অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা এবং উজানের অংশে ভারত কর্তৃক একতরফাভাবে পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা যে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অন্যতম প্রধান অন্তরায়, তা বোধহয় কারো অজানা নয়। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়া, টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর ব্যাপক সমালোচনা সত্ত্বেও ভারতের নিস্পৃহ মনোভাব, ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে অসংখ্য বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনাসহ আন্তঃনদী সংযোগের মাধ্যমে এ নদীর পানি সরিয়ে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে নেয়ার পরিকল্পনা এবং গঙ্গা চুক্তি বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও ১৫ বছরের মধ্যে এ পর্যন্ত প্রায় কোনো শুকনো মৌসুমেই ন্যায্য হিস্যা না পাওয়াই অন্যতম প্রধান সমস্যা। যদিও এর বাইরে আরো কিছু অমীমাংসিত সমস্যা বিদ্যমান।
ভারত থেকে বয়ে আসা ৫১টি নদীর প্রায় সব কয়টিতেই ভারতের অভ্যন্তরে স্বাভাবিক প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে একতরফাভাবে পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে অথবা নিয়ন্ত্রণমূলক স্থাপনা নির্মাণ করেছে কিংবা করার উদ্যোগ নিচ্ছে। প্রাকৃতিক নিয়মে নদ-নদীগুলোকে বহমান থাকতে দিলে শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশে পানির অভাব হতো না। অথচ বর্তমানে প্রায় সব অভিন্ন নদ-নদীতেই শুকনো মৌসুমে পানিপ্রবাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। খুব সোজাসাপ্টা করে বলতে গেলে এটাই বলা যায় যে, যদি বাংলাদেশ ভারতের একটি প্রদেশ হতো, তাহলে কোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের পক্ষেই ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বয়ে আসা নদ-নদীগুলোর পানিপ্রবাহ এমনভাবে বিঘ্নিত কিংবা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো না। অন্যভাবে বলা যায়, যদি পানি ও পরিবেশবিজ্ঞানের সাধারণ সূত্র কিংবা নিয়মাবলি মেনে নিয়ে যুক্তিতর্কের ভিত্তিতে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা করা হতো, তাহলেও অভিন্ন নদী কিংবা অববাহিকায় উজান অঞ্চলের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করা কারো কাছে গ্রহণযোগ্য হতো না।
গঙ্গা চুক্তির বাস্তবায়নে সমস্যা, তিস্তা চুক্তি না হওয়া এবং টিপাইমুখ বাঁধ বিষয়ে ভারতের অটল মনোবৃত্তি নিয়ে কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে আলোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। অভিন্ন নদ-নদীর পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ভারতের অযৌক্তিক, অনৈতিক ও অবৈজ্ঞানিক অবস্থানের কয়েকটি দিক নিয়ে আলোচনা করা যাক।
গঙ্গা চুক্তির অর্ধেক সময় অতিবাহিত হয়েছে, অথচ যৌথ নদী কমিশনের বিভিন্ন প্রেস বিজ্ঞপ্তি, পত্রিকায় প্রকাশিত খবর, বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণধর্মী প্রকাশনা এবং সরেজমিন তদন্তের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ১৫ বছরের মধ্যে ১২ বছরই বাংলাদেশ চুক্তি মোতাবেক প্রাপ্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের কোনো সরকারের পক্ষ থেকেই প্রতিবাদের কথা জানা যায় না। গত বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ফারাক্কার দুটি গেট ভেঙে যাওয়ার কারণে অধিক পরিমাণে পানি বাংলাদেশে ঢুকে যাচ্ছে এবং এতে পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় অঞ্চলে লোনা পানির প্রবেশ বেড়ে যাওয়া ও কলকাতাসহ অনেক লোকালয়ে পানি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা করা হয়। ব্যাপারটি দ্রুতগতিতে সমাধানে কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্যও চাওয়া হয়।
অথচ বাংলাদেশ বছরের পর বছর ধরে ন্যায্য পানির হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে, সে কথাটি কখনো ভারতীয় পত্রিকায় খবর হয়নি। উপরন্তু ফারাক্কা থেকে যে পানি ব্যারাজের মাধ্যমে হুগলি নদীতে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে, প্রাকৃতিক নিয়মে নদীকে চলতে দিলে তার পুরোটাই বাংলাদেশে আসার কথা ছিল। তাছাড়া শুকনো মৌসুমে যখন বাংলাদেশ তার ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়, তখনো কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে লোনা পানি ঢুকে যায় এবং পরিবেশ-প্রতিবেশসহ অর্থনৈতিক নানা কর্মকাণ্ড বিঘ্নিত হয়, যা কিনা বাংলাদেশের অনেক পরিবেশবিদ অনেকবার জনসমক্ষে তুলে ধরেছেন; কিন্তু বাংলাদেশ কিংবা ভারত সরকার সে ব্যাপারে মোটেও কর্ণপাত করেনি।
তিস্তা পানিচুক্তি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির গোয়ার্তুমির কারণে ২০১১ সনের সেপ্টেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরকালে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে এ কথা বলা হচ্ছে যে, ভারতে পানিসম্পদ প্রাদেশিক নিয়ন্ত্রণের আওতায়। তাই রাজ্য সরকারকে বাদ দিয়ে কোনো চুক্তি করা সম্ভব নয়। অথচ ফারাক্কা ব্যারাজের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় সরকারেরই হাতে। একইভাবে টিপাইমুখ বাঁধও তৈরি হবে কেন্দ্রীয় সরকারের তত্ত্বাবধানেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ভারত সরকার তাদের সুবিধামতো পানিসম্পদের দায়িত্ব ও মালিকানা কখনো কেন্দ্রের হাতে আবার কখনো রাজ্য সরকারের হাতে ছেড়ে দিচ্ছে। পত্রিকান্তরে এটাও শোনা যাচ্ছে, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এখন আবার সিকিমকেও তিস্তা পানি বণ্টনের আলোচনার অংশ করতে চাচ্ছে।
অন্যদিকে মমতা ব্যানার্জি পানিবিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রকে দায়িত্ব দিয়েছেন শুকনো মৌসুমে গোজালডোবা ব্যারাজ থেকে বাংলাদেশের জন্য কী পরিমাণ পানি ছাড় দেয়া সম্ভব, তা খতিয়ে দেখার জন্য। কল্যাণ রুদ্র ও মমতা ব্যানার্জি একাধিকবার উল্লেখ করেছেন, শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশকে ২৫ শতাংশের বেশি পানি দেয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়; অথচ কেন্দ্রীয় সরকারের খসড়া চুক্তিতে বাংলাদেশকে ৫০ শতাংশ পানি দেয়ার কথা ছিল বলে জানা যায়। তিস্তা নদীর অববাহিকার বাংলাদেশ অংশে প্রায় ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর বসবাস, অথচ কোন হিসাবে মাত্র ২৫ শতাংশ পানি ছাড় দিতে চায়, তা বোধগম্য নয়। আরো একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, তিস্তা নদীর পানি খাল কেটে মহানন্দা-মেচীসহ অন্যান্য নদ-নদীর অববাহিকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যা কিনা আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নেরই শামিল। তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের আলোচনায় বাংলাদেশ সরকারের উচিত জোরেশোরে ব্যাপারটি উপস্থাপন করা এবং তথ্য-উপাত্ত দাবি করা। শুধুই চুক্তির খাতিরে চুক্তি করা বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে না।
সম্প্রতি চীন সরকার ব্রহ্মপুত্রের উজানে (যা কিনা ইয়ারলং সাংপু নামে পরিচিত) তিনটি বাঁধ নির্মাণ করার পরিকল্পনা পাস করেছে। কয়েক বছর ধরেই চীন ব্রহ্মপুত্রের ওপর এবং কয়েকটি শাখা নদীর ওপর জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করে আসছিল। তাছাড়া চীন দক্ষিণ-উত্তর আন্তঃনদী সংযোগের অংশ হিসেবে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা থেকে পানি সরিয়ে দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে নিয়ে যাওয়ারও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা প্রায়ই পত্রিকান্তরে জানা যায়। চীনের উপরিউক্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে ভাটিতে অবস্থিত ভারত ও বাংলাদেশের জন্য সমূহ ক্ষতির কারণ হবে। উপরন্তু ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় ভারতের নির্মিত ও প্রস্তাবিত বিভিন্ন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ও আন্তঃনদী সংযোগের পরিকল্পনা হুমকির মুখে পড়বে। চীনের প্রস্তাবিত এসব পরিকল্পনা ঠেকানোর উদ্দেশ্যে কয়েক বছর ধরে ভারত উচ্চপর্যায়ে চীনের সঙ্গে মতবিনিময় করে যাচ্ছে। এখানে একটি মজার ব্যাপার হলো এই যে, চীনের ব্রহ্মপুত্রসংক্রান্ত বাঁধ ও পানি অপসারণ প্রকল্পের বিরুদ্ধে ভারতের প্রতিবাদে বাংলাদেশকেও শামিল হওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে। অথচ ভারত অভিন্ন নদীর ন্যায্য হিস্যার ব্যাপারে প্রতিনিয়ত ভাটিতে অবস্থিত বাংলাদেশের স্বার্থ উপেক্ষা করে যাচ্ছে। ভারতের কোনো কোনো পরিবেশবাদী সংগঠন ভারতের এ দ্বিমুখী নীতির কথা ভারত সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে গত তিন মাসে বাংলাদেশের পত্রিকা ও অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা ও বিশ্লেষণ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী টিপাইমুখ বাঁধের সম্ভাব্য অভিঘাত বিষয়ে বিজ্ঞান এবং যুক্তিনির্ভর আলোচনার আহ্বান করেছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে অনেক বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের ব্যক্তি জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণ করেছেন। সেসব লেখায় টিপাইমুখ বাঁধের সম্ভাব্য অভিঘাতের শঙ্কার কথা বলা হয়েছে। যদিও এখনো সরকারের পক্ষ থেকে সেসব শঙ্কা কীভাবে মোকাবেলা করা হবে, তার ব্যাখা দেয়া হয়নি। অন্যদিকে ভারতের পত্রপত্রিকায় অনুসন্ধান করে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে হাতেগোনা কয়েকটি খবর প্রকাশিত হয়েছে, যার বেশির ভাগ খবরেই ভারত সরকারের কর্তাব্যক্তিদের এ বাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে সুদৃঢ় মনোভাবের কথাই পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। কয়েকটি সংবাদে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর এ বাঁধের বিরোধিতার খবরও প্রকাশ করা হয়েছে; কিন্তু এসব খবরের কোনোটিতেই বাংলাদেশে প্রকাশিত শঙ্কার কথা নিয়ে কোনো আলোচনাই দৃষ্টিগোচর হয়নি।
আরো একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে, যদিও টিপাইমুখ বাঁধের ফলে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের আদিবাসী ও পরিবেশবাদীরা বিরোধিতা করছে, কেন্দ্রীয় সরকার এ বাঁধের পরিকল্পনা কিংবা বাস্তবায়নের দায়িত্ব কিন্তু রাজ্য সরকারগুলোর হাতে ছেড়ে দিচ্ছে না, যেমনটি তারা বাংলাদেশের সঙ্গে করছে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে। বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি ১০ সদস্যের একটি দলের নাম ঘোষণা করেছে, যারা ভারতের নিয়োজিত দলের সঙ্গে টিপাইমুখ বাঁধের সম্ভাব্য অভিঘাত যাচাই করার লক্ষে যৌথ সমীক্ষা পরিচালনা করবেন বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ভারতের সমীক্ষা দলের সদস্যদের নাম এখনো জানা যায়নি। বাংলাদেশের উচিত হবে ভারতীয় সমীক্ষা দলের ধরন ও গঠন পর্যালোচনা করে নিজেদের দলকেও পুনর্বিন্যাস করা। আশা করা যাচ্ছে যে, সম্পূর্ণ খোলা মন নিয়ে এ সমীক্ষা দল তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করবে এবং প্রয়োজনে ভারতের প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ বাতিল করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানাতেও পিছপা হবে না। পূর্ব-অভিজ্ঞতা যদি কোনো ভবিষ্যৎ ইঙ্গিত বহন করে, তাহলে ভারতের সঙ্গে পানিসম্পদের ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সব বৈঠক এবং আলাপ- আলোচনায়ই প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করে নিয়ে তাদের মোকাবেলা করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। যৌথ নদীর পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় ভারতের নীতিমালা অসঙ্গতিতে ভরপুর। তাই সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্তভিত্তিক ও বিজ্ঞানসমৃদ্ধ প্রতিনিধি দল নিয়ে তাদের মোকাবেলা করার বিকল্প নেই।
লেখক: অধ্যাপক, ভূ-বিজ্ঞান বিভাগ
লক হ্যাভেন ইউনিভার্সিটি, পেনসিলভানিয়া, যুক্তরাষ্ট্র