‘একটি রয়েল গুলি কিনতে পারিনি কখনো/লাঠি লজেন্স দেখিয়ে চুষেছে/লস্কর বাড়ির ছেলেরা …।’ ওপার বাংলার খ্যাতিমান সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যেন শুধু তার ছেলেবেলার স্মৃতিচারণ করেছেন তাই নয়, দুই বাংলার শিশু-কিশোরদের মনের কথা বলেছেন এই কবিতাংশে। দারিদ্র্যের কশাঘাতে শিশু-কিশোররা দুর্বার আকর্ষণের মার্বেল কেনার সামর্থ্য না থাকায় কতটা যে কষ্ট পেত তারই চিত্র যেন এই কবিতার লাইনগুলো। কোলকাতায় মার্বেলের অপর নাম রয়েলগুলো। আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে মার্বেল খেলাটা জমে মূলত বিশেষ কোন উৎসবে। তবে এই খেলা যে ঈদের উৎসবে সবচেয়ে বেশি জমে সেটা বোধহয় এখনও সবাই মানবেন।

এক সময় তো মার্বেল না খেলে শিশু-কিশোররা ঈদই পালন করত না। এখন অবশ্য অনেক খেলার ভিড়ে এই খেলাটি তার পুরনো ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। তবু ঈদে গ্রামাঞ্চলে মার্বেল খেলার প্রচলন এখনও রয়েছে। গাঁয়ের পায়ে চলার সরু পথ, বাড়ির পাশের আম-কাঁঠালের বাগানের ভেতর ফাঁকা জায়গাসহ সামান্য খোলামেলা জায়গাতেই এ খেলা চলে। শিশু-কিশোররা নির্দিষ্ট একটা ছকের বাইরে একটা গর্ত করে। ছকের বাইরে বসে প্রত্যেকে একটি করে মার্বের ওই গর্তে ফেলার চেষ্টা করে। যার মার্বেল গর্তে পড়ে বা সবচেয়ে কাছে যায় সে প্রথম দান পায়। সবাই প্রথম যে দান পায় তার হাতে ২/৩/৪টি করে মার্বেল জমা দেয়।

সে মার্বেলগুলো ছকের বাইরে বসে সামনের দিকে ওই গর্তের আশপাশে আলতো করে ছড়িয়ে দেয়। এরপর অন্য খেলোয়াড়রা একটা নির্দিষ্ট মার্বেলকে বলে ‘বাদ’। অর্থাৎ ওই মার্বেল ছাড়া বাকি যে কোন একটি মার্বেলকে অন্য একটি মার্বেল ছেড়ে দিয়ে স্পর্শ করতে হবে। যদি এমনটা পারে তাহলে ওই দান সে জিতে যায়। আর না পারলে পরবর্তী জন একইভাবে খেলার সুযোগ পায়। তবে ‘বাদ’ দেয়া মার্বেল কিংবা অন্য একাধিক মার্বেলকে ছুড়ে দেয়া মার্বেল স্পর্শ করলে ওই খেলোয়াড়কে ফাইন দিতে হয়।

এবং দান জেতার জন্য পরবর্তী খেলোয়াড় ফাইন হওয়া মার্বেলসহ সেগুলো ছড়িয়ে দিয়ে খেলতে থাকে। যে কেউ দান জিতলে আবার পুনরায় খেলা শুরু হয়। এভাবেই চলতে থাকে যতক্ষণ না প্রতিপক্ষ আত্মসমর্পণ করে কিংবা তার কাছের মার্বেল শেষ না হয়ে যায়। কোন কোন অঞ্চলে অবশ্য মার্বেল খেলাকে বিঘত খেলাও বলে। রাখাল বালক থেকে শুরু করে স্কুলপড়ুয়া শিশু-কিশোর অন্তত ঈদের দিন মার্বেল না খেলে থাকতে পারত না। এই খেলার প্রতি টানের কারণে দেখা গেছে অনেকেই স্কুল ব্যাগের ভেতর কিংবা হাফপ্যান্টের পকেটে মার্বেল নিয়ে স্কুলেও চলে যেত। আর এজন্য অভিভাবক কিংবা শিক্ষকের হাতে কানমলা খায়নি এমন কিশোর এক সময় খুঁজে পাওয়া মুশকিলই ছিল। স্কুলে টিফিনের ফাঁকে সামান্য দূরে শিক্ষকদের চোখের আড়ালে গিয়েও শিশু-কিশোররা মার্বেল খেলায় মেতে উঠত।

লিখেছেনঃ সাবিকুন্নাহার রীতা