সূর্যসেন (১৮৯৪-১৯৩৪) ভারত উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন। তিনি ‘মাস্টারদা’ নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। পূর্ববঙ্গে জন্ম নেয়া এই বাঙালী বিপ্লবী তৎকালীন ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন, এবং জীবন বিসর্জন করেন। সূর্য সেন ১৮৯৪ সালে চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহন করেন। প্রথমে চট্টগ্রাম কলেজে পড়াশোনা করলেও পরে বহররমপুর কলেজ থেকে ১৯১৮-তে বি.এ. পাস করেন। এর পর উমাতারা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) শেষের দিকে অনুরূপ সেন, চারুবিকাশ দত্ত, অম্বিকা চক্রবর্তী, নগেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখের সঙ্গে চট্টগ্রামে গোপন বিপ্লবী দল গঠন করেন।১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল বিপ্লবী মহানায়ক সূর্যসেন চট্টগ্রামে যুবশক্তি গঠন করেন। ওইদিনই ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ’ নামে বিপ্লবীদের অপ্রত্যাশিত আক্রমণে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী প্রশাসন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়। ১৮ থেকে ২১ এপ্রিল এই চারদিন চট্টগ্রামে ইংরেজ শাসন কার্যত অচল ছিল। পরাধীন জাতির ইতিহাসে বিপ্লবীদের এ বিজয় ছিল গৌরবগাঁথা।
২২ এপ্রিল ভোর ৪টা থেকে সাড়ে ৪টার মধ্যে চট্টগ্রাম নাজিরহাট শাখা রেললাইনের ঝরঝরিয়া বটতলা ‘স্টেশনে একটি সশস্ত্র ট্রেন এসে থামল, বিপ্লবীদের তখন বুঝতে বাকি রইল না যে তাদের সম্মুখযুদ্ধের ক্ষণ আসন্ন। ওইদিন ব্রিটিশ সরকার সূর্য সেন, নির্মল সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ ও লোকনাথ বলকে ধরে দিতে পাঁচ হাজার টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করে। ২২ এপ্রিল সকালে বিপ্লবীরা যখন জালালাবাদ পাহাড়ে বসে বিশ্রম নিচ্ছিল তখন কয়েকজন কাঠুরিয়া ওই পাহাড়ে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহে যায়। তারা দেখল খাকি পোশাকে রাইফেলধারী কিছু যুবক সেখানে অবস্থান করছে। তারা দ্রুত লোকালয়ে ফিরে গিয়ে লোকজনের কাছে চমকপ্রদ সংবাদ পরিবেশনের আনন্দে প্রকাশ করে দেয় যে স্বদেশরা ওই পাহাড়ে আছে।
ওই খবর পুলিশের কাছে পেঁৗছলে ঠিক জালালাবাদ পাহাড়ের কাছে এসে মিলিটারী সশস্ত্র রেল গাড়ি (আর্মড ট্রেন) থামে। জালালাবাদ পাহাড়ে তখন বিপ্লবীরা কেউ রাইফেল পরিষ্কার করছে কেউ বা ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। গাছের ডালে পাহারারত বিপ্লবী-সন্ত্রাসীরা দেখতে পায় সামরিক ট্রেনটি কোন স্টেশন না থাকা সত্ত্বেও অদূরে রেল লাইনের উপর থেমে গেল। ঝোপের আড়াল থেকে ওইভাবে হঠাৎ গুলির আগাতে সৈন্যদল বিভ্রান্ত হয়ে পিছিয়ে যেতে থাকে। সৈন্যরা এরপর জালালাবাাদ পাহাড়ের পূর্ব দিকে ছোট্ট একটি পাহাড়ের উপর লুইসগান বসিয়ে বিপ্লবীদের দিকে গুলিবর্ষণ করে। দেশপ্রেম আর আত্দদানের গভীর আগ্রহে তরুণ বিপ্লবীরা পাহাড়ের বুকের উপর শুয়ে সৈন্যদের লুইসগানের গুলিবর্ষণের জবাব দিচ্ছিল।
তিন প্রধান নেতা সূর্য সেন, নির্মল সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী সঙ্গে থেকে ঘন ঘন তাদের উৎসাহিত করছেন, গুলি এগিয়ে দিচ্ছেন। ওই বিদ্রোহে ১১ বিপ্লবী শহীদ হন। জীবিত বিপ্লবীরা শহীদদের লাশ পাশাপাশি শুইয়ে রেখে সামরিক কায়দায় শেষ অভিবাদন জানায়। চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের নেতা মাস্টারদা বিপ্লবী সূর্য সেন ও তারেকশ্বর দস্তিদারকে চট্টগ্রাম জেলে ফাঁসি দেয়। ফাঁসির কাষ্ঠে সূর্য সেন উচ্চস্বরে উচ্চারণ করেন_ ‘বন্ধুগণ, বিদায়, চিরবিদায়, বিপ্লবে আমার দৃঢ়বিশ্বাস আছে। বন্দে মাতরম-ইনকিলাব জিন্দাবাদ, স্বাধীন ভারত কি জয়, মাস্টার দা জিন্দাবাদ’। এক সময় ফাঁসির কাষ্টে নেমে এল পিনপতন নীরবতা। বন্দিরা চোখের জলে তাদের প্রিয় নেতাকে চির বিদায় সম্ভাবষণ জানান।