মুক্তিযোদ্ধাদের মূল দল আক্রমণের লক্ষ্যে রওনা হলো সীমান্তসংলগ্ন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটির উদ্দেশে। একই সময় আরেক দল রওনা হলো কাট অফ পার্টি হিসেবে। এই দলে আছেন আবদুল জব্বার। তাঁরা সীমান্ত অতিক্রম করে মধ্যরাতে অবস্থান নিলেন সড়কের ধারে। সেখানে চারদিকে ঝোপঝাড়। এর আড়ালে মুক্তিযোদ্ধারা অপেক্ষা করতে থাকলেন। তাঁরা জানেন, তাঁদের মূল দল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ করামাত্র নিকটবর্তী পাকিস্তানি ঘাঁটির সেনারা এই পথ দিয়ে আসবে।
ভোর রাতে গোলাগুলির শব্দ শুনে আবদুল জব্বার ও তাঁর সহযোদ্ধারা সতর্ক হলেন। বুঝতে পারলেন তাঁদের মূল দল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সীমান্তসংলগ্ন ঘাঁটিতে আক্রমণ করেছে। তাঁদের চোখ রাস্তার দিকে। ২০-২৫ মিনিট পর রাস্তায় গাড়ির শব্দ। মুক্তিযোদ্ধারা দেখতে পেলেন তিনটি গাড়ি এগিয়ে আসছে। সেগুলো গুলির আওতায় আসামাত্র গর্জে উঠল তাঁদের সবার অস্ত্র। একটি গাড়ি ধ্বংস হলো মুক্তিযোদ্ধাদের পাতা মাইন বিস্ফোরণে। পাকিস্তানিরা পাল্টা আক্রমণের তেমন সুযোগ পেল না। হতাহত হলো অসংখ্য পাকিস্তানি সেনা।
এ ঘটনা ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের। কামালপুরের পাশে জামালপুর-বকশীগঞ্জ সড়কে। আবদুল জব্বারের দলনেতা ছিলেন আবদুল মান্নান বীর বিক্রম। তাঁর নেতৃত্বে আবদুল জব্বার এই অপারেশনসহ আরও কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নেন। আবদুল মান্নানের বয়ানে শোনা থাক কয়েকটি যুদ্ধের ঘটনা:
‘… অনেক যুদ্ধ হয় কামালপুর এলাকায়। কামালপুরের পরে একটি গ্রাম ধানুয়া কামালপুর। ওই গ্রামটির কন্টিনিউয়েশন ভারত সীমান্তের ওপারের গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। ধানুয়া কামালপুরের একটি কন্টিনিউয়েশন ছিল বকশীগঞ্জের দিকে। এই পথে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আমি চার থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে ছয়-সাতটি পাকিস্তানি আর্মির গাড়ি মাইনের সাহায্যে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছিলাম।
‘কামালপুরে এমন কোনো দিন ছিল না যে পাকিস্তানিরা শান্তিতে বসবাস করতে পারত। অক্টোবর মাসের কোনো এক সময় ইন্ডিয়ান আর্মির একটি ব্যাটালিয়ন দিয়ে পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ চালানো হলো। সেই আক্রমণে তাদের একটি কোম্পানি কামালপুরের পেছনে অ্যামবুশ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি কোম্পানিও তাদের সঙ্গে ছিল। কামালপুরের পাকিস্তানি ফোর্সকে সহায়তা করার জন্য বকশীগঞ্জ থেকে মর্টার নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তিনটি গাড়ি আসছিল। তখন রাস্তায় অ্যামবুশ করে গাড়িসমেত পাকিস্তানিদের খতম করা হয়।’
আবদুল জব্বার চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন কুমিল্লা সেনানিবাসের স্টেশন সাপ্লাই ডিপোতে। তখন তাঁর পদবি ছিল হাবিলদার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ২৯ মার্চ সেনানিবাস থেকে পালিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেওয়ার পর প্রথমে ৫ নম্বর সেক্টরে, পরে ১১ নম্বর সেক্টরের মহেন্দ্রগঞ্জ সাবসেক্টরে যুদ্ধ করেন। ৫ নম্বর সেক্টরের বড়ছড়া সাবসেক্টরে থাকাকালে ৮ আগস্ট সাচনা-জামালগঞ্জে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আবদুল জব্বারকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৭৭।
আবদুল জব্বার স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অনারারি ক্যাপ্টেন হিসেবে অবসর নেন। পরে চাকরি করেন সশস্ত্র বাহিনী বোর্ডে। তাঁর পৈতৃক বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার ভাটিয়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মো. আলী হোসেন, মা আনেছা খাতুন। স্ত্রী রওশন আরা আক্তার। তাঁদের চার ছেলে ও এক মেয়ে।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, মো. আবদুল হান্নান।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান