প্রাকৃতের বাতাবরণে সংস্কৃতভাষার গর্ভে বাংলাভাষার জন্ম। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলাভাষার, বিশেষত বাংলা গদ্যের বিকাশের ক্ষেত্রে প্রধান পুরুষ ও অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। তিনিই প্রথম বাংলাভাষার পূর্ণাঙ্গ ব্যাকরণ লিখেছেন, যা মূলত সংস্কৃত ব্যাকরণেরই প্রসারণ হলেও আজ অব্ধি বাংলাভাষার ব্যাকরণ এই আদলের মধ্যেই রয়েছে।
# মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগের ১৬টি স্বরবর্ণ
# ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের ১৬টি থেকে কমিয়ে ১২টি স্বরবর্ণ
# মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগের ৩৪টি ব্যাঞ্জনবর্ণ ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগে নির্দেশিত ৪০টি ব্যাঞ্জনবর্ণ
বিদ্যাসাগরের বর্ণ পরিচয়
বাঙালির শিক্ষা-দীক্ষার পটভূমি বিচার করলেই বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ের গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠবে। মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল কাব্যে বর্ণিত শ্রীমন্তের শিক্ষারম্ভ থেকে আমরা অন্তত ষোড়শ শতকের বাংলায় শিশুর শিক্ষার সূচনাপর্বের একটা চিত্র পেয়ে যাই। পাঁচ বছরের শিশুকে গুরুর পাঠশালায় হাতেখড়ি দেওয়া হতো এবং সেখানে এই শিশু শিক্ষার্থী গুরুর কাছে মুখে মুখে এবং হাতে লেখা পুথি থেকে ভাষা, নীতি এবং জমিজমা ও ব্যবসা সংক্রান্ত হিসাব- নিকাশ, বাক্য, শ্লোক ইত্যাদি পড়ত, মূলত মুখস্থ করত। মুদ্রণযন্ত্র স্থাপিত হওয়ার পর প্রথম একটি বাধা ছিল পাশ্চাত্যের যন্ত্রে মুদ্রিত গ্রন্থপাঠে জাত যাবে-এ রকম কুসংস্কার। অন্যদিকে দেখা যায়, রাধাকান্ত দেব রচিত বাঙ্গালা শিক্ষাগ্রন্থ (১৮২১) বইটিতে বর্ণমালা, ব্যাকরণ, ইতিহাস, ভূগোল, গণিত ইত্যাদি বিষয়ের সমাবেশ ঘটেছে ও বইটির পৃষ্ঠাসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮৮! যে কারো ক্ষেত্রে-শিশু বা বৃদ্ধ-শিক্ষাজীবন শুরু করার জন্য এ রকম ঢাউস ও গুরুগম্ভীর বইকে উপযুক্ত ভাবার কোনো উপায় নেই।
বিদ্যাসাগরের আগে বর্ণমালা শেখার যেসব বই রচিত ও প্রকাশিত হয়েছিল তার অধিকাংশই বস্তুতপক্ষে শিশুর বাংলা প্রথম পাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। শ্রীরামপুর মিশনের লিপিধারা (১৮১৫), জ্ঞানারুণোদয় (১৮২০), রামমোহন রায়ের গৌড়ীয় ব্যাকরণ (১৮৩৩), শিশুবোধক, বঙ্গবর্ণমালা (১৮৩৫), রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের শিশুসেবধি, বর্ণমালা ( (১৮৪০), কলিকাতা স্কুল বকু সোসাইটির বর্ণমালা প্রথম ভাগ (১৮৫৩), ও দ্বিতীয় ভাগ (১৮৫৪) এবং হ্যালহেডের এ গ্রামার অফ দি বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজসহ (১৭৬৮) অন্যান্য বইয়ের মধ্যে বিদ্যাসাগরের পূর্ববর্তী বাংলাভাষা শিক্ষার প্রথম পাঠ হিসেবে সর্বাগ্রে নাম করতে হবে বিদ্যাসাগরেরই সুহৃদ পন্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগ (১৮৪৯) বইটির। শিশুর প্রথম পাঠ হিসেবে এটি উল্লেখযোগ্য বই।
ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় বাংলা প্রাইমার লেখায় যে জোয়ার এসেছিল তার কারণ ঔপনিবেশিক ইংরেজ সরকার তাদেরই প্রয়োজনে একটি শিক্ষিত শ্রেণী গড়ে তুলতে চেয়েছিল। শাসনকাজের প্রয়োজনে শাসিত প্রজাদের মধ্যে যেমন ইংরেজি জানা একটা শ্রেণীর প্রয়োজন তেমনি শাসক ইংরেজ ও প্রজাকুলের এই শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে স্থানীয় অর্থাৎ বাংলাভাষা চর্চারও প্রয়োজনীয়তা ছিল। বস্তুত ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি জ্ঞানার্জন ও তা চর্চার কোনো বিকল্প ছিল না। এ কাজে মাতৃভাষার চর্চাও গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়েছিল।
ওই সময় শিক্ষা বিস্তার, স্কুল প্রতিষ্ঠা, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও প্রকাশের জন্য অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। আমরা জানি শিক্ষা নিয়ে এ সময় অনেক কমিশনও গঠিত হয়, যারা জরিপ চালিয়ে প্রকৃত অবস্থা জেনে করণীয় নির্ধারণ করতে চেয়েছে। এসব প্রতিবেদনে শিক্ষা বিস্তারে অগ্রগতির অন্তরায় হিসেবে প্রায়ই পাঠ্যবইয়ের অভাবের কথা বলা হয়। ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জুন সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয়-এর সম্পাদকীয়তে লেখা হয় “গভর্নমেন্টের যে কয়টা পাঠশালা আছে তাহাতে বাংলাভাষা শিক্ষা দিবার শৃঙ্খলামাত্র নাই।—ভাষা শিক্ষার নিমিত্ত কেবল বর্ণমালা, নীতিকথা ইত্যাদি দুই-তিনখানি পুস্তক ভিন্ন অন্য পুস্তক পাঠ হয় না, তাহাতে ভাষার সম্যক জ্ঞান বৃদ্ধির কেমন সম্ভাবনা পাঠকবর্গ বুঝিতে পারিবেন।”
আবার বিভিন্ন সরকারি প্রতিবেদনে উপযুক্ত পাঠ্যবইয়ের অভাবে স্কুলে ছাত্রসংখ্যা কমে যাওয়ার কথাও উল্লিখিত হতে দেখা যায়। সব মিলিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে একটা ভালো বাংলা প্রাইমারের চাহিদা তৈরি হয়। ঠিক এই সময় বিদ্যাসাগর বর্ণপরিচয় রচনা ও প্রকাশ করেন। শিশুদের জন্য বর্ণপরিচয় রচনার গোড়ায়ই এসে পড়ে বর্ণমালার কথা। আমরা জানি ব্রাহ্মীলিপি থেকেই বিবর্তিত হয়ে বাংলা বর্ণমালার উদ্ভব হয়েছে। এ বিবর্তন প্রক্রিয়া চলেছে তিন হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে। তবে বলা যেতে পারে, বিদ্যাসাগরের হাতেই বাংলা বর্ণমালার যথাযথ উন্নতি হয়েছে, যে মৌলিক উন্নয়নের পর পরবর্তী সার্ধশতবছরে মাত্র কিছু সংস্কারমূলক কাজ হয়েছে। তাঁকে প্রথমত বর্ণমালার প্রকৃতি ও সংখ্যা নির্ধারণ করতে হয়েছে। ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হ্যালহেডের বইয়ে স্বরবর্ণের সংখ্যা ছিল ১৬। পরবর্তী প্রায় ১০০ বছর মদনমোহনের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগ (প্রকাশকাল ১৮৪৯) পর্যন্ত স্বরবর্ণের সংখ্যা ১৬টিই ছিল।
এগুলো হলো
অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, ঋৃ, ৯, ৯৯, এ, ঐ, ও, ঔ, অ০, অঃ।
বিদ্যাসাগর এই সংখ্যা কমিয়ে ১২তে নামালেন।
তিনি ভূমিকায় লিখলেন “বহূকালাবধি বর্ণমালা ষোল স্বর ও চৌত্রিশ ব্যঞ্জন এই পঞ্চাশ অক্ষরে পরিগণিত ছিল। কিন্তু বাঙ্গালা ভাষায় দীর্ঘ ঋৃ-কার ও দীর্ঘ ৯৯ কারের প্রয়োজন নাই। এই নিমিত্ত ঐ দুই বর্ণ পরিত্যক্ত হইয়াছে। আর সবিশেষ অনুধাবন করিয়া দেখিলে অনুস্বার ও বিসর্গ স্বরবর্ণ মধ্যে পরিগণিত হইতে পারে না। এই নিমিত্ত ঐ দুই বর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ মধ্যে পঠিত হইয়াছে।”
বিদ্যাসাগরের এই মৌলিক সংস্কারের ১২৫ বছর পর স্বরবর্ণে মাত্র আর একটি সংস্কার ঘটেছে, তাহলো ৯ বর্ণটি বাদ দেওয়া। এখন স্বরবর্ণ ১১টি। ব্যঞ্জনবর্ণ ছিল ৩৪টি। বিদ্যাসাগর তাতে নতুনভাবে ছয়টি বর্ণ যুক্ত করেন। আগেই বলেছি, অনুস্বার ও বিসর্গকে স্বরবর্ণ থেকে তিনি ব্যঞ্জনবর্ণে নিয়ে এসেছিলেন। তা ছাড়া বিদ্যাসাগর দেখলেন, ‘বাঙ্গালা ভাষায় একারের ত, ত্ এই দ্বিবিধ কলেবর প্রচলিত আছে।’ তাই এটিকেও ব্যঞ্জনবর্ণে যুক্ত করেছেন। আর ক্ষ যেহেতু ক ও ষ মিলে হয় “সুতরাং উহা সংযুক্তবর্ণ, এ জন্য অসংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ গণনাস্থলে পরিত্যক্ত হইয়াছে।” এভাবে তাঁর হাতে ব্যঞ্জনবর্ণ হলো ৪০টি।
আজকের দিনে বর্ণক্রমিক ভাষাশিক্ষার পরিবর্তে বাক্যক্রমিক পদ্ধতি চালু হয়েছে। শিশুর ভাষা শেখার যে স্বাভাবিক পদ্ধতি তার ওপর ভিত্তি করেই দেশে-বিদেশে এ পদ্ধতি গৃহীত হয়েছে। শতাধিক বছরব্যাপী শিশুর প্রথম পাঠ হিসেবে এ বইটি প্রায় একচ্ছত্র প্রাধান্য বজায় রেখেছে। এর পাশাপাশি মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগ এবং আরো পরে রামসুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষা বাঙালি বাড়িতে শিশুদের প্রথম পাঠের বই হিসেবে বহূকাল প্রচলিত ছিল। বলা যায় ভাষাশিক্ষার নতুন কালে প্রবেশ করে আমরা বর্ণপরিচয়ের কালকে পেছনে ফেলে এসেছি। আধুনিক বাঙালি মানসের অগ্রদূত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হলো বর্ণপরিচয় রচনা-শিক্ষিত আধুনিক বাঙালি জাতি বিনির্মাণে এ বই তার প্রথম মানসপুষ্টির যোগান দিয়েছে।
বাংলা লিপি
বাংলা লিপি ব্রাহ্মী লিপি পরিবারের অন্তর্গত একটি আবুগিদা লিপি৷ বাংলা লিপি বাংলা, অসমীয়া, মণিপুরি ও সিলেটি ভাষায় ব্যবহৃত হয়৷ দেবনাগরী লিপির সাথে বাংলা লিপির অনেক মিল রয়েছে, তবে বাংলা লিপির গঠন তুলনামূলকভাবে কম আয়তাকার ও বেশী সর্পিল৷ বাংলা লিপি দেবনাগরী লিপির পূর্বসূরী নাগরী লিপি থেকে উদ্ভূত হয়েছে বলে মনে করা হয়৷ ১৭৭৮ সালে অক্ষরস্থাপক চার্ল্স্ উইলকিন্স্ লিপিটির আধুনিক রূপ সর্বপ্রথম নিয়মাবদ্ধ করেন৷ অসমীয়া ও অন্যান্য ভাষায় বাংলা লিপির যে সংস্করণগুলো ব্যবহৃত হয়, সেগুলোতে কিছু ছোটখাটো পার্থক্য রয়েছে৷
যেমন: (বাংলা র; অসমীয়া ৰ) এবং (অসমীয়া ৱ; কোন বাংলা প্রতিলিপি নেই)৷