বাংলা সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬) এক বিস্ময়কর প্রতিভা, অনন্য কথাশিল্পী। শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের জীবনযাত্রা ও লড়াই-সংগ্রাম তিনি সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং নিপুণ শিল্পীর ন্যায় কলমের আচাড়ে তা জীবন্ত করে তুলেছেন। সেখানে তাঁর মানবপ্রেম, সামাজিক অঙ্গীকারবোধ এবং শ্রেণী দৃষ্টি ভঙ্গি সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। লেখক জীবনের শুরুতে তার মধ্যে ফ্রয়েডীয় রেখাপাত দেখা গেলেও অচিরেই তিনি তা কাটিয়ে ওঠেন। নিছক শিল্পের জন্য শিল্প নয়, তিনি বিশ্বাসী ছিলেন মানুষের জন্য শিল্প বা জীবনের জন্য শিল্প অভিধায়। এক্ষেত্রে মানুষ বলতে তিনি মেহনতী গণমানুষকে বুঝিয়েছেন। তার এ মানসগঠনে ছাত্রজীবনে বিজ্ঞান অধ্যয়ন এবং পরে দেশী-বিদেশেী সাহিত্য ও দর্শন পাঠ বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল।
এজন্য কল্লোল যুগের (১৯২৩-১৯৩০) হয়েও তিনি কল্লোলীয় তরঙ্গে আন্দোলিত হননি, স্পন্দিত হননি পূর্ব-দিগন্তের প্রখর রবিরশ্মি দ্বারা। প্রথমদিকে তিনি প্রগতি লেখক সংঘের আন্দোলনে সম্পৃক্ত না হলেও চলি্লশের দশকে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের কর্মকান্ডে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়েন। তিনি যোগ দেন কম্যুনিস্ট পার্টিতে। তখন লেখালেখির পাশাপাশি পার্টির সমাজবদলের কর্মকান্ডই তার জীবনের প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। আর এজন্য তাকে বরণ করে নিতে হয়েছিল চরম দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবন। গণমানুষের জীবনের শরিক হয়ে একজন কলমপেশা শ্রমিকের ন্যায় তিনি সারাটি জীবন অর্থকষ্টে কাটিয়েছেন; তবুও কোনো মোহ বা প্রলোভনের পঙ্কিল পথে পা বাড়াননি। ব্যতিক্রম মানিক জীবনের বৈশিষ্ট্য এখানেই। আর এজন্যই বাংলা সাহিত্যে মানিক, মানিক রতন হয়ে রয়েছেন। শত বছরের মানিক মারাও গেছেন অর্ধশত বছরের বেশি হয়ে গেল। কিন্তু আজও তার দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ছে অবিশ্রান্ত ধারায়।
তিনি জন্মেছিলেন ১৯০৮ সালের ১৯ মে সাঁওতাল পরগনার দুমকা শহরে এবং মারা যান ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর কলকাতায়। তার সাড়ে ৪৮ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে তিনি সাহিত্যচর্চা করেছেন ৩২ বছর। তার মধ্যে কিশোর বয়সে ৪ বছর নীরব কাব্যচর্চা (১৯২৪-১৯২৮), কলেজ জীবনে ৪ বছর শৌখিন সাহিত্যচর্চা (১৯২৮-১৯৩২) এবং অবশিষ্ট ২৪ বছর তিনি নিরবচ্ছিন্ন সাহিত্যচর্চা (১৯৩২-১৯৫৬) করেছেন। এ সময়কালে তিনি বাংলা সাহিত্যে যে অবদান রেখে গেছেন গুণ, মান ও সংখ্যায় তা অভাবনীয় ও বিস্ময়কর। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৮৩। তার মধ্যে উপন্যাস-৪০ (অসম্পূর্ণ-৩), গল্পগ্রন্থ-২২, প্রবন্ধ সংকলন-৩, নাটক-১, কাব্যগ্রন্থ-১ এবং অন্যান্য-১৬।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক বাড়ি ছিল বিক্রমপুর (মুন্সিগঞ্জ)-এর মালপদিয়া গ্রামে। তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন সিমুলিয়া গ্রামের অধিবাসী। তার পিতার নাম হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মা নীরদাদেবী। তার মাও ছিলেন বিক্রমপুরের গাওদিয়া গ্রামের মেয়ে। তাই মানিকের শেকড় গ্রথিত ছিল প্রাচীন বাংলার ইতিহাসখ্যাত শত ঐতিহ্যমণ্ডিত বিক্রমপুরে এবং এখানকার মাটি থেকেই তার জীবনরস সিঞ্চিত হয়েছে; আত্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে তা ফুলে ফলে সুশোভিত হয়েছে। অাঁতুর ঘরে কালো গায়ের রং-এর মধ্যেও তার ঔজ্জ্বল্য প্রকাশ পেয়েছিল। তাই তার নামকরণ হয়েছিল ‘কালো মানিক’। কিন্তু পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল প্রবোধ কুমার। ডাক নাম মানিক হলেও লেখক নাম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। বিশ বছর বয়সে কলেজে পড়াকালে বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে লিখে ফেলেন ‘অতসী মামী’ গল্পটি।
তা ১৩৩৫ সালের পৌষ সংখ্যা ‘বিচিত্রা’য় প্রকাশিত হলে সকলে চমকে ওঠেন। লেখালেখির জগতে মানিকের এই যে অগ্রযাত্রা প্রাণস্পন্দন থেমে না যাওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। যেসব পত্রপত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে বিচিত্রা, বঙ্গশ্রী, পূর্বাশা, ভারতবর্ষ, পরিচয়, যুগান্তর, প্রভাতী, আনন্দবাজার, স্বাধীনতা, বসুমতী, ছোটদের রংমশাল, অভিদারা, অনন্যা, এলোমেলো, এখন, আগামী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ (উপন্যাস) ‘জননী’ এবং গল্পগ্রন্থ ‘অতসী মামী ও অন্যান্য গল্প’। তার অসম্পূর্ণ উপন্যাস ‘মাটি ঘেঁষা মানুষ’ সম্পূর্ণ করেন সুধীর রঞ্জন মুখোপাধ্যায়। কিশোর উপন্যাস ‘মশাল’ কে সম্পূর্ণ করেছেন তা জানা যায়নি। তবে কিশোর উপন্যাস ‘মাটির কাছে কিশোর কবি’ সম্পূর্ণ করেছেন খগেন্দ্রনাথ মিত্র। তার লেখা দুটি উপন্যাসের ভূমিকা অসম্পূর্ণ ছিল, সম্পূর্ণ নয় অগ্রন্থিত রচনার তালিকা। কিছু লেখা হয়তো এখনও অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে।
চাকুরিজীবী পিতার কর্মস্থান পরিবর্তিত হওয়ায় তিনিও বিভিন্ন স্থানে লেখাপড়া করেছেন। ফলে লেখাপড়ায় অনেকটা বিঘ্ন ঘটলেও নানান অঞ্চলের মানুষের সাথে মেলামেশা করে যে বাস্তবজ্ঞান অর্জন করেছিলেন সে সব অভিজ্ঞতা তার পরবর্তীকালের লেখক জীবনে সহায়ক হয়েছিল। ছোটবেলা থেকে তিনি মেধাবী ছিলেন এবং পরীক্ষায় ভাল ফল করেছেন। ১৯২৪ সালে মা মারা গেলে তিনি অনেকটা শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন এবং সম্ভবত এ সময়ে নীরবে কাব্যচর্চা শুরু করেন। ১৯২৬ সালে মেদেনীপুর স্কুল থেকে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। নৈর্বাচনিক ও আবশ্যিক গণিতে লাভ করেন লেটার মার্ক। ১৯২৮ সালে বাঁকুরা ওয়েস লিয়ন মিশন কলেজ থেকে তিনি আইএসসি পাস করেন প্রথম বিভাগে। তিনি ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিত বিষয়ে বিএসসি সম্মান শ্রেণীতে। কিন্তু এ সময়ে তিনি ধরাবাঁধা লেখাপড়ায় আগ্রহ হারিয়ে দেশ-বিদেশের সাহিত্য পাঠে মনোনিবেশ করেন। ফলে পরপর দু’বছর বিএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। এ জন্য নিকট ছাত্ররাও তার প্রতি বিরাগভাজন হয়ে পড়েছিলেন। ইতোমধ্যে তার লেখালেখিও শুরু হয়ে গিয়েছিল পুরোদমে।
জীবনধারণের জন্য চাকুরি করেন নবারুন (১৯৩৪) ও বঙ্গশ্রী (১৯৩৭-১৯৩৯) পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে। কিন্তু মৃগী রোগাক্রান্ত মানিককে ডা. বিধানচন্দ্র রায় বিয়ে করার পরামর্শ দিলেন। ১৯৩৮ সালের ১১ মে বিক্রমপুরের পঞ্চসার গ্রামের সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা কমলা দেবীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। শরীরও অনেকটা সুস্থ হয়ে এলো। ইতোমধ্যে তার লেখক খ্যাতি দেশময় ছড়িয়ে পড়েছে। পেশা হিসেবে লেখালেখিকেই বেছে নিয়েছেন। আর্থিক অসচ্ছলতা ঘোচাতে ১৯৩৯ সালে তিনি একবার প্রেসব্যবসা শুরু করেছিলেন। উদ্দেশ্য সেখান থেকেই বই ও একটি পত্রিকা প্রকাশ করবেন। কিন্তু এক বছর না যেতেই প্রেস ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। লেখালেখির অর্থে সংসার চলে না। অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ পিতাও স্বেচ্ছায় আশ্রয় নিয়েছেন। পিতার সেবাযত্নেও এতটুকু অবহেলা তিনি করেননি। ১৯৪৩ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় কিছুকাল তিনি ওয়ার ফ্রন্টের প্রভিন্সিয়াল অর্গানাইজার এবং বেঙ্গল দফতরে পাবলিসিটি এসিস্যান্ট হিসেবে চাকরি করেছেন। আকাশ বাণী কলকাতা কেন্দ্রে যুদ্ধ বিষয়ক প্রচার ও নানাবিধ বেতার অনুষ্ঠানে যোগদান করেছেন। কিন্তু সে সময় ফরমায়েসি কাজে তার পোষায়নি। তিনি স্বেচ্ছায় কেটে পড়েছেন। লেখালেখি করে অধিক অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করেছেন। তার লেখায় যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ, দুর্ভিক্ষ, কালোবাজারী, মুনাফালোভীর চিত্র ফুটে ওঠে। তাছাড়া ফ্যাসিবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সামপ্রদায়িকতার বিষবাষ্পে ভূলুণ্ঠিত মানবতা বিশেষ করে কৃষক-শ্রমিক মেহনতী মানুষের জীবন সংগ্রাম মূর্তমান হয়ে ওঠে। তার সাহিত্যখ্যাতিও দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৪২ সালের ৮ মার্চ ঢাকাতে ফ্যাসিবিরোধী সমাবেশে যোগদানের জন্য তরুণ লেখক ও কম্যুনিস্টকর্মী সৌমেন চন্দ (১৯২০-১৯৪৮) মিছিল নিয়ে আসার পথে ফরোয়ার্ড ব্লকের গু াদের হাতে রাজপথে নৃশংসভাবে নিহত হয়। সে প্রেক্ষাপটে কলকাতায় গঠিত হয়েছিল ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পীগোষ্ঠী। প্রথম দিকে প্রগতি লেখক সংঘের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা না থাকলেও পরবর্তীকালে এ সব সংগঠনের সঙ্গে নিজকে সম্পৃক্ত করে নেন। বুখারিনের বস্তুবাদ ও লিয়েনতিয়েনের মার্কসীয় অর্থনীতি পাঠ করে মার্কসীয় দর্শনের প্রতি তিনি আস্থাশীল হয়ে ওঠেন। ১৯৪৪ সালে তিনি কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। মার্কসীয় দর্শনের বইপত্র পড়ে তিনি সম্পূর্ণ বদলে যান। ‘সাহিত্য করার আগে’ শীর্ষক লেখায় তিনি বলেছেন, মার্কসবাদ যতটুকু বুঝেছি তাতেই আমার কাছে ধরা পড়ে গিয়েছে যে, আমার সৃষ্টিতে কত মিথ্যা বিভ্রান্তি আর আবর্জনা আমি আমদানী করেছি জীবন ও সাহিত্যকে একান্ত নিষ্ঠার সঙ্গে ভালবেসে ও জীবন ও সাহিত্যকে এগিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও। ১৯৪৪ সালের ১৪-১৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার সভাপতিম লীর অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হন। সে বছর ২৫-২৭ আগস্ট অনুষ্ঠিত পূর্ববঙ্গ প্রগতি লেখক ও শিল্পী সম্মেলনে তিনি যোগদান করেন।
১৯৪৫ সালের ৩-৮ মার্চ ভারতীয় প্রগতি লেখক সংঘের অন্যতম যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে ভয়াবহ দাঙ্গা প্রতিরোধে তিনি অসুস্থ শরীর নিয়ে এগিয়ে যান এবং বহু সভা সমাবেশে যোগদান করেন। ১৯৪৯ সালের ২২ এপ্রিল প্রগতি লেখক সংঘের চতুর্থ বার্ষিক সম্মেলনে পুলিশী হানার মধ্যেও তিনি ডেলিগেট অধিবেশনে যোগদান করেন। ২২ নভেম্বর ট্রাম বাড়িতে অনুষ্ঠিত প্রগতি লেখক সংঘের শান্তি সম্মেলনে তিনি সভাপতিত্ব করেন। সভাপতিত্ব করেছিলেন ১৯৫৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রগতি লেখক সংঘের পঞ্চম বার্ষিকী সম্মেলনে। লেখার চাপ ছাড়াও পার্টি এবং অন্যান্য সাগংঠনিক কাজে বেশি বেশি পরিশ্রম করার ফলে তার শরীর ভাঙতে শুরু করে। পার্টির পক্ষ থেকে তাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়া হয়। কিন্তু হাসপাতালে তিনি কখনও স্বস্তিবোধ করেননি। নিজ দায়িত্বেই তিনি বাসায় ফিরে এসেছেন। তারপর ১৯৫৬ সালের ৩০ নভেম্বর তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। অসহায় পারিবারিক পরিবেশে দুই দিন থাকার পর ২ ডিসেম্বর রাত ১০টায় নীলরতন সরকার হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। না সেখানে আর তাকে বেশি সময় কাটাতে হয়নি। ৩ ডিসেম্বর ভোর চারটায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সময় পেলেন না কাকা বাবুর (কমরেড মুজাফফর আহমদ) জীবনী লেখার।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে সাহিত্য চর্চার বয়স হল ৩০ বছর। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘তিরশ বছর বয়সের আগে কারো লেখা উচিত নয়। আমি সেই বয়সে লিখবো। এর মধ্যে তৈরি হয়ে নিতে হবে সব দিক দিয়ে। কেবল অভিজ্ঞতা সঞ্চয় নয়। নিশ্চিত মনে যাতে সাহিত্যচর্চা করতে পারি তার বাস্তব ব্যবস্থাগুলো ঠিক করে ফেলবো।’ কিন্তু সে সুযোগ তিনি পাননি। অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে ত্রিশ বছরের বহু পূর্বেই তিনি লেখালেখিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কিশোর বয়সে কবিতা ও গল্প লিখেছেন। কিন্তু ঔপন্যাসিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন তার ‘উপন্যাসের ধারা’_ লেখায় ‘… সাধ করলে কবি হয়তো আমি হতে পারি; কিন্তু ঔপন্যাসিক হওয়াটাই আমার পক্ষে হবে উচিত ও স্বাভাবিক।’ তার স্বপ্ন সত্যে পরিণত হয়েছে ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনি সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। বিজ্ঞানের ছাত্র মানিকের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি উপন্যাস রচনায় সহায়ক ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, উপন্যাস লেখার জন্য দরকার খানিকটা বৈজ্ঞানিক বিচারবোধ, বিজ্ঞানচর্চা না করলেও সম্পূর্ণভাবে নিজের অজ্ঞাতসারে হলেও ঔপন্যাসিক খানিকটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করবেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।
মানবতাবাদী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সামপ্রদায়িকতা, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে অন্তর থেকে ঘৃণা করেছেন। অসুস্থ শরীরে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তিনি সামপ্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তিনি ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘দাঙ্গার কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। … বিকালে এ অঞ্চলে শান্তিসভা হবে শুনলাম। খুশি হয়ে নিজে রাজি হলাম যতটা পারি সাহায্য করতে। যাকে দেখছি তাকে বলছি মিটমাটের জন্য সভায় যেতে। মসজিদের কাছে আনোয়ারশা রোডের একদল মুসলিম স্বীকার করলেন মিটমাট দরকার_ কয়েকজন উত্তেজিতভাবে বললেন মেরে পুড়িয়ে এখন মিটমাটের কথা কেন? অন্যরা তাদের থামালেন। ফাঁড়ি পেরিয়ে পুলের নিচে যেতে এল বিরোধিতা_ হিন্দুদের কাছ থেকে। কিসের মিটমাট মুসলমানরা এই করেছে ঐ করেছে। ব্যাটা কম্যুনিস্ট বলে আমায় মারে আর কি। প্রায় দেড়শ লোক মিলে ধরেছিল।’ ভারত ভাগের পর ১৯৫০ সালেও কলকাতায় সামপ্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। এ ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল খুবই স্পষ্ট। তিনি ডায়েরিতে লিখেছেন, সামপ্রদায়িকতার উপরটাই লোকে দেখছে। পিছনে কি গভীর ও ব্যাপক ষড়যন্ত্র, চোখে পড়ে না। যে উদ্দেশ্যে ভারত বিভাগ, সেই উদ্দেশ্যেই ভারত পাকিস্তানের বিবাদ বাড়িয়ে চলা বৃটিশ আমেরিকান সামপ্রাজ্যবাদ দুই রাষ্ট্রের ঘাড়ে চেপে থাকতে পারে। সামপ্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশ ভাগ ছিল তার অসহ্য। তার লেখায় তা সুস্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে : ‘কানাই বলে মাঠে একটা ফ্লাগ উড়াই? আমি বলি ব্লাক ফ্লাগ উড়াও। কানাইয়ের ভাই বলাই বলে ঠিক। উদ্বাস্তুরা কি স্বাধীনতা পেয়েছে? সাত আট বছরের ছেলে। ফ্লাগ কিছু কিছু উড়েছে_ কিন্তু চার দিক ঝিমানো।’
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাদাসিধে জীবনযাপন সম্পর্কে অনেকেই লিখেছেন। রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরী তার ‘একটি গল্পের জন্মকথা’য় লিখেছেন, ‘ছোট একটা পুরাতন একতলা দালান। সামনের দিকে অল্প পরিসর একটা কোঠা মানিক বাবুর লেখার ঘর। মাদুর বিছানো সাধারণ একটা তক্তপোষ ঘরের এক পাশে। মান্দাতার আমলের হতশ্রী লেখার টেবিল একটা_ তার একটিমাত্র বসার চেয়ারের অবস্থাও একই রকমের। গোটা তিনেক বইয়ের আলমারী পিছনটাতে। বইয়ের সংখ্যা সামান্য। বাঁধাই ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষে’র সংখ্যাই বেশি।
বাজার থেকে ফিরে এলেন মানিক বাবু অল্প কিছুক্ষণ বাদে। গায়ে আধময়লা গেঞ্জি, পরনে লুঙ্গি। এক হাতে আট-নয় বছরের মেয়ের হাত ধরেছেন আর এক হাতে বাজারের চটের থলে। লম্বা প্রায় ছয় ফুট, বলিষ্ঠ কালো কুঁদানো শরীর, চাষাভূষাদের মতন। খোঁচা খোঁচা দাড়ি-গোঁফে মুখম ল আবৃত্ত তবে কুশ্রীতা নেই কোথাও প্রাণোচ্ছল সাজিবতায় ভরপুর। কালো ফ্রেমের চশমা ভেদকরা এক জোড়া নিবিষ্ট চোখ। অনাবৃত বাহুযুগলের পেশিতে যৌবনোচিত দৃঢ়তা। বেশভূষা, চেহারা সবটাই মিলিয়ে আবার নতুন করে যেন দেখলাম মানিক বাবুকে। খারাপ লাগেনি তবুও বাজারের থলেটাকে বাংলাদেশের প্রথম সারির একজন কথাশিল্পীর হাতে কেমন যেন বেমানান মনে হয়েছিল। … তার অনাড়ম্বর জীবনযাত্রার পরিচয় পেয়ে প্রকৃতই অন্তরঙ্গতা অনুভব করেছিলাম সেদিন।’
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সারা জীবন অর্থকষ্টে ভুগেছেন। অনেক সময় অসুখ হলে নিজের বা পরিবারের সদস্যদের সুচিকিৎসারও ব্যবস্থা করতে পারেননি। কোনো কোনো সময় পার্টি, কবি-সাহিত্যিক বন্ধু বা শুভানুধ্যায়ীরা সহায়তার হাত প্রসারিত করেছেন। তারপরও এককালীন কিছু টাকা পেলে পুরোটাই পার্টি ফান্ডে জমা করে দিতেন। পৈতৃক বাড়ি বিক্রির টাকা তিনি পারিবারিক সদস্যদের অজ্ঞাতেই পার্টিকে দিয়েছিলেন। পার্টির প্রতি তিনি এতটাই অনুরক্ত ছিলেন। অন্যদিকে যে কোনভাবে টাকাপয়সা আয় করা তার রুচিবোধের বাইরে ছিল। রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর সঙ্গে আলাপকালে তার এ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে : ‘এখন সংসার চালাতে হয় শুধু এই দিয়েই। আর তো পেশা নেই কোন। তাছাড়া সব কাগজে লিখিনে এখন আর, কারণ তাতে লেখক সম্বন্ধে পাঠকের ধারণা নিচু হয়ে যায়_ সম্ভাবনা থাকে ভুল বুঝবার। তা যদি লিখতাম তা হলে অনেক টাকা রোজগার করতে পারতাম। অভাব থাকতো না কোন, দেখলেন তো কত সাহিত্যিক বাড়ি করলেন, গাড়ি করলেন_ আমি গরিবই রয়ে গেলাম সারা জীবন। অনেক সময় তিনি পয়সার অভাবে ওষুধ কিনে খেতে পারেননি।
এমনকি একটি অসহায় অবস্থা নিজ ডায়েরিতে উলি্লখিত হয়েছে। ক’দিন থেকে শরীর খুব খারাপ, … কি যে দুর্বল বলা যায় না, বিছানা থেকে উঠবারও শক্তি নেই_ এদিকে ঘরে পয়সা নেই। জোর করে তো বেরোলাম ফিরবো কিনা না জেনে।’ তারপর সর্বশেষ যখন আর্থিক অসহায়ত্বের কারণে দুই দিন নিজ বাড়িতে অজ্ঞান হয়ে থাকবার পর হাসপাতালে ভর্তির সংবাদ পেয়ে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। এমন অবস্থায় টেলিফোন না করার কারণ জিজ্ঞাসা করায় মানিক পত্নী অস্ফুট স্বরে হেসেই উত্তর দিয়েছিলেন, ‘তাতে যে পাঁচআনা পয়সা লাগে ভাই।’
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন শ্রেণী-সংগ্রামে বিশ্বাসী লেখক। তার অনেক লেখায় তা পরিলক্ষিত হয়। শ্রেণী-সংগ্রামের বিজয়ে প্রত্যয়ী মানিক বন্দোপাধ্যায় তার ‘নেতা’ গল্পে লিখেছেন, ‘… আমরা কোন দাবি ছাড়বো না। আমরা কি শুধু রুজির জন্য লড়ি? আমাদের দাবির পিছনে_’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন করেছেন অনেকেই। তবে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাহিত্য সমালোচক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘মানিক প্রান্তিক মানুষের অর্থনৈতিক জীবনকে জানতেন এবং তাদের সামাজিক অবস্থা সম্বন্ধে প্রচ্ছন্ন জ্ঞান রাখতেন। এই বাস্তবতাকে তিনি তার কথাসাহিত্যে উপস্থিত করেছেন। তিনি তা কেবল বাস্তবতাকে উপস্থিত করার প্রয়োজনে উপস্থিত করেননি করেছেন বাস্তবতাকে বদলাবার প্রয়োজনেও।’