প্রিন্স রফিক খানের বই ‘কিশোরগঞ্জের লোক-ঐতিহ্য’। মনুষ্য সমাজে দৈনন্দিন লোকাচার-কৃতকর্মই সংস্কৃতি। সেই লোকাচার-যা কিছু অতীত থেকে আজ অবধি চলে আসছে কিংবা সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে তাই লোক ঐতিহ্য। লোকাচারের নানাবিধ বিষয় হবে ওই ঐতিহ্যের অনুষঙ্গ। কিশোরগঞ্জ এলাকায় প্রচলিত সংস্কৃতির কথা বলতে গিয়ে ‘কিশোরগঞ্জের লোক-ঐতিহ্য’ নামক বইটিতে প্রাচীন লোকসঙ্গীতের কথাই প্রাধান্য পেয়েছে। তাই বইটির নামকরণ ‘কিশোরগঞ্জের লোক সংস্কৃতি ‘ হলেই ভালো হতো। কারণ এ বইয়ে লোক-ঐতিহ্যের (Folk tradition) কোন তথ্য নেই। যা আছে তার পুরোটাই লোকসংস্কৃতি বা Folk Culture ।

কিশোরগঞ্জ তথা ভাটি এলাকার কবি চন্দ্রাবতীর কথা বলতে গিয়ে লেখক তাকে ‘বাংলার প্রথম মহিলা কবি’ বলে দাবি করেছেন। অথচ বাংলা সাহিত্যে তার অবস্থান চতুর্থ। বাংলা ভাষা চর্চা ও উপস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রত্যেক বাঙালির নমস্য সত্যজিৎ রায়। তিনি বাঙালিসমাজে গর্বের ব্যক্তিত্ব। জন্মসূত্রে সত্যজিৎ বাবু ভারতের নাগরিক। তার নাম কী করে কিশোরগঞ্জের স্মৃতিবিজড়িত হয়? পূর্বপুরুষের হবে। বাংলার ঐতিহ্যের সন্ধানে বহু জ্ঞানী গুণী পদধূলি দিয়ে ধন্য করেছেন কিশোরগঞ্জকে। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সংগ্রহে এবং জমিদারির খোঁজ খবর নেবার জন্য বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পূর্ব ময়মনসিংহের আঠারবাড়িতে এসেছিলেন। সে যাত্রায় কিশোরগঞ্জের উপর দিয়ে কবিগুরুর রেলভ্রমণ এবং রেলস্টেশনে সমবেত সাহিত্যিকদের অনুরোধে যাত্রাবিরতির ঘটনাটি আদৌ লোক-ঐতিহ্যের পর্যায়ে পড়ে কিনা তা ভেবে দেখা লেখকের উচিত ছিল। অথচ লেখক প্রিন্স রফিক খান তার এ বইয়ে কবিগুরুর আগমনের বিষয়টিকে লোক-ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে চালিয়ে দিয়েছেন, যা সঠিক নয়। অনুরূপভাবে ১৯৬৭ সালে কবি সুফিয়া কামালের কিশোরগঞ্জে আগমনের ঘটনাকেও এ বইয়ে আলাদা অধ্যায় হিসাবে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এটিও লোক-ঐতিহ্যের অংশ নয়। এ দুটো ঘটনাকে লোক-ঐতিহ্য বিষয়ক বইয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পৃথক অধ্যায়ে মুদ্রিত করা প্রাসঙ্গিক হয়নি। ‘ইতিহাস’কে ‘ লোক-ঐতিহ্য’ বলে চালিয়ে দেয়া বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়।

এ বইয়ে লেখক ‘বাড়িরও না দক্ষিণ পাশে গো/ও দাইমা কিসের বাধ্য বাজে’ গানের কলিটি উদ্ধৃত করেছেন। লেখক কিশোরগঞ্জ এলাকার লোক হিসেবে স্থানীয় উচ্চারণ ‘বাধ্য’ লিখতে পারেন। কিন্তু প্রকৃত অর্থবোধক শব্দ হবে ‘বাদ্য’। এর পরিবর্তে‘ বাধ্য লিখে অর্থের পরিবর্তন করে তিনি উল্লিখিত পঙক্তি দুটোকে কিশোরগঞ্জের দাবি করতে পারেন না। অনুরূপ চর্যাপদের ভাষায় ব্যবহৃত কাউয়া, ব্যাঙ, বলদ ইত্যাদি শব্দকে তিনি কিশোরগঞ্জ এলাকার শব্দ বলে দাবি করেছেন। কিন্তু পন্ডিতমহল চর্যাগীতিগুলোকে হিন্দী, মেহলী, ওড়িয়া অথবা অসমীয় অর্থাৎ বাংলা ছাড়া অপর একটি>আধুনিক ভারতীয় আর্যভাষা বলে মনে করেন। সেক্ষেত্রে চর্যাপদের কতিপয় শব্দকে বাংলা ভাষার বিশেষ একটি অঞ্চলের (কিশোরগঞ্জের) ভাষা বা শব্দ বলে দাবি করা অহেতুক নয় কি? তাছাড়া চর্যাপদ যখন রচিত হয় তখন এই কিশোরগঞ্জ নামক ভূখন্ডের অস্তিত্ব ছিল কি? তাহলে ওই শব্দগুলো কিশোরগঞ্জের শব্দ হয় কী করে? উচ্চারণ রীতির বানানরূপ ‘বেইনা বেলা’কে তিনি ঠিকই কিশোরগঞ্জের ভাটি এলাকার দাবি করেছেন। কিন্তু ‘সকালবেলা’ বুঝাতে ‘বিয়ান’ বা ‘বিহান বেলা’ হিসেবে অন্যত্র শব্দটি বিনা প্রশ্নে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অনুরূপ লেখকের দাবি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলাম উভয়ই বেশকিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন যা একান্ত কিশোরগঞ্জের; যেমন প্যাঁচা, খ্যাঁচখ্যাচায়, কাউয়া, গিয়া, ঠ্যাং, ব্যাঙ, বাপ, বাড়িত যাও’ ইত্যাদি। কিন্তু আমার জানামতে ওই শব্দসমূহ বাংলা ভাষাভাষী অন্য জেলাতেও প্রচলিত আছে। যেমন- দিনাজপুরের লোকেরা শিশুকাল থেকে ওই শব্দগুলো ব্যবহার করে আসছে।

দেশের অন্যত্র ‘বৈরাগী’ নামে পরিচিত নাথযোগী প্রসঙ্গটি লেখক সম্পূর্ণ কিশোরগঞ্জের আবহে উপস্থাপন করেছেন। ফলে তাদের অনেক তথ্য পাঠক অবহিত হতে পারবেন; যা অন্য লেখায় সহজলভ্য নয়। জানা যায়, শ্রীচৈতন্যদেব কিশোরগঞ্জ এলাকায় এসেছিলেন। তার মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের আগমন ও অবস্থানের সময়কাল জানাতে পারলে পাঠকের দাবি পূরণ হতো। সেই যোগীদের একজন চৌরঙ্গীনাথ। তিনি কামরূপ থেকে কিশোরগঞ্জে এসেছিলেন এবং ‘গাভুর’ বা ‘গাবুর’ নামে অভিহিত ছিলেন। কাজেই গাবুর শব্দটি কামরূপ বা অসমীয় ভাষার হতে পারে। আমাদের উত্তরাঞ্চলে গাবুর>‘গাবুরু’ দিয়ে বিয়ে অনুষ্ঠানের ‘বর’কে বুঝিয়ে থাকে। আবার সুলতান হোসেন শাহের এক সেনাপতি নসরৎ খান ‘গাভুর খান’ নামে অভিহিত ছিলেন। তার পিতামহ রাস্তি খান চট্টগ্রাম অঞ্চলের অধিপতি ছিলেন। অতএব গাভুর/গাবুর শব্দটি কিশোরগঞ্জ তথা ভাটি এলাকার এ কথাটি আমরা কী করে মানব? অবশ্য কিশোরগঞ্জে ‘গাবর’>‘গাবুর’ শব্দটি এসেছে কথিত নিম্নশ্রেণীভুক্ত জেলে সম্প্রদায়ের ‘ধীবর’ শব্দ থেকে; যদিও এর সপক্ষে অকাট্য কোনো যক্তি নেই।

বাংলা ভাষায় কোনো কোনো বর্ণের পরিবর্তে হ এর বিকৃত উচ্চারণ ব্যবহার শুধু বাজিতপুর, নিকলী বা কিশোরগঞ্জের নয়। এরকম বিকৃত উচ্চারণ বাংলাদেশের অনেক জেলাতে হয়। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা যায়, যে এ বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলম জাহান রচিত ‘লোকায়ত কিশোরগঞ্জ’ গ্রন্থে একটি তথ্যবহুল অধ্যায় গ্রন্থিত হয়েছে।

লেখকের দাবি কতকগুলো প্রবাদ, যেমন-‘বাঙালি মাগনা পাইলে আলকাতরা খায়’ কিশোরগঞ্জের গ্রামে-গঞ্জে প্রচলিত আছে ঠিকই কিন্তু তিনি মোটেই ভেবে দেখেননি যে, বাংলার অন্যত্র ‘মাগনা>মাংনা’ ব্যাপারটির অবাধ প্রচলন আছে। ঝাঁড়ফুঁক, পূজ-পার্বণ কীর্তন, জারিসারিসহ লোকসঙ্গীতের নানা ক্ষেত্রে কিশোরগঞ্জের অনুশীলন অনেক সমৃদ্ধ। এ দাবি অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত। তাই প্রাচীন যুগ থেকে সংস্কৃতি প্রধান বাংলার অন্যান্য জেলা অঞ্চলকে অস্বীকার করা কি যুক্তিসঙ্গত? তবে এক্ষেত্রে প্রিন্স রফিকের কিশোরগঞ্জ অপেক্ষাকৃত অনেক সমৃদ্ধ তা অনস্বীকার্য। বাংলায় পানির আধিক্য অবশ্যই আছে। বর্ষায় অঞ্চল বিশেষ পানিতে ডুবে গিয়ে মানুষের দুর্দশার কারণ হয়। ভাটিও পানিতে ডুবে গিয়ে থৈ থৈ করে। তাই পানি বাংলার সম্পদ। এ সম্পর্কে আর বিতর্ক নয়; প্রশ্ন রেখে যাই, তাহলে কি সংস্কৃত, হিন্দী, উর্দুসহ দক্ষিণ ও উত্তর ভারতের অন্যান্য ভাষা ওই ‘পানি’ শব্দের জন্য বাংলা ভাষার কাছে ঋণী? পানি যদি বাংলা শব্দ হবে, তাহলে এতদিনের জল কোন গঙ্গায় যাবে? প্রিন্স রফিক খান পানিকে ‘নির্জলা বাংলা শব্দ’ বলেন কোন যুক্তিতে?

হ্যাঁ, পালদের তৈরি ‘পাইল্যা’। গ্রামাঞ্চলে সংস্কৃতিবান যুবকেরা আনন্দ-অনুষ্ঠানে ঢোল-তবলার অনুপস্থিতিতে পাইল্যা বাজাত। আমার চাচারা তাদের বন্ধুসহ বাড়িতে আমার মার কাছ থেকে পাইল্যা সংগ্রহ করতো। কোনো কোনো সন্ধ্যায় মাটির বিধায় ওই পাইল্যা আর ফিরে আসত না। সে কথা সারা বাংলার, কেবল কিশোরগঞ্জের নয়। অনুরূপ আমের অাঁটির বাঁশি, পাতার বাঁশি ফুঁ দিয়ে আজও বাজানো হয় গ্রাম বাংলার সর্বত্র। যেমন- মেলা থেকে তালপাতার বাঁশি এনে দে-এ বাঁশি সর্বজনীন, কোনো এলাকার নয়; সারা বাংলার। আমাদের সংস্কৃতি সারা বাংলার)। ব্যতিক্রম তো থাকতেই পারে। কিশোরগঞ্জেরও আছে। সেই ব্যতিক্রমের ঊর্ধ্বে উঠে বইটি রচনা করলে প্রিন্স রফিক খান এক অনুপম সৃষ্টি উপহার দিতে পারতেন। যেমন মোহাম্মদ সাইদুর লোকসংস্কৃতির ক্ষেত্রে কেবল কিশোরগঞ্জ নয়, বাংলাদেশ অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছেন। সে যাত্রায় প্রিন্স রফিকও প্রথম পদক্ষেপ ফেলেছেন। তার আগেই তিনি আমাদের খনকার বাড়ির প্রতিবেশি হতে পারলেন না। পেশার কারণে খন্দকার শব্দটি সে রকমই একটি পেশাভিত্তিক শব্দ। সামন্তযুগে রাজা জমিদাররা তাদের অধীনে বিভিন্ন পেশার লোক পোষণ করতেন। ধোপা, নাপিত, ঘাষি, রাখাল থেকে শুরু করে কবর খননের লোক পর্যন্ত তাদের অধীনে পালিত হতো।

যারা কবর (ফার্সি-খন্দক) খনন করতেন তাদেরকে বংশগত খন্দকার পদবী দেয়া হতো। আমাদের অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মাঠে উচ্চারণ বিকৃতির সুবাদে খন্দকার>খোন্দকার>খোনকার>খনকার>খনকার>খনহার>খনার ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার হয়। যেমন- খন্দকার বাড়ি>খোন্দকারবাড়ি>খোনকার বাড়ি>খনকার বাড়ি>খনহার বাড়ি>খনার বাড়ি হয়েছে। অনুরূপ চরাঞ্চল খন্দকারচর>খোন্দরকারচর>খনকারচর>খনহারচর>খনারচর হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে উচ্চারণে ক লোপ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু প্রিন্স রফিক খান তার বইয়ে বাজিতপুর উপজেলার খনারচর গ্রামের নামকরণের তথ্য দিতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, খনারচর গ্রামে কৃতী বাঙালী নারী লিলাবতী খনার রচিত বচনগুলোর ব্যাপক প্রচলন ছিল বলেই নাকি এ গ্রামের নাম হয়েছে খনারচর। কী অদ্ভূত তার অনুসন্ধিৎসা! এরকম উদ্ভট ও মনগড়া তথ্য পরিবেশন বিজ্ঞ পাঠকদের শুধু বিভ্রান্তই করবে না, তাদের মনে কৌতুকেরও সঞ্চার করবে। তাই খনারচরের সঙ্গে কৃষিখ্যাত বাঙ্গালী নারী কবি খনা>খনার বচনের আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে কিনা তা গবেষণার বিষয়। কিন্তু লেখক ‘খনারচর’ গ্রামকে খনার বচনের সঙ্গে একাকার করে দেখিয়েছেন। যা হাস্যকর।

মামুদজান ফকির আমাদের লোকসংস্কৃতির অন্যতম ব্যক্তিত্ব। এ বাউল কবি ছিলেন লোকচক্ষুর আড়ালে। তার রচিত গান ভাটি এলাকায় বিশেষ করে নিকলী উপজেলার গ্রামে গ্রামে প্রচলিত ছিল। তার অনেকগুলো গান সংগ্রহ করেছেন লেখক প্রিন্স রফিক খান। প্রিন্স রফিক খান কাজ করে যাচ্ছেন ঐতিহ্যের হারিয়ে যাওয়া উপাদান উদ্ধারের জন্য। তিনি বাউল মামুদজান ফকিরকে লোকচক্ষুর সামনে নিয়ে এসেছেন। এটা তার কৃতিত্বের পরিচায়ক। আশা করি তারই মাধ্যমে মামুদজান ফকিরের সব রচনা আমাদের হাতে উঠে আসবে। যা হবে বিশ্বসমাজে কিশোরগঞ্জের লোক-ঐতিহ্যকে উপস্থাপন করার অনেক প্রচেষ্টার নবসংস্করণ। যেমনটি কিশোরগঞ্জকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে এসেছেন লোক ঐতিহ্যের প্রধান সংগ্রাহক মোহাম্মদ সাইদুর। সে রকম এ লেখককেও আরো বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর হতে হবে। লেখক মামুদজান ফকিরের কালনির্দেশ করে বলেছেন, তার জন্ম ১৬৯৯ এবং মৃত্যু ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দ।

এ কালপর্ব দোঁয়াশে। কারণ মামুজান ফকিরের রচিত গানে চতুর্দিকে চলছে গাড়ি/বুম্বাডের মতন বাক্যের উপস্থিতি দেখা যায়। বুম্বাড শব্দটির প্রকৃত উচ্চারণ বমবাড>বমবার্ড>বোমবাড। ১ম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে আমাদের লোকজন বমবাড>বমবার্ড>বোমবাড শব্দের সঙ্গে পরিচিত ছিল না। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫) জাপান কর্তৃক ব্রহ্মদেশ দখল করার প্রেক্ষিতে দেশ এলাকা বা প্রতিবেশে যুদ্ধ বিমানের আনাগোনা ও বোমাবর্ষণের ঘটনা পরিলক্ষিত হয়। সেই সঙ্গে বমবাড>বমবার্ড.বোমবাড (যা উচ্চারণ বিকৃতিতে বুম্বাড হয়েছে)। শব্দটির সঙ্গে এ এলাকার লোক সকলের ব্যাপক পরিচিত লাভ ঘটে। অথচ এ শব্দটি অষ্টাদশ শতাব্দীতে মামুদজান ফকির তার রচনায় ব্যবহার করেন কীভাবে? হতে পারে মামুদজান ফকিরের উল্লিখিত সময়কাল সঠিক নয়। তবে কি মামুদজান ফকির ১ম বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুগের বা সমসাময়িক? তাহলে তার প্রভাব বাউল সাধক লালন শাহ (১৭৭২-১৮৯০) কিংবা হাসনরাজা (১৮৪৫-১৯২২)’র ওপর পড়ে কীভাবে? কীভাবেই বা তারা বিপরীতভাবে পারস্পরিক প্রভাব বলয়ে পড়েন? অন্যদিকে সে কথাই ব্যক্ত হয়েছে মামুদজান সম্পর্কে লেখকের উপস্থাপনায়। বিষয়টি অবশ্যই রহস্যাবৃত ও বালখিল্য। তবে এমনও হতে পারে, ওই (বুম্বাড) শব্দ ব্যবহৃত গানটি মামুদজান ফকিরের রচিত নয়। পরবর্তীকালে তার কোনো ভাবশিষ্য গানটি রচনা করেছেন। গানটি আগাগোড়া পাঠ করলে তেমনই উপলব্দি হয়।

‘হেল কুড়িগাই’ শব্দ সমষ্টির অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করেছেন লেখক। লেখকের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এমনও তো হতে পারে তৎকালীন বাউল-দরবেশরা বিশেষ অর্থে ওই শব্দসমষ্টি ব্যবহার করতেন। যার অর্থ সময়ের আবর্তে মনুষ্য স্মরণ থেকে হারিয়ে যায়। সময়ের প্রয়োজনে বিশেষ অর্থবোধক শব্দ আবিষ্কার হওয়া বিচিত্র নয়। কবি, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক গোলাম শফিকের সঙ্গে আলাপ করে জেনে নিয়েছি, নৌকাবাইচ নিয়ে তার লেখা নাটক বাইচাল শব্দটি নৌকাবাইচ-এ অংশগ্রহণকারী বৈঠা হাতে মাঝি ও নৌকা পরিচালক এবং আরোহীদেরকে বুঝিয়েছেন। তিনি বাইচাল শব্দটি কোনো বাংলা অভিধান গ্রন্থে পাননি। যা হোক সার্বিক বিচারে বইটির উৎকর্ষ সম্পর্কে অনর্থক ধারণা করা যাবে না। বইটির মূল্য ১৫০/- টাকা। বইয়ের ভেতর লেখক, লেখকের পিতা-মাতা ও প্রকাশের ঢাউস সাইজের ছবি ব্যবহার খুবই দৃষ্টিকটু। লোক-ঐতিহ্যের সংগ্রাহক মোহাম্মদ সাইদুরের ন্যায় কিশোরগঞ্জ এলাকায় প্রিন্স রফিকের চেহারায় আর একজন লোকসংস্কৃতির সংগ্রাহক বেরিয়ে আসুন, প্রাচীন বাংলাকে আলোকিত করুন, ধন্য হোক বাংলাদেশের মাটি।

তবে লোক-ঐতিহ্যের নামে আমরা শুধু লোক-ঐতিহ্যের তথ্যই পেতে চাই। লোকসংস্কৃতি এবং লোক-ঐতিহ্যকে গুলিয়ে ফেললে লেখকের মেধাই প্রশ্নবিদ্ধ হবে, যা প্রিন্স রফিকের ক্ষেত্রে ঘটেছে।

লেখক প্রাবন্ধিক ও অনুসন্ধানী
সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ,
ওয়ালীনেওয়াজ খান কলেজ, কিশোরগঞ্জ।