সংলাপের কোন লক্ষণ নেই। দুই বড় রাজনৈতিক দলই অনড় অবস্থানে। অনবরত বাসে আগুন দেয়া ও বোমা হামলা হচ্ছে। নিরপরাধ সাধারণ মানুষ পুড়ে কয়লা হচ্ছে। ঝলসে যাচ্ছে সুন্দর মুখ ও দেহের অন্যান্য অংশ। বাসা থেকে বেড়িয়েই এক অজানা আতংঙ্ক ভীড় করে আমাদের সবার মাথায়। কখন জানি কি হয়? অবস্থা এমন হয়েছে, সবাই বুঝতে পারছে অবস্থাটা, তবু যার যার সম্পর্কের জায়গা থেকে একটু পরামর্শ বা উপদেশ দিতে কেউ ভুল করছেন না। পিতা সন্তানকে বের হবার সময় দেখে-শুনে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন। স্ত্রী তার স্বামীকে পরামর্শ দিচ্ছেন সাবধানে চলার। আর এ দিকে স্ত্রী বাসায় বসে বসে সারাটা দিন অজানা এক দুশ্চিন্তায় দীর্ঘ সময় গুণতে থাকেন। মনে সংশয় জাগতে শুরু করে, আমার সন্তান-স্বামী সুস্থ্য অবস্থায় বাড়ী ফিরবে তো? নাকি কোন বিপদে আটকে গেছে ! সময় গড়িয়ে বেলা শেষে যখন নিরাপদে ঘরে ফেরা হয়, তখনই শেষ হয় একজন মায়ের ও স্ত্রীর উৎকন্ঠার দিন। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? একটা স্বাধীন দেশে নিরাপত্তার এই দুর্দশা ভাবলে কান্না ছাড়া কিছুই আসে না। চলমান এ অমানবিক সহিংসতার চিত্রই কি আমাদের গণতান্ত্রিক চর্চার প্রতিবিম্ব? এই স্বার্থানেষী জনস্বার্থবিরোধী রাজনৈতিক অবস্থার কি পরিবর্তন ঘটবে না?
একটা বিষয় আরো দুঃখ জনক। সেটা হলো আগুনে বা পেট্রোল বোমায় ঝলসে যাওয়া মানুষদের অধিকাংশই নষ্ট রাজনীতির জটিল সমীকরণ বুঝে না। তারা জীবিকার তাগিদে সাড়া দেওয়াকেই একমাত্র রাজনীতি মনে করেন। অথচ ঘুরে ফিরে এই নষ্ট রাজনীতির বলি হয় নিরীহ মানুষগুলো। আর কতকাল এই সাধারণ মানুষগুলোর জীবন নিয়ে রাজনীতি চলবে?
এছাড়াও একটা বিষয় ভাবলে নিজেকে মানুষ ভাবতে কষ্ট হয়। সেটা হলো, দলীয় হাইকমান্ড থেকে রাজনৈতিক কর্মসূচীর ঘোষণা দেওয়া হয়। আর হাইকমান্ড থেকে আসা নির্দেশনার বাস্তবায়ন ঘটান দলীয় সমর্থক বা ভাড়াটে কর্মী। কিন্তু তারাও তো মানুষ, তাদেরও তো স্বজন-পরিবার-পরিজন আছে। কিভাবে সে একটা মানুষ হয়ে দলীয় স্বার্থে বা অর্থের লোভে অন্য একটা মানুষের জীবনে অমানবিক বিপর্যয় বা বর্বরতায় দায় মাথায় তুলে নেয়? হায়রে মানুষ! একটি প্রবাদ আছে, কাক নাকি কাকের মাংস খায় না, আমরা তো দেখি সেই কাকের চেয়ে অধম হয়ে গেলাম। মানুষ শব্দের ব্যাকরণগত দিক দেখলে দেখা যায়, মানুষ শব্দটি এসেছে ‘মনুষ্য’ বা ‘মানব’ শব্দের অপভ্রংশ হিসেবে। পৌরাণিক সূত্রমতে ‘মানব’ বা ঋষি মনুর সন্তান (যেমন দানবরা দনুর সন্তান)। সেই হিসেবে অমরা কি মনুর বদলে দনুর সন্তান হয়ে গেছি? উত্তর মিলে না। মিলাতে পারি না। আমাদের মানবিকতা বা মনুষ্যত্ববোধ বলে কিছু আছে নাকি? নাকি সেটারও পচন হয়ে গেছে?
মানুষের যদি গ্যাংগ্রিন (এক ধরণের পচন রোগ) হয়, তখন দেখা যায় মানুষ বাঁচার তাগিদে সেই পচন ধরা অংশটুকু কেটে ফেলে দিয়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে দেখছি, নষ্ট রাজনীতির নামে যে গ্যাংগ্রিন আমাদের মানসিকতায় প্রবেশ করেছে। সেটা থেকে আমরা পরিত্রাণ চাচ্ছি না। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে, গ্যাংগ্রিন এ আক্রান্ত অংশটুকু কেটে সময়মত চিকিৎসা না করালে, সারা দেহে এর পচন ছড়িয়ে পড়বে। আর তখন ইচ্ছে করলেই পচনরোধের আর কোন উপায় থাকবে না। দুই পয়সার আলতা ছবিতে মিতালী মুখার্জীর গাওয়া গানের কথার মতো কেন জানি বার বার মনে হয়, এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই/ মানুষ নামের মানুষ আছে দুনিয়া বোঝাই/ এই মানুষের ভীড়ে আমার সেই মানুষ নাই।
সুমিত বণিক, উন্নয়নকর্মী