মধুমধু হল এক প্রকারের মিষ্টি ও ঘন তরল পদার্থ, যা মৌমাছি ও অন্যান্য পতঙ্গ ফুলের নির্যাস হতে তৈরি করেএবং মৌচাকে সংরক্ষণ করে। এটি উচ্চ ঔষধিগুণ সম্পন্ন একটি ভেষজ তরল ; এটি সুপেয়। বিভিন্ন খাদ্য প্রস্তুতিতে এর ব্যবহারে চিনির চেয়ে এর অনেক সুবিধা রয়েছে। এর বিশিষ্ট গন্ধের জন্য অনেকে চিনির চাইতে মধুকেই পছন্দ করে থাকেন। বাংলাদেশের সুন্দরবনের মধু স্বাদ, রং, হালকা সুগন্ধ এবং ঔষধিগুণাবলীর জন্য প্রসিদ্ধ। সুন্দরবনের বেশীরভাগ মধু কেওড়া গাছের ফুল থেকে উৎপন্ন। সুন্দরবনের মাওয়ালী সম্প্রদায়ের লোকেরা মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে এবং তা বিক্রয় করে জীবন নির্বাহ করে।

বাংলাদেশের জাতীয় মধু বোর্ডের সংজ্ঞা অনুযায়ী “মধু হল একটি বিশুদ্ধ পদার্থ যাতে পানি বা অন্য কোন মিষ্টকারক পদার্থ মিশ্রিত করা হয় নাই।” মধু চিনির চাইতে অনেক গুণ মিষ্টি। তরল মধু নষ্ট হয় না, কারণ এতে চিনির উচ্চ ঘনত্বের কারণে প্লাজমোলাইসিস প্রক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়া মারা যায়। প্রাকৃতিক বায়ুবাহিত ইস্ট মধুতে সক্রিয় হতে পারে না, কারণ মধুতে পানির পরিমাণ খুব অল্প। প্রাকৃতিক, অপ্রক্রিয়াজাত মধুতে মাত্র ১৪% হতে ১৮% আর্দ্রর্তা থাকে। আর্দ্রর্তার মাত্রা ১৮% এর নিচে যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ মধুতে কোন জীবাণু বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। পাস্তুরাইয্‌ড মধুতে মধুর প্রাকৃতিক ঔষধি গুণাবলী হ্রাস পায়।

প্রাচীন গ্রিসের খেলোয়াড়েরা মধু খেযে মাঠে নামতো ; কারণ মধুতে রয়েছে উচ্চমাত্রার ফ্রুক্টোজ ও গ্লুকোজ যা যকৃতে গ্রাইকোজেনের রিজার্ভ গড়ে তোলে। রাতে ঘুমানোর আগে মধু খেলে মস্তিষ্কের ক্রিয়াক্ষমতা ভালো থাকে। নিয়মিত মধু পানে রোগ-বালাই হ্রাস পায় কেননা মধু মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ঠাণ্ডায় মধু ভালো কাজ করে ; পেনসিলভেনিয়া স্টেট কলেজের পরীক্ষায় দেখা গেছে বাজারে যত ঔষধ পাওয়া যায় তার চেয়ে অনেক বেশী কার্যকর এক চামচ মধু। মধুর ভাইরাস প্রতিরোধী ক্ষমতা উচ্চ। মধু হজমে সাহায্য করে। পেটরোগা মানুষদের জন্য মধু বিশেষ উপকারী। প্রাচীন কাল তেকে গ্রিস ও মিশরে ক্ষত সারাইয়ে মধু ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ২০০৭-এ সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পরীক্ষায় দেখা গেছে অধিকাংশ ক্ষত ও জখমের উপশমে মধু ডাক্তারী ড্রেসিং-এর চেয়েও বেশী কার্যকর। অগ্নিদগ্ধ ত্বকের জন্যও মধু খুব উপকারী

মধুর চাক

বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে মধুতে ১৮১টি রাসায়নিক উপাদান পাওয়া গেছে। মধুর গুণ এ থেকেই আঁচ পাওয়া যাবে। এই প্রাকৃতিক নির্যাসটি কৃত্রিমভাবে তৈরি করা সম্ভব নয়। মধু কখনো পচে না। কারণ, এটি নিজেই একটি পচনরোধক। ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ওষুধের একটি প্রধান উপাদান মধু। প্রতিদিন এক চামচ মধু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, নানা রোগের উপসমসহ জীবনীশক্তি বাড়িয়ে দেবে। নিয়মিত ও পরিমিত মধু সেবন করলে নানাবিধ উপকার পাওয়া যায়।

যেমনঃ –

  • হৃদরোগ প্রতিরোধ করে। রক্তনালী প্রসারণের মাধ্যমে রক্ত সঞ্চালনে সহায়তা করে এবং হৃদপেশীর কার্যক্রম বৃদ্ধি করে।
  • রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
  • ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।
  • দাঁতকে পরিষ্কার ও শক্তিশালী করে।
  • দৃষ্টিশক্তি ও স্মরণশক্তি বৃদ্ধি করে।
  • মধুর রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্ষমতা, যা দেহকে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের হাত থেকে রক্ষা করে বার্ধক্য ঠেকাতে সাহায্য করে।
  • মধুর ক্যালরি রক্তের হিমোগ্লাবিনের পরিমাণ বাড়ায়, ফলে রক্তবর্ধক হয়।
  • আন্ত্রিক রোগে উপকারী। মধুকে এককভাবে ব্যবহার করলে পাকস্থলীর বিভিন্ন রোগের উপকার পাওয়া যায়।
  • দুর্বল শিশুদের মুখের ভেতর পচনশীল ঘা-এর জন্য খুবই উপকারী।
  • শরীরের বিভিন্ন ধরনের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এবং উষ্ণতা বৃদ্ধি করে।
  • ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স এবং ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ মধু স্নায়ু এবং মস্তিস্কের কলা সুদৃঢ় করে।
  • মধুতে স্টার্চ ডাইজেস্টি এনজাইমস এবং মিনারেলস থাকায় চুল ও ত্বক ঠিক রাখতে অনন্য ভূমিকা পালন করে।
  • মধু কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
  • যারা রক্ত স্বল্পতায় বেশি ভোগে বিশেষ করে মহিলারা, তাদের জন্য নিয়মিত মধু সেবন অত্যন্ত ফলদায়ক।
  • শিশুদের প্রতিদিন অল্প পরিমাণ মধু খাওয়ার অভ্যাস করলে তার ঠাণ্ডা, সর্দি-কাশি, জ্বর ইত্যাদি সহজে হয় না।
  • ক্ষুধা, হজমশক্তি ও রুচি বৃদ্ধি করে।
  • রক্ত পরিশোধন করে।
  • শরীর ও ফুসফুসকে শক্তিশালী করে।
  • জিহ্বার জড়তা দূর করে।
  • মধু মুখের দুর্গন্ধ দূর করে।
  • বাতের ব্যথা উপশম করে।
  • মাথা ব্যথা দূর করে।
  • শিশুদের দৈহিক গড়ন ও ওজন বৃদ্ধি করে।
  • কাশি-হাঁপানি এবং ঠাণ্ডাজনিত রোগে বিশেষ উপকার করে।
  • শারীরিক দুর্বলতা দূর করে এবং শক্তি-সামর্থ্য দীর্ঘস্থায়ী করে।
  • মধু খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, ফলে শরীর হয়ে ওঠে সুস্থ, সতেজ এবং কর্মক্ষম।
  • যৌন অক্ষমতা দূর করে এবং অটুট যৌবন ধরে রাখে। যৌন অক্ষমতা দূর করার জন্য বিশ্বের প্রখ্যাত মধু বিজ্ঞানীদের মতে দৈনিক পর্যাপ্ত মধুই যথেষ্ট।
  • নিয়মিত মধু সেবন করলে ধাতু দুর্বল (ধ্বজভঙ্গ) রোগ হয় না।

শুধু খাওয়ার জন্যই নয়, সঠিক নিয়মে ব্যবহার করলে রূপচর্চা আর শরীরের ক্ষতিপূরণেও মধু কার্যকর।

আয়রন, ক্যালশিয়াম, ফসফেট, সোডিয়াম ক্লোরাইন, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের মতো খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক মধু ত্বক কোমল করে। পাশাপাশি চুলের উজ্জ্বলতা বাড়ায়।সম্প্রতি ফিমেলফার্স্ট ডটকো ডটইউকে’তে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অবলম্বনে মধুর গুণাগুণ আর ব্যবহার নিয়ে কিছু পন্থা এখানে দেওয়া হল।

শুষ্ক ত্বকের প্রতিকারঃ মধু সাংঘাতিক রকমের প্রাকৃতিক ময়েশ্চারাইজার। যা শুষ্ক ত্বকে চমৎকার কাজ করে। কনুই আর হাঁটুর ত্বক নরম করে। শুধু তাই নয়, ফাটা ঠোঁটেও ম্যাজিক ঘটায় মধু। হাঁটু, কনুই, ঠোঁট বা ত্বকে পরিমাণমতো মধু নিয়ে মালিশ করুন। ৩০ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন।

শক্তিবর্ধকঃ  এনার্জি ড্রিংক আর কফি খেয়ে এনার্জি বাড়ানোর কথা ভুলে যান। এমনকি দ্রুত শক্তি পেতে যে চিনি খাওয়া হয়, সেটারও দরকার নেই। বরং প্রকৃতিকভাবে শক্তির অধিকারী হতে চিনির পরিবর্তে মধু খাওয়া শুরু করুন। চা, বেইক বা রান্না— যেখানেই প্রয়োজন সেখানে চিনির পরিবর্তে মধু দিন। কয়েকদিন পরেই বুঝতে পারবেন আপনি আগের চাইতে আরও কর্মচঞ্চল হয়ে উঠছেন।

চুলের প্রতিকারঃ  প্রাকৃতিক কন্ডিশনার হিসেবে মধু অসাধারণ। চুলের ময়েশ্চারাইজার বাড়ানোর পাশাপাশি মাথার ত্বক পরিষ্কার করে চুল করে রেশম-কোমল। শ্যাম্পু ব্যবহার করার সময় এক চামচ মধু মিশিয়ে নিন। এতে চুল কোমল হবে। অথবা ডিপ কন্ডিশনিং ট্রিটমেন্টের জন্য অলিভ অয়েলের সঙ্গে মধু মিশিয়ে চুলে মাখুন। ২০ মিনিট পর শ্যাম্পু করে ধুয়ে ফেলুন।

স্বস্তিতে আরামঃ  সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে গোসলের পানিতে কয়েক ফোঁটা মধু মিশেয়ে দিন। দেখবেন শরীর ঝরঝরে লাগছে। কারণ মধু মাংসপেশি শিথিল করতে সাহায্য করে।

হ্যাংওভার কাটাতেঃ  সারারাত পার্টি করেছেন। পরদিন মাথা ধরে আছে। কোনো অসুবিধা নেই রয়েছে মধু। ২/৩ টেবিল-চামচ পরিমাণ মধু হ্যাংওভার কাটাতে সাহায্য করে। কারণ শরীরের মেটাবলিজম প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করে মধু।

ফেইশলঃ  যদি ঘরে মধু থাকে তবে পয়সা খরচ করে বিউটি পার্লারে গিয়ে স্পা আর ফেইশলের কোনোই প্রয়োজন নেই। মধুর শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, জ্বালাপোড়া বিহীন আল্ট্রা-ময়েশ্চারাইজিং উপাদান ত্বকের জন্য উপকারী। শুধু মধু মুখে মাখা যায়। আবার দুই টেবিল-চামচ মধুর সঙ্গে দুই চা-চামচ দুধ মিশিয়ে মুখে মেখে রাখুন। ত্বকে ভালোমতো শুষে নেওয়ার জন্য ১০ মিনিট অপেক্ষা করুন। তারপর ধুয়ে পরিষ্কার করে ফেলুন। স্বাভাবিক এক্সফলিয়েটিং ফেইশলের জন্য মধুর সঙ্গে সামান্য চিনি মিশিয়ে তৈরি করতে পারেন ময়েশ্চারাইজিং স্ক্রাব।

তথ্য সুত্রঃ

  1. দেশ বিদেশ অনলাইন
  2. উইকিপিডিয়া
  3. ছবিঃ ইন্টার নেট