মনোয়ারা বেগম তখন কিশোরগঞ্জের বৌলাইয়ের ডাক বিভাগের কর্মচারী স্বামী আফসারউদ্দিনের ঘরে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ১১ বছরের একমাত্র মেয়ে হেলেনাকে নিয়ে বাবার বাড়ি নিকলী থানার গুরুই গ্রামে চলে আসেন। একাত্তরের মাঝামাঝি হেলেনাকে গুরুইয়ের মুক্তিযোদ্ধা মতি মিয়ার কাছে বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বিয়ের মাত্র ৪১ দিন পরই পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে মতি মিয়াসহ তিনজন শহীদ হন। মতির শরীরের রক্ত থামাতে ওইদিন মনোয়ারা নিজের গামছা দিয়ে তাঁর ক্ষতস্থান বেঁধে দিয়েছিলেন। ৩৯ বছর ধরে সেই গামছা তাঁর নিত্যসঙ্গী! মুক্তিযুদ্ধের সময় মনোয়ারা কিশোরগঞ্জ সদর, নিকলী ও বাজিতপুর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করেছেন। শত্রু ও শত্রু শিবিরের গোপন খবর এনে বাজিতপুর-নিকলীর মধ্যবর্তী হিলচিয়ার বসুবাহিনীর ‘মুক্তাঞ্চলে’ অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের জানিয়েছেন। মনোয়ারা বেগম (৭৬) বলেন, গোয়েন্দাগিরির সময় তিনি ভিক্ষুকের বেশ ধরতেন। শরীরে জড়ানো থাকত গামছা। হাতে থাকত ঝুলি। এ ছাড়া সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে যে মুক্তিযোদ্ধারা আহত হয়ে মুক্তাঞ্চলে আসতেন, তাঁদের শরীরের রক্তক্ষরণ বন্ধে প্রথমে তিনি নিজের গামছাকে কাজে লাগাতেন। পরে নিয়ে যেতেন চিকিৎসকের কাছে।

একাত্তরের ২৭ অক্টোবর বাজিতপুর যেদিন স্বাধীন হয়, ওইদিন মুক্তিযোদ্ধারা থানা আক্রমণ করলে কুলিয়ারচরের পিরপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবু শামা আহত হন। তাঁকেও ওই গামছায় বেঁধে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান তিনি। মেয়ে-জামাই মতি মিয়ার অকালমৃত্যুই তাঁকে প্রতিবাদী করে তোলে। গোয়েন্দাগিরির পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার সংগ্রহ, রান্না করে খাওয়ানো, সেবাযত্ন মুক্তিযোদ্ধাদের ভালোবেসে সবই তিনি করেছেন। তাঁর মামাতো ভাই নূরুল ইসলাম একাত্তরের ১১ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জে শহীদ হন। তাঁর লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বামী মারা গেলে তিনি চলে আসেন নানার বাড়ি বাজিতপুরে।

বিধবা মা-মেয়ের বেঁচে থাকার নতুন যুদ্ধ শুরু হয়। যত দিন সামর্থ্য ছিল, ধাত্রীর কাজ করেছেন। পরে কয়েক বছর বাজিতপুর পৌরসভার স্বাস্থ্য বিভাগে কাজ করেছেন। এখন বয়সের ভারে কাজ করতে পারেন না। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকে যে ভাতা পান, তাতে সংসার চলে না। রাজাকার, আলবদর বা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত শরীরে যুদ্ধদিনের স্মৃতি জড়ানো এ গামছা পরে থাকবেন বলে জানান মনোয়ারা।

লিখেছেনঃ নাসরুল আনোয়ার, বাজিতপুর