বৈশাখ মাসের শুরুতেই হাওর-ভাটি বাংলায় শুরু হচ্ছে বোরো ধান কাটার মহোত্সব। সারা বছরের রক্ত-ঘাম ঝড়ানো পরিশ্রম, ঋণ, কর্জ ও কষ্টে ফলানো একমাত্র ফসল-ধান অতি অল্প সময়ের মধ্যে কেটে ঘরে তুলতে হয়। ধান কাটা মাড়াই-ঝাড়াই এক আনন্দঘন মুহূর্ত। রাত-দিন সর্বত্র সবাই মহাব্যস্ত। সামান্য দেরিতে চক্ষুর সামনে পাকা-কাঁচা ধান নিমিষেই তলিয়ে যেতে পারে অকাল আগাম বন্যার আক্রোশে। সকল আনন্দ হরষে বিশাদে পরিণত হয়। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কৃষকের তেমন করার কিছুই থাকে না। তাই ধান কাটার শ্রমিক, স্থানীয়ভাবে যাদের ‘দাওয়াল’ বলা হয়, প্রস্তুত রাখতে হয় এসব মোকাবেলা করার জন্য। আগাম অকাল বন্যায় বছরে হাওরে ক্ষতি-০.৩৩ মিলিয়ন হেক্টর জমির ফসল, যার অর্থ মূল্য-৩.৪৮ মিলিয়ন টাকা। এ ক্ষতি জাতীয় কৃষির প্রায় ৩%। তাই প্রায় ৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের হাওর এলাকায় ৩৭৩টি হাওরে প্রায় ১৯.৩৭ মিলিয়ন লোকের জমির ধান কাটতে স্বাভাবিক সময়েও লাখ লাখ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। যা হাওর এলাকায় নেই। দেশের বিভিন্ন এলাকা হতে এ সব শ্রমিক ধান কাটতে আসে।

তাদের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করা অপরিহার্য। বছরে হাওরে দেশের এক-পঞ্চমাংশ, প্রায় ৫.২৩ মিলিয়ন টন ধান উত্পাদন হয় ।হাওরে শ্রমিকের অভাবে ধান লাগানো ও কাটাই হচ্ছে বড় সমস্যা। হাওর এলাকায় টি-আউস, টি-আমন ও বোরোর ১.৪০ মিলিয়ন জমিতে ধান উত্পাদন করতে মোট ২৮১ মিলিয়ন (man day) লোকবল দরকার হয়। তন্মধ্যে ৬২ মিলিয়ন (man day) লোকবল দরকার হয় ধানের চারা লাগাতে। টি-আমন কাটা ও বোরো লাগানোর সময় শ্রমিকের অভাব। মোট ২১৯ মিলিয়ন (man day) লোকবল দরকার হয় ধান কাটার জন্য। হাওর অঞ্চলে চেত্র-বৈশাখ মাসে ধান কাটার জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকা বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে লাখ লাখ শ্রমিক নৌকাযোগে আসে। পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, সুরমা, কুশিয়ারার শাখা-প্রশাখা পাড় হয়ে পৗঁছে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। এ সময়ে নদীর শাখা-প্রশাখাগুলোও সমুদ্রের জোয়ারে ফুলে-ফেঁপে ভরে উঠে। গন্তব্যে পৌঁছতে তাদের ৭-১২ দিন লেগে যায়। এ দীর্ঘ যাত্রাপথে তাদের বিভিন্ন নৌ বন্দর, খাড়ি, বাজার পাড়ি দিয়ে রাত যাপন করতে হয়। পথে তাদের বিভিন্ন ঝামেলা, বিড়ম্বনা, ধান লুট ও চাঁদাবাজির সম্মুখিন হতে হয়। তাছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো রয়েছেই।

একজন বেপারির নেতৃত্বে কয়েকজন শ্রমিক মিলে মহাজনের কাছ হতে লগ্নি নিয়ে নৌকা ভাড়া করে তারা ধান কাটতে আসে। জমির মালিককেও জামানত দিতে হয়। ধান কাটার সময়ও তাদের অমানুসিক পরিশ্রম করতে হয়। সুপেয় পানিসহ কিছু সমস্যায় তাদের ভুগতে হয়। হাওরে ধান কাটা হয় ভাগা হিসাবে। জমির অবস্থা, দূরত্ব বুঝে এর পরিমাণ নির্ধারিত হয়। কাটা ও মাড়াই এর পর প্রাপ্ত ধানের প্রায় ১২-১৫% ধান শ্রমিকদের দেয়া হয়। এতে দ্রুত ধান কাটা হয়। বন্যা না হলে, ভাল ধান হলে জমির মালিক বিদায়ের দিন মহা ধুমধামের সাথে শ্রমিকদের জন্য বিদায়ী ভোজ বা খাসি উপহার দিয়ে থাকেন। তাদের নৌকাও সোনালী ধানে ভরে উঠে। তখন অধিকাংশ শ্রমিক সড়কপথে বাড়ি ফিরে যায়। ফিরার পথে বিড়ম্বনা বেশি। ধানের খড়ের গোলা উত্তোলনও ছিল আরেক মহাযজ্ঞ। বর্তমানে সবই কমার্শিয়াল হয়ে গেছে। শ্রমিক কম আসলে হাওরাঞ্চলে সংকট সৃষ্টি হয়। শ্রমিকদের পুঁজি/ঋণ, নিরাপদ যাতায়াতসহ অন্যান্য অসুবিধাগুলো গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে নির্বিঘ্ন / সমাধান করতে হবে। কোন কারণে শ্রমিক না আসলে মহাবিপর্যয় দেখা দেবে।

প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি ছাড়া বর্তমানে আমাদের টিকে থাকা কঠিন। কৃষি প্রযুক্তি আমাদের শ্রমের লাঘব, উত্পাদন খরচ কম, অধিক ফলন, কম অপচয়, বেশি লাভ ও পুষ্ট শস্যদানা উপহার দেয়। কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। সরকার ইতিমধ্যে ১৬০ কোটি টাকায় ভর্তুকি মূল্যে কৃষকদের মাঝে কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে। এ অবস্থায় হাওর এলাকার উন্নয়নের জন্য ‘হাওর ও জলাশয় উন্নয়ন বোর্ড’ ২০ বছর মেয়াদি প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকার মহাপরিকল্পনা/বাজেট অনুমোদন দিয়েছে। এর আওতায় কৃষি প্রকল্পে প্রতি উপজেলায় সর্বোচ্চ ৪টি অটো রাইস ট্রান্সপ্লান্টার সরবরাহ করতে ৪০০ কোটি টাকা এবং ৪৫০ কোটি টাকায় ১০ হাজার কম্বাইন হারভেস্টার সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে। অটো রাইস ট্রান্সপ্লান্টার এবং কম্বাইন হারভেস্টার হচ্ছে ধান রোপণ ও কাটা, ঝাড়াই, মাড়াই যন্ত্র। ২০১২ সাল থেকে শুরু হওয়া এ প্রকল্পটি আট বছরের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য। আমাদের দাবী, দ্রুত হাওর মহাপরিকল্পনায় বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে হাওর উন্নয়নের কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হউক ।

কৃষিবিদ ও হাওর ভূমিপুত্র
ফোন: ০১৭২৭ ০৭৪ ৫৮৪
ইমেইলঃ [email protected]