প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশকে দেয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের অঙ্গীকার, ফারাক্কা চুক্তির ৯ নং ধারার সুস্পষ্ট লংঘন ও আন্তর্জাতিক রীতিনীতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বরাক নদের ওপর বাঁধ (ড্যাম) নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণের সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর অন্যদের মতো আমরাও উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ি।
আমাদের এ উদ্বেগ-উৎকন্ঠা আতঙ্কে রূপ নেয়, যখন আমরা দেখি এই বাঁধ নির্মাণের পক্ষে বাংলাদেশ সরকারের কয়েকজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি অত্যনত্দ খোলামেলা অবস্থান নিয়েছেন। বাংলাদেশ সরকারের তিনজন প্রভাবশালী উপদেষ্টা ও মন্ত্রী এ বিষয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাহলো, এক. ভারতের সরকার প্রধান আমাদের আশ্বস্থ করেছেন বাংলাদেশের ক্ষতি হয়, এমন কিছু তারা করছেন না। দুই. বরাক নদের টিপাইমুখ ভারতে অবস্থিত; ভারত সরকার এ নিয়ে যা কিছু করবে, তা সেদেশের অভ্যনত্দরীণ ব্যাপার, সেখানে আমাদের কিছু করার নেই, এবং তিন. ভারতের নির্মাণাধীন এ বাঁধ বাংলাদেশের জন্য উপকার বয়ে আনবে, এর বিরোধিতাকারীরা কিছু না জেনেই এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিরোধিতা করছেন।
সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের এ ধরনের বক্তব্য প্রদানের পর থেকে আমাদের দেশের নদী, পানি, বাঁধ, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের অনেকে এর বিরুদ্ধে নিজেদের যুক্তি ও প্রকৃত বাসত্দবতা তুলে ধরে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেছেন, করছেন। এমন একটি অবস্থার মধ্যে আমরা কতিপয় হাওড় অঞ্চলবাসী বিষয়টি সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার জন্য গত ১৭ ডিসেম্বর ২০১১ সনে ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটি মিলনায়তনে দেশের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কয়েকজনের সঙ্গে মতবিনিময় করার একটি উদ্যোগ নিই এবং আমাদের পরিচিত গণ্ডির মধ্যে আমাদের জানামতে এ নিয়ে উদ্বিগ্ন অন্যদের উপস্থিত হতে অনুরোধ জানাই। উক্ত মতবিনিময় সভার পরে আমরা আমাদের করণীয় নির্ধারণের জন্য বিগত ৭ই জানুয়ারি ২০১২ সালে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে পুনরায় এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হই। এই সভায় দীর্ঘ আলোচনা শেষে আমাদের বক্তব্য ও করণীয় সম্পর্কে একটি খসড়া ধারণাপত্র/অবস্থানপত্র প্রস্তুতের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় এবং বর্তমান ‘অবস্থানপত্র’ তৈরির এই হলো প্রেক্ষাপট।
হাওড় অঞ্চল বলতে আমরা কি বুঝি?
বাংলাদেশের প্রায় এক সপ্তমাংশ এলাকা জুড়ে অঞ্চল বিসত্দৃত। এর আয়তন প্রায় ৮ হাজার বর্গমাইল। দেশের সিলেট সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া ও মৌলভীবাজার জেলার কমবেশি এলাকা নিয়ে এ অঞ্চল অবস্থিত। উত্তরে ভারতের মেঘালয়, পূর্বে আসাম-মণিপুর, আর দক্ষিণে ত্রিপুরা মিজোরামের পার্বত্য অঞ্চলবেষ্টিত এ অঞ্চলের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য তাকে পৃথিবীতে এক অনন্য জৈব-জলবৈচিত্র্যের লীলাভূমি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাংলাদেশে যে ২৩৭ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ পাওয়া যায় তার ১৪০ প্রজাতির বসবাস এ অঞ্চলে।
অভ্যন্তরীণ জলাভূমির (Inland Water Bodies) ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে তৃতীয় স্থান দখল করে আছে তার কারণও এ অঞ্চল। বিশ্বে বাংলাদেশের চাইতে এক্ষেত্রে শুধু ভারত আর চীন এগিয়ে। এ অঞ্চলে সরকারি হিসাবে হাওড় রয়েছে ৪১১টি, কিন্তু বর্ষাকালে এই সবগুলো মিলে একটিমাত্র হাওড় হয়ে ওঠে। এলাকার মধ্যে দ্বীপসদৃশ ছোট ছোট গ্রাম আছে বটে, কিন্তু এক হাওড়ের সঙ্গে আর এক হাওড়ের কোনও দেয়াল নেই।
বাংলাদেশের নদীর মানচিত্রের দিকে চোখ বুলালে যে কেউ বুঝতে পারবে, হাওড়ের প্রধান নদী কয়েকটাই। কিন্তু সারাটা জুড়েই কিলবিল করছে নদী-খাল-বিল-বাওড় আর জলা। এ অঞ্চলে ছোট বড় জলমহালের পরিমাণ প্রায় তিনহাজার। এর মাঝে টাঙ্গুয়ার হাওড়কে জৈব বৈচিত্র্যের জন্য রামসার সাইট হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আর হাকালুকিকে ঘোষণা করা হয়েছে প্রতিবেশগত বিপদাপন্ন অঞ্চল (ঊপড়ষড়মরপধষ ঊহফধহমবৎবফ তড়হব) হিসাবে। এখানকার জল-জৈববৈচিত্র্য বিশ্বে প্রায় অতুলনীয়। হাওড়ের কোনও কোনও অঞ্চল বর্ষায় প্রায় ১০ মিটার পর্যনত্দ পানিতে ডুবে থাকে আর শীতকালে প্রায় সবটাই ভেসে উঠে। এই অনন্য পানি প্রবাহকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠেছে এখানকার কৃষি আর মৎস্য সম্পদ, এখানকার লক্ষ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা আর সংস্কৃতি।
ময়মনসিংহ গীতিকার বিখ্যাত আখ্যানগুলোর প্রায় সবই হাওড়কেন্দ্রিক। চন্দ্রাবতীর কাব্য থেকে হাছন রাজা, রাধারমণ, জালাল থেকে উকিল মুন্সী এবং শাহ আবদুল করিম-সহ অন্যদের সবারই সৃষ্টির উৎস এই হাওড়। হাজার বছর ধরে এ গাঙ্গেয় অববাহিকায় লক্ষ-কোটি টন পলি বয়ে গেছে, গড়ে উঠেছে নতুন নতুন ভূমি কিন্তু হাওড়ের এ বৈশিষ্ট্য রয়ে গেছে প্রায় অক্ষুণ্ন। গত ৭০০ বছরে যে হাওড়ের তেমন কোনও পরিবর্তন হয়নি, তার প্রমাণ মেলে ইবনে বতুতার ভ্রমণ কাহিনী থেকেই।
আমরা যারা হাওড়ের মানুষ, যারা নদী বা পানি বিশেষজ্ঞ নই, যারা কৃষিবিজ্ঞান পড়িনি, যারা পৃথিবীর প্রাণী আর বৃক্ষাদির ওপর তাপ আর চাপ নিয়ে গবেষণা করিনি, তারাও আমাদের পূর্বপুরুষদের হাজার বছরের লোকায়ত জ্ঞান থেকে জানি, কার্তিক মাসেই বোরো ধানের বীজ জাগ (জন্ম) দিতে হয়, অঙ্কুরোদগম সত্ত্বেও তাপমাত্রার হেরফেরে ধানের চারা কিভাবে জমিতে মিলিয়ে যায় আমরা তা ভালো করেই জানি। আমরা জানি, পৌষ মাসের মধ্যে ধানের চারা রোপণ না করা গেলে (অনত্দত পৌষ মাসের চান থাকতে থাকতেই) জমিতে শত সার দিয়েও ফলন ঠিক হয় না।
আমরা জানি, চৈত-বৈশাখে, ঠিকমতো উইজ্জা (ঝড়-বৃষ্টি, বজ্রপাত আর তাতে ছোট ছোট স্রোত) না হলে দেশী মাছের ঠিকমতো প্রজনন হয় না। যে বছর ভালো বর্ষা হয় না, সে বছর নদীতে, জলাতে মাছ পাওয়া যায় না।
আর আমাদের এ জানা বহু শত বছর ধরে ভুল হয় না। কারণ আমাদের বর্ষায় যে বৃষ্টিপাত (প্রতি বছর প্রায় ৪০০০ মিলিমিটার) হয় শীতে সে পানি আমাদের নদীগুলো এমনভাবে বয়ে নিয়ে যায়, যাতে প্রথমে বীজতলা ভাসে, পরে জমি ভাসে, বিলের পাড় জেগে ওঠে। অতিথি পাখিরা বেড়াতে আসে আর আমরা ধান রোপণ করি। বর্ষায় তলিয়ে যাওয়ার আগেই ধান পেকে উঠে। এসব জানা বৈশিষ্ট্যের কথা এখানে বেশি করে বলা হলো, কারণ আমরা টিপাইমুখ বাঁধের প্রভাব নিয়ে যত পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখা পড়েছি তার মধ্যে আমাদের হাওড়ের এ অনন্য বৈশিষ্ট্যসমূহকে তেমন করে বিবেচনায় নেয়া হয়নি বলে আমাদের মনে হয়েছে।
এ অঞ্চলের আর একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো সমূদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা মাত্র ৪/৫ মিটার। জলবায়ূ পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে আমাদের যেসব অঞ্চল অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে বলে মনে করা হচ্ছে, এ অঞ্চল যে তার মধ্যে অতিবেশি নাজুক, তাও বিবেচনা নেওয়া হচ্ছে না। পানি প্রবাহের সামান্য হেরফের যে এ অঞ্চলের লক্ষ কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদনের একমাত্র ফসল বোরো চাষকে ধ্বংস করে দিতে পারে তা বলাই বাহুল্য। বাংলাদেশের মোট উৎপাদনের ৫ ভাগের ১ ভাগ ধান উৎপন্ন হয় শুধু এ অঞ্চলেই।
অঞ্চলের লাভ-লোকসানের বির্তকঃ টিপাইমুখ বাঁধের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া বা অঞ্চলে এর অভিঘাত সমর্্পকে দু’টি বক্তব্য প্রচলিত আছে। একপক্ষে ভারত সরকার এবং বাংলাদেশ সরকার আর অন্যপক্ষে বিশেষত উত্তরপূর্ব ভারতের জনগণ এবং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক জনগণ। এ পর্যন্ত পত্রপত্রিকা, ইন্টারনেট, বিভিন্ন বুলেটিন-সহ নানা মাধ্যমে যেসব মতামত পাওয়া গেছে আমাদের বিবেচনায় এগুলোকে প্রধানত তিনভাগে ভাগ করা যেতে পারে:
এক. বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের মতামত: নীতিগতভাবেই এরা বড় বাঁধ বা ড্যামের বিরোধী। এরা বিশ্বাস করে প্রকৃতিবিরোধী কোনও কর্মকাণ্ডই শেষ পর্যনত্দ মানুষের কল্যাণে আসে না, সাময়িকভাবে লাভজনক মনে হলেও এগুলোর দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতি অপরিমেয়। টিপাইমুখ বাঁধও তার ব্যতিক্রম নয়। ভাটির দেশ হিসাবে বাংলাদেশের এ বাঁধ থেকে লাভবান হওয়ার কোনও হেতু নেই।
দুই. পরিবেশবাদীদের বাইরে, আমাদের দেশের যেসব বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে এখন পর্যনত্দ তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন তারাও বিভিন্নভাবে যা বলেছেন সেসব এ বাঁধ থেকে আমাদের কি কি ধরনের ক্ষতির আশংকা রয়েছে তারই বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নধর্মী লেখা।
তিন. এই দুই ধরনের বিরোধিতার বাইরে আর এক ধরনের বিরোধিতা আমরা দেখছি তাহলো রাজনৈতিক বিরোধিতা। সরকার ছাড়া বাংলাদেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দলই টিপাইমুখ বাঁধের বিপক্ষে তাদের অবস্থান জানাতে নানা ধরনের কর্মসূচি নিয়েছে। তার মধ্যে হরতাল, লংমার্চ, সবই আছে। তবে এ ধরনের প্রতিবাদ জানান দেয়া ছাড়া সত্যিকার অর্থে এ বাঁধের ক্ষতি থেকে দেশকে রক্ষার জন্য করণীয় বিষয়ে তারা সবাই প্রায় নিঃশ্চুপ। টিপাইমুখ বাঁধ ইসু্যতে এই সমসত্দ দল, সরকারকে, দেশের স্বার্থের বিপরীতে ভারতের এজেন্ট বা তাঁবেদার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর। কিন্তু এ ক্ষতি থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রকৃত করণীয় নির্ধারণে তারা ততটুকু অতৎপর বলেই মনে হয়।
তবে এতসব বিরোধের মধ্যে এখন পর্যন্ত স্বীকৃত সত্য হলো টিপাইমুখ বাঁধের প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে তা নির্ধারণের জন্যে কোনও যৌথ বা আনত্দর্জাতিক পর্যায়ের কোনও সমীক্ষা এখনও পর্যন্ত হয়নি।
ভারতের পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেওয়ার জন্যে যে গবেষণাপত্র জমা দেয়া হয়েছে তার যথার্থতা নিয়ে ভারতের ভেতরেই প্রচুর সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে এবং এ গবেষণার ক্ষেত্র কেবল ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশে যারা বাঁধের পক্ষে কথা বলেন, তারা নিজেদের অবস্থানের পক্ষে যেসব গবেষণাপত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন তার একটি হলো, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বন্যানিয়ন্ত্রণ প্রকল্প, তথা ফ্যাপ-৬ এর গবেষণাপত্র, যার মূল প্রতিপাদ্য ছিল বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা স্বীকার করেন যে, তাদের গবেষণা পরিচালিত হয়েছিল ধারণাপ্রসূত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে।
অথ্যর্ৎ দুই পক্ষের মধ্যে স্বীকৃত বিষয়টি হলো, টিপাইমুখ বাঁধের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিয়ে কোনও পূণাঙ্গ এবং যৌথ গবেষণা হয়নি, কিন্তু ভারত বাঁধ নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে আমাদের দাবি খুব সামান্য।
আর তাহলো:
(১) টিপাইমুখ বাঁধ বা ড্যাম সম্পর্কিত সকল তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করতে হবে।
(২) টিপাইমুখ বাঁধের সম্ভাব্য অভিঘাত নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষা পরিচালনা করতে হবে, এবং
(৩) উক্ত সমীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পূর্ব পর্যনত্দ টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ কাজ স্থগিত রাখতে হবে।
(৪) হাওড় অঞ্চলের পানি প্রবাহকে ক্ষতিগ্রসত্দ করে এমন একতরফা সব প্রকল্প বন্ধ করতে হবে।
আমাদের অবস্থান বিশ্বাস ও করণীয়ঃ
এটা স্পষ্ট করে বলা ভালো আমরা এখনও পর্যন্ত যারা উদ্যোক্তা তাদের বেশিরভাগ মনে করে, টিপাইমুখ ড্যাম যে আমাদের জন্যে ক্ষতির কারণ হবে তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। এ কারণে এই বাঁধের কাজ বন্ধ করার জন্য পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। কিন্তু এটাও সত্য, সংখ্যায় কম হলেও, কেউ কেউ এমনও মনে করেন যে, প্রকৃত গবেষণা ছাড়া এটা শুধুমাত্র ‘প্রপাগান্ডা’ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক নয়। সরকারি ভাষ্যমোতাবেক এ ড্যাম আমাদের জন্য মঙ্গলজনকও হতে পারে।
আমরা সাধারণভাবে বিশ্বাস করি যে, আমাদের জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক বা মতাদর্শিক বিরোধ বা ভিন্নমত থাকলেও প্রত্যেকে তার নিজস্ব অবস্থান থেকে দেশকে ভালোবাসেন এবং দেশের স্থায়ী এবং ব্যাপক ক্ষতি হয়, এমন কোনও কার্যক্রম তারা সমর্থন করেন না।
আমাদের এ আস্থা এবং বিশ্বাসের অবস্থান থেকে আমাদের কর্মসূচিকে আমরা এমনভাবে নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছি যাতে দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি সামান্য ভালোবাসা আছে এবং যারা অন্ধ দলীয় আনুগত্যের বাইরে এসে নূন্যতম যৌক্তিক অবস্থান নিতে সক্ষম, সেরকম প্রতিটি মানুষ এ কর্মসূচির মধ্যে তাদের অবস্থান নেয়ার যুক্তি খুঁজে পান।
আমাদের কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কেঃ প্রথমে বলে নেয়া ভালো আমরা কোনও রাজনৈতিক দল বা সংগঠন নই। কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতি আমাদের পক্ষপাত বা বিদ্বেষ কোনওটাই নেই। আমরা এমনভাবে কর্মপরিচালনা করতে চাই, যাতে আমাদের ঘোষিত লক্ষ্য ও কর্মসূচির সঙ্গে কোনও রাজনৈতিক দলের কোনও সংঘাত তৈরি না হয়।
এ উদ্যোগে এখন পর্যনত্দ কোনও নেতৃত্ব বা সাংগঠনিক কাঠামো আমরা নির্ধারণ করিনি। এখন পর্যন্ত তৎপরতা আমরা পরিচালনা করেছি, তা শুধু আমাদের উদ্যোক্তা পর্যায়ের বন্ধুদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধানত্দের ভিত্তিতেই হয়েছে। ভবিষ্যতে যদি কোনও সাংগঠনিক কাঠামোর প্রয়োজন দেখা দেয়, তবে সকলের মতামতের ভিত্তিতে তা নির্ধারণ করতে আমরা আগ্রহী।
আমাদের অর্থের উৎস, এখন পর্যনত্দ আমাদের বন্ধুদের ও অংশগ্রহণকারীদের স্বতঃপ্রণোদিত অনুদান। এ উদ্যোগের কোনও স্থায়ী তহবিল নেই, এখন পর্যনত্দ তা গড়ার কোনও পরিকল্পনাও আমরা নিইনি। আমরা বিশ্বাস করি, কর্মকাণ্ডভিত্তিক প্রয়োজনীয় তহবিল উদ্যোক্তা বন্ধুরা নিজেদের সাধ্যমত চাঁদার মাধ্যমে পরিচালনা করতে সক্ষম হবো এবং এ জন্যে যত বেশি কাজ তত বেশি বন্ধু সংগ্রহের প্রয়োজন পড়বে।
আমাদের কর্মকৌশলঃ সাধারণভাবে দাবি আদায়ের জন্য রাজনৈতিক দল বা সংগঠনসমূহ যে ধরনের কর্মসূচি বা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে, সাধ্যমত আমরা তার বাইরে থাকার চেষ্টা করবো। এবং এজন্যে আমাদের নতুন নতুন কর্ম কৌশলের আবিষ্কার প্রয়োজন হবে।
আমাদের বন্ধুশক্তিঃ আমাদের দেশের পরিবেশকর্মী, লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনৈতি্ক কর্মী ও সমর্থক-সহ দেশের বাইরে অবস্থানরত আমাদের সনত্দান ও নাগরিকদেরকে প্রথমে একটি সাধারণ নুন্যতম কর্মসূচির আওতায় ঐকবদ্ধ্য করার জন্য আমরা চেষ্টা করবো। একই সঙ্গে দেশের বাইরে বিশেষত উত্তরপূর্ব ভারতের বাঁধবিরোধী আন্দোলনকারী শক্তি ও পরিবেশ কর্মীদের সঙ্গে সেতুবন্ধ ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন কর্মসূচি গ্রহণের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তাছাড়া আমরা দেশে ও বিদেশে ইতিমধ্যে যেসব উদ্যোগ গড়ে উঠেছে, তাদের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করবো, নতুন নতুন আরও উদ্যোগ গড়ে উঠলে তাদের সহায়তা দেবো। এক্ষেত্রে আমাদের মৌলিক নীতি হবে, আমরা শুধুমাত্র শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে যুক্ত হবো, এমন কোনও কর্মকাণ্ড বা কর্মসূচি, যা মানুষের ক্ষতির কারণ হতে পারে তার সঙ্গে আমরা যুক্ত হবো না।
আমাদের আশাবাদঃ আমরা আমাদের দাবি আদায়ের বিষয়ে আশাবাদী। আমরা আশাবাদী কারণ আমরা বিশ্বাস করি ভাটির দেশের নাগরিক হওয়া কোনও অপরাধ নয়। আমরা আশাবাদী, এ জন্যে যে, প্রায় দুই কোটি মানুষের জীবন জীবিকার একমাত্র অবলম্বন, ১৬ কোটি মানুষের এদেশের মোট খাদ্যের এক-পঞ্চমাংশের যোগানদাতা, ১৪০ প্রজাতির মাছের উৎসস্থল, ২৩৭ প্রকার জলচর অতিথি পাখির আশ্রয়স্থল এই হাওড় অঞ্চলকে কেবল ১৫০০ মেগাওয়াট বিদু্যৎ উৎপাদনের জন্যে (বিশেষজ্ঞমতে, বাসত্দবে ২০০-২৫০ মেগাওয়াটের বেশি হবে না) কেউ ধ্বংস করে দিতে পারে না।
আমাদের জনগণ, ভারতের জনগণ-সহ সারা দুনিয়ার মানুষ আমাদের পক্ষে, আমাদে্র অস্তিত্ব, জীবন-জীবিকা, প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশ-প্রকৃতির পক্ষে। আমাদের পরাজিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। সূত্রঃ ইন্টারনেট