গোধূলির রক্তিম রং ডানায় মেখে কলকাকলি করে নীড়ে ফিরছে ঝাঁকে ঝাঁকে পানকৌড়ি ও বক। দিনের ক্লান্তি শেষে দল বেঁধে তারা ফেরে নিকলী পশ্চিম কবরস্থানে। স্থানটি নিকলীর নয়াহাটি ও পুকুরপাড়—এই দুই গ্রামের মাঝে অবস্থিত। সন্ধ্যা থেকে ভোর অবধি গ্রাম দুটি পাখির কলতানে মুখর থাকে। মানুষ আর পাখপাখালির এমন মিলেমিশে বসবাস সচরাচর চোখে পড়ে না। নিজেদের কিছু অসুবিধা মেনে নিয়েও এলাকার লোকজন মিলে গড়ে তুলেছেন পাখিদের এই অভয়াশ্রম।

নিকলীতে পাখিদের সুখের এই নীড় গড়ে উঠেছে সাত-আট বছর আগে। একসময় আর দশটা গ্রামের মতোই দু-একটা পাখি আসত এখানে। কিন্তু হঠাৎ কেন জানি পাখিদের মনে ধরে গেল জায়গাটি। কথা হয় পুকুরপাড় গ্রামের হাবিবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, বছর সাতেক আগে এই কবরস্থানের কয়েকটি কড়ইগাছে কিছু পানকৌড়ি ও সাদা বক এসে বসে। এরা সেই গাছে বাসা বানায়। সেই যে পাখিরা এল, আর গাছ ছেড়ে যায়নি। দিনে দিনে পাখির সংখ্যা বেড়েছে। এখন অবশ্য এখানে পাখির বৈচিত্র্যের অভাব নেই। পানকৌড়ি, সাদা বক ছাড়াও শামুকভাঙা, শালিক, ঘুঘু, দোয়েল, চড়ুই, টুনটুনি ছাড়াও অচেনা অনেক পাখি এখন আসে। তবে ছোট পাখিগুলোকে পাতার আড়ালে কোনো রকমে গা বাঁচিয়ে থাকতে হয়। কারণ, দাপট সেই পানকৌড়ি ও বকেরই। কবরস্থানের পাঁচটি কড়ইগাছে পাখিদের স্থান সংকুলান হয় না। তাই বিভিন্ন বাড়ির আম, জাম, নারকেলগাছেও ছড়িয়ে পড়েছে পাখিরা। পুকুরপাড় গ্রামের গৃহিণী রুমা আক্তার জানান, শুধু গাছে নয়, ঝড়-তুফান হলে পাখিগুলো বসতঘরে ঢুকে পড়ে। চৌকির ওপর-নিচও তারা দখল করে নেয়। তাড়িয়ে দিলে আবার ফিরে আসে। তখন এদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়। এই বিপদের সময় পাখিগুলো এমন মায়াভরা চোখে তাকিয়ে থাকে, দেখলে কষ্ট লাগে।

স্থানীয় শিক্ষক আশরাফুল হক জানান, জুন, জুলাই ও আগস্টে পাখি বেশি থাকে। নভেম্বর-ডিসেম্বরে শীত বেশি হয়। তখন বকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। নয়াহাটি গ্রামের সাহাব উদ্দিন বলেন, আমাদের নয়াহাটি ও পুকুরপাড় গ্রামের মানুষের ঘুম ভাঙে পাখির কিচিরমিচিরে। কবরস্থানের পাশে টেলিফোন কার্যালয়ে চাকরি করেন ছিদ্দিক মিয়া। তিনি বলেন, ‘পাখির জন্য আমরা আম, জামের মতো রসাল ফল তেমন একটা খেতে পারি না। অবশ্য এ জন্য আমাদের কোনো আফসোস নেই। পাখির কোনো ক্ষতি বা অসুবিধা হোক, তা আমরা চাই না।’ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আবদুল জলিল বলেন, ‘এখানে এত পাখি! না দেখলে  বিশ্বাস করা মুশকিল। গ্রাম দুটি থেকে অল্প দূরেই হাওর। তাই এখানে এত পাখির দেখা মেলে। এখানে কয়েক হাজার পাখি বাস করে।’ কেউ বিরক্ত না করায় পাখির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। কবরস্থান মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ হোসেন বলেন, ‘এখানে পাখিকে কেউ অত্যাচার করলে বা শিকার করলে ৫০০ টাকা জরিমানা করা হবে বলে মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।’

নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. হাবিবুর রহমান বলেন, তিনি রাস্তার পাশের ওই কবরস্থান ও গ্রাম দুটি দেখেছেন। সেখানে রীতিমতো পাখির অভয়াশ্রম গড়ে উঠেছে। এতে এলাকার লোকজনের মধ্যে পাখির জন্য মমতার সৃষ্টি হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে এলাকায় পাখি
শিকার নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ—এই মর্মে একটি সাইনবোর্ড টানিয়ে দেওয়া হবে। পাখি শিকার প্রতিরোধে জনপ্রতিনিধিদের সতকর্তামূলক ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। নিকলী সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপির) চেয়ারম্যান কারার বুরহানউদ্দিন জানান, দু-একদিনের মধ্যে সাইনবোর্ড টানানো হবে।

লিখেছেন- দিলীপ কুমার সাহা, নিকলী
প্রথম আলোতে প্রকাশিত