসল মা’এর ভজন না কইরা দেবী মা’এর লাইগগা “মা” “ মা” কইরা বেমরায়- হের লেইগগা আবার কান্দে… বুড়ীর যে কবে মরন অইবো”।
প্রায় প্রত্যেক রাতেই বিভিন্ন সন্ন্যাস দল আসছে, কীর্তন হচ্ছে। শেষ রাত পর্যন্ত রসমন দের বাড়ীতে রান্না বান্না চলছে। সন্ন্যাসরা খাওয়া দাওয়া করছে। রসমন এর বৌ অন্যান্যদের সাথে সন্ন্যাস দের যত্নার্তিতে খুবি ব্যাস্ত। হয়তো স্বামীর কথা ভেবে বা বিরহে, যেন ভীন্ন সন্ন্যাস দলের সেবা যত্নই রসমন বৌ এর একমাত্র ব্রত।
পরের দিন সকালে জানতে পারলাম, মালতী রানী খুব অসুস্থ, ঘর থেকে বের করে ফেলেছে। গিয়ে দেখলাম মৃতপ্রায় মালতী রানী উঠানে একটা পাটিতে শায়িত, নাকে মুখে মাছি বসছে- খেয়াল নাই। আমি ডাক্তার ডাকলাম। ঔষধ পথ্য এলো। গুরু দাসীর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও মালতী রানী কে আবার ঘরে উঠানো হলো। আস্তে আস্তে সেরে উঠলেন। লাঠি ভর করে আবার চলা শুরু হলো। যথারিতী আমার কাছে নতুন কাপড় এর বায়না ধরলেন। আমি অনেক আগেই আমার একটা ছোট কাজের জন্য মনে মনে মালতি সাহা কে ধরে রেখেছিলাম। কাজটা শেষ করলাম। ক্যামেরার সামনে উনার অভিনয় শৈলীতে আমি ছিলাম মুগ্ধ।
যথারিতী কোন এক গভীর রাতে “মা “ এর ভজন করতে করতে হরেন্দ্রের নেত্রিত্বে রসমন সন্ন্যাসীদের দল ফিরে এলো। আমি বাইরে এসে দাড়ালাম। রসমন বৌ আনন্দে আত্মহারা। ভজন, কীর্তন চলছে। ঊলুধ্বনি তে মুখরিত। রাত বাড়ছে। আমাদের বাড়ির সবচে ঊচু নারকেল গাছটা হেলে দুলে জানান দিচ্ছে বাতাস বেগের তীব্রতা। রসমন দের বাড়ীর হ্যাজাক লাইট গুলু বাতাসে, ধপাৎ, ধপাৎ করছে। ততক্ষনে ভজন, কীর্তন থেমে গেছে। হটাৎ করেই গুরুদাসীর বুকফাটা আর্তনাদ- এক দৌড়ে ছুটে গেলাম ওদের ঘরে। মালতী রানীর অন্তিমকাল, চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে। হিন্দুরিতী অনুযায়ী চামচ দিয়ে কি কি যেন মুখে দেয়া হচ্ছে, তুলসী পাতা আনা হয়েছে। আমি হরেন্দ্র কে ডাকতে বললাম। ঝড়ের বেগে ছুটে ঘরে এলো হরেন্দ্র । মা মা বলে ঝাপিয়ে পরলো, মা’ এর বুকে। মালতী রানী আস্তে করে হরেন্দ্রের হাত টা চেপে ধরে বললেন… বাবা হরেন্দ্র, বা-বা হ-রে-ন্দ্র।
পুনশচঃ মা, সন্তান সন্ততির বছরের প্রতিটি দিনই হউক অকৃত্রিম ভালোবাসাতে টইটম্বুর ।