একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের রাজনীতি বিমুখতা কি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌছেছে তা জানার জন্য শুধু তরুণ প্রজন্মের ফেইসবুক প্রোফাইলে একটু ঢু মারলেই চলত। তাদের প্রোফাইলে পলিটিকাল ভিউস অপশনে লেখা থাকত “I hate politics”অথবা ‘fuck off ‘। এখনো যে অবস্থার পরিবর্তন খুব একটা ঘটেছে তা কিন্তু নয়। তবে পরিবর্তন একটা হয়েছে এটা মানতেই হবে।

অনেক সচেতন বুদ্ধিজীবী একটা সময় আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন ফেইসবুক একটা ছায়াপৃথিবী , এখানে সম্পর্কের গ্রন্থি রচনা করতে গিয়ে মানুষ যন্ত্রের ভেতর তার চেতনাকে কেন্দ্রীভুত করে ফেলছে। দেশ হতে দেশান্তরে অলীক সম্পর্কের জাল বিস্তার করতে গিয়ে মানুষ আসলে হয়ে পড়ছে সবচেয়ে একা।প্রত্যেকটা মানুষ বানাচ্ছে তার নিজের বায়বীয় পৃথিবী তারপর সেখানেই সেই ঘুরপাক খাচ্ছে এবং ধীরে ধীরে পারিপ্বার্শিক মানবিক সমাজ হতে হয়ে পড়ছে বিচ্ছিন্ন।এখানে স্ট্যাটাস দিয়ে মানুষ তার সুখ দুঃখ শেয়ার করে ,দায়বদ্ধতার অবসান ঘটায় , ক্ষোভের প্রশমন ঘটায় । ক্ষোভ পুঞ্জীভুত হয় না তাই আল্টিমেটলি এটা শোষণমূলক সমাজ ব্যবস্থাকে রক্ষা করে।

এ আশঙ্কাগুলো মিথ্যা নয়। তবে কি আমরা প্রযুক্তির আশীর্বাদ গ্রহণ করব না ? বুদ্ধিজীবীরা বলেছিলেন অবশ্যই করতে হবে ।তারা শুধু গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন এটার যথার্থ ব্যাবহারের উপর। হ্যাঁ এর যথার্থ ব্যাবহার করে চলেছে সচেতন তরুণ সমাজ ।নিঃশঙ্ক চিত্তে একদল তরুণ এখানে যুক্তি আর বিজ্ঞানের আলো ছড়ায় কারণ তাদের পায়ে নেই শাস্ত্রীয় বিশ্বাসের অর্গল। রাষ্ট্রের শোষণমূলক সিস্টেমের বিরুদ্ধে তারা ক্ষুরধার সমালোচনা করে্ কারণ তারা রাষ্ট্রের অনুকম্পা প্রার্থনাকারী নয় এবং কর্পোরেট পুঁজির আজ্ঞাবহ দাসও নয়। এখানে প্রগতিশীলদের কমেণ্টে , নোটে, যুক্তির তীক্ষ্ণ বাণে প্রতিক্রিয়াশীলরা ধরাশায়ী হয়। প্রতিবাদ হয় , ক্ষোভ পুঞ্জীভুত হয় , যুব শক্তি সংগঠিত হয় এবং প্রতিরোধের নেশায় তারা মাঠে নামে। এবং এটি যে রাষ্ট্রবিপ্লবে অনন্য ভুমিকা রাখতে পারে তার প্রমাণ সে রেখেছে।

বাংলাদেশে ঠিক কতজন মানুষ ফেইসবুক ব্যাবহার করে এটা নিশ্চয় হাতে গোণা। তবুও এখানে পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে ।তরুণদের রাজনৈতিক ঘৃণার হার কমেছে। হোক না তারা সংখ্যায় নগণ্য তবুও তারা কিছু করতে চায়, পরিবর্তন চায় । দ্বিদলীয় শোষণ আর লুটপাটের বৃত্ত তারা ভাংতে চায় । কিন্তু প্রশ্ন দাঁড়ায় কে তাদের স্বপ্ন ধারণ করবে?

তাদের এই পরিবর্তন স্পৃহাটাকে কাজে লাগাতে চায় অনেক স্বার্থসন্ধানী , রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী, পরিবর্তনের শ্লোগানধারী । দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির সাবেক ফেরিওয়ালা থেকে শুরু করে সুশীল সমাজ , কর্পোরেট মিডিয়া , দলচ্যুত নেতা , কক্ষচ্যুত সাবেক বামপন্থী বিপ্লবী, পত্রিকার সম্পাদক সবাই ঘাই হরিণীর ফাঁদ পেতে রেখেছে যুব সমাজের এই পরিবর্তনের আকাঙ্খা্কে স্বীয় স্বার্থে কাজে লাগাবে বলে।

সম্প্রতি দেখলাম ব্লু ব্যান্ড কল নামে ফেইসবুক ভিত্তিক একটা সংগঠনের আত্মপ্রকাশ করেছে। শ্লোগান দিয়েছে রাজনীতি ঘৃণা করো না। খুবই চমকপ্রদ ও অনুপ্রেরণাদায়ক শ্লোগান। তারা চায় রাজনীতিবিদদের সমঝোতা না হলে অবসর। নেপথ্যে আছেন বি চৌধুরী আর তার গুণধর পুত্র মাহি বি চৌধুরী এবং অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গও আছেন। প্রথমে বলে ছিলাম একটা পরিবর্তন যুব সমাজ চায় তাহলে তার কান্ডারী হবে কে? তবে নিশ্চয় বি চৌধুরী আর মাহি বি চৌধুরীরা নয়। সমঝোতা শব্দটার সাথে বি চৌধুরীর পরিবার বেশ পরিচিত। পিতা পুত্র বাঙ্গালদেশের রাজনীতিতে অনেক ভেল্কি দেখিয়েছেন। ক্ষমতার ভাগিদার হওয়ার জন্য কখনো জামায়াত আবার কখনো বাংলাদেশের পশ্চাদপদতার জন্য দায়ী মৌলবাদী গ্রুপ গুলোর সাথে সমাঝোতায় বসেছেন।

বি এন পি থেকে বিতাড়িত হয়ে আবার হাওয়া ভবনের এসির হাওয়া খেতে গেছেন, সব কিছু ওই তথাকথিত রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য। তারা আবার দুই দলকে এক টেবিলে আনতে চান, যেটা বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে দূঃস্বপ্ন। প্রতি পাঁচ বছর পর এদের এক পক্ষের শাসনে জনগণের নাভিশ্বাস ওঠে এরা দুই দল যদি একত্রিত হয় তাহলে যুগপৎ ভাবে দেশটার গণধর্ষণ চলবে এটা কারো অজানা নয়। সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে নতজানু , ব্যাবসায়ী গোষ্টীর অঙ্গুলিহেলনে পরিচালিত এই দুই দল চাইলেও এক হতে পারবে না। এদের সীমাহীন লূটপাট আর ব্যাক্তিগত রেষারেষি , আদর্শগত দেউলিয়াপনা এমন পর্যায়ে পৌছে যে ওখান থেকে পেছনে ফেরা সম্ভব নয়। এখন তারা প্রতিযোগিতা নিয়ে লুটপাটে নামে তাই ওদের কাছে জনগণের আশা ভরসার কিছু নেই এবং এটাই উন্নয়নশীল দেশগুলোর বুর্জোয়া শাসক শ্রেণীর শ্রেণী চরিত্র। এটা একটা সিস্টেম এখানে “যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবণ”।

আর জনাব বি চৌধুরী গংদের দল তাদেরকে এক করে এবার নতুনভাবে এগোচ্ছেন । এই পরিবর্তনের শ্লোগান মেকি। ভন্ডামি। আদর্শগত দেউলিয়া এবং দলচ্যুতদের দল ক্ষমতার রুটি হালুয়ার ছিটে ফোটা পাওয়ার আশায় , যুব সমাজের পরিবর্তনের আকাঙ্খাকে স্বীয় স্বার্থে কাজে লাগানোর ধান্ধায় কান্ডারী রূপে অবর্তীণ হয়েছেন। এরা সংস্কার চায় আমূল পরিবর্তন নয় ।

শেখ মুজিব আর জিয়াউর রহমানকে পাশাপাশি রেখে কি অদ্ভুত ভারসাম্য রক্ষার প্রচেষ্টা তাদের! বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতি তাকে শ্রদ্ধা জানানো উচিত কিন্তু কে এই জিয়াউর রহমান? এক রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী ধুরন্ধর মেজর, রাজাকারদের পুনর্বাসনকারী, রক্তের বিনিময়ে পাওয়া সংবিধান ধর্ষনকারী, ঠান্ডা মাথার খুনী , মীরজাফর আর কত বিশেষণ লাগবে জিয়াউর রহমানের জন্য ? এই সেই জিয়া যে রাজনীতির আস্তাকুড় থেকে উঠে এসে যে তারই রক্ষাকর্তা, অভাগা জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা দেশপ্রেমি্ক স্বাপ্নিক মানুষ কর্ণেল তাহেরকে ঝুলিয়েছে ফাঁসিতে বিনা অপরাধে বিনা বিচারে।

এ সব আন্দোলন একসময় সুশীলরা করত, এখনো করে কারণ তারা দুই দলের কাছে চায় সৎ যোগ্য আদর্শ জনপ্রতিনিধি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তারা হতাশ হয়ে অন্য পথে এগোচ্ছেন শ্লোগান দিচ্ছেন নতুন করে ভাবতে হবে সবাইকে । বিএন পি আওয়ামীলীগের কাছে প্রত্যাশার কিছু নেই তাই এবার আমরা নিজেরা শুরু করি “বদলে যাও, বদলে দাও। সমাজতন্ত্র আর পুজিবাদী সিস্টেমের জগাখিচুড়ি দিয়ে একটা নতুন তত্ব আনা হবে যা দিয়ে চলবে ভবিষ্যতের সমাজ। এই পরিবর্তনের কাণ্ডারী একটা পত্রিকা, একটা কর্পোরেট গোষ্ঠী এবং আমাদের ন্যাপোবাবু খ্যাত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। এদের শ্রেণীচরিত্র নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে সে সম্পর্কে আর আলোচনায় যাচ্ছি না। এদেরকে আবার দুই লুটেরা গোষ্টী ভয় পায় সেদিন তো প্রধানমন্ত্রী বলেই ফেললেন “সুশীলদের মাঝে মাঝে ক্ষমতায় যাওয়ার উচ্চাভিলাষ জাগে”। তার মানে লূটপাটের ভাগ দিতে এরা মোটেই আগ্রহী নয়।

এই পরিবর্তনের ফেরিওয়ালাদের মৌলিক উদ্দেশ্য হল এই যে পরিবর্তনের চেতনা যুবসমাজের মাঝে জাগ্রত হয়েছে তা তারা নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটে নিতে হবে। এরা সবাই এই শোষণমূলক সিস্টেমের তল্পিবাহক, কেউ কেউ আবার সংস্কার বাদী। এই সিস্টেম বহাল থাকলে শুধু রাজা যাবে রাজা আসবে আর জনগণের মুক্তির আকাঙ্খা হয়ে যাবে সুদূর পরাহত।

কথা হচ্ছিল ফেইসবুক জেনারেশনের রাজনৈতিক আকাঙ্খা নিয়ে । আমরা শুধু জানি আমাদের এগিয়ে যেতে হবে আমূল পরিবর্তনের দিকে আমরা কোন জীর্ণ সমাজের গায়ে সংস্কারের চুনকাম করতে চাই না । এটা ভেঙ্গে পড়বে এবং আমাদের শুধু হাতুড়ি দিয়ে ঘা দিতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক আকাঙ্খা হবে বিপ্লবাত্মক ।আমরা সিস্টেমটা পাল্টাব সিস্টেমটার রক্ষণাত্মক কোন সংস্কারমুলক কাজ আমরা করব না এটাই আমাদের শপথ , উত্তর প্রজন্মের প্রতি দায়বোধ। এখানে বিভ্রান্ত করার জন্য অনেকেই আসে শুধু আমাদেরকে একটু সতর্ক থাকতে হবে। যে ফেইসবুক পুজিবাদের গর্ভ থেকে উৎপন্ন তারই প্রযুক্তিগত উতকর্ষতার ফলে সৃষ্ট আমরা তাকে বানাতে পারি ফ্রাঙ্কেস্টাইনের দানব। এখন ফেইসবুক পুজিবাদকে মরণকামড় বসাতে উদ্যত, তার ঘাড়ে বসে নিঃশ্বাস ফেলছে। তবে এর ব্যাবহার আমরা যেন সঠিক ভাবে করতে পারি , এটি যেন তাদের জন্য বুমেরাং হয়।

হয়তো একদিন, হ্যাঁ কোন একদিন এই পুজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার মুখে শুনব জুলিয়াস সিজারের আর্তহাহাকারের প্রতিধ্বনি জুলিয়াস সিজার যেমন মৃত্যুর আগে তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ব্রুটাসকে বলেছিলেন ব্রুটাস তুমিও!!

এই শোষণমূলক সমাজও একদিন হয়তো বলবে “ফেইসবুক তুমিও!!!

লিখেছেন: ফেরারী সুদ্বীপ্ত