অগনিত শহীদের আত্মোৎসর্গে স্বাধীন হয়েছিল আমাদের এদেশ। পরম গৌরবে মন্ডিত মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোর ভেতর চরম শোকের অসংখ্য ঘটনা আছে।সেই সব শোক ও গৌরবের একটি হচ্ছে খায়রুল জাহানের আত্মদান।

ছোটবেলা থেকে খায়রুল জাহান ছিলেন সাহসী প্রকৃতির, যে কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন ১৯৭১ সালে ছিলেন ২০ বছরের তরুণ। পড়াশুনা করছিলেন ময়মনসিংহ কারিগরী মহা বিদ্যালয়ে। পাকিস্থান বিমান বাহিনীতে পরিক্ষা দিয়ে মনোনীত হয়েছিলেন, পশ্চিম পাকিস্থানে গিয়ে প্রশিক্ষন নেয়ার জন্য চিঠি আসে মার্চ মাসের ২৭ তারিখ কিন্তু তখন পাকিস্থানী পাকিস্থানী আর্মিরা মেতে উঠেছে বাঙ্গালী হত্যাযজ্ঞে। পাকিস্থান বিমান বাহিনীর অফিসার হওয়ার চেয়ে যুদ্ধ করে মাতৃভূমিকে মুক্তকরার সঠিক মনে করলেন খায়রুল জাহান। অতি আদরের বড়ছেলে যুদ্ধে যাবে মা বেগম শামসুন্নাহারের মন সায় দিতে চায় না।

খায়রুল জাহান মুখে হাসি নিয়ে বলেন – মা তোমার চারটি ছেলে – কাজল, নয়ন, লেলিন তো রইলো, একটি ছেলেকে স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গ কর। সেই দিনের সেই আলোচনার সময় নয়ন কাছেই ছিলেন। নয়ন ভাই দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললেন – মাত্র ছয় মাসের মধ্যে ভায়ের কথা যে এমন নির্মম সত্য হয়ে ফলবে তা কি তখন ভাবতে পেরেছিলাম !

কিশোরগঞ্জের মুক্তিকামী তরুণ যুবকদের সংঘটিত করে খায়রুল জাহান বাসা থেকে বের হয়ে পড়েন জুন মাসের ৭ তারিখ। ভারতের মেঘালয়ে সামরিক প্রশিক্ষন নিয়ে মেজর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে ২ নং সেক্টরের গ্রুপ কমান্ডার হিসাবে পাকিস্থানীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য লড়াই করেন। নভেম্বরে চলে আসেন গ্রামের বাড়ী লতিফপুরে বেশ কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধাকে সাথে নিয়ে কিশোরগঞ্জ শহরে অপারেশন চালাবার পরিকল্পনা করেন চরপুমদী বাজার থেকে একজন রাজাকার ডাকবাংলায় খবর পৌছায় শত শত পাক আর্মি আর রাজাকার মিলে ঘিরে ফেলে মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট দলটিকে। ভোর বেলায় তুমুল যুদ্ধ শুরু হয় সহযোদ্ধাদের নিরাপদে স’রে যাবার সুযোগ সৃষ্টির জন্য খায়রুল জাহান জীবনের ঝুকি নিয়ে একাই গুলি ছুড়তে থাকেন শত্রুর উপর। সহযোদ্ধাদের অধিকাংশই  অক্ষত অবস্থায় স’রে যেতে পারে। ৭-৮ জন পাক আর্মি নিহত হয় প্যারাভাংগার যুদ্ধে। শত শত পাক আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে একপর্যায়ে প্রতিপক্ষের গুলির আঘাতে শহীদ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল জাহান।

এ যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা সেলিম ও শহীদ হয়েছিলেন। দিনটি ছিল নভেম্বরের ২৬ তারিখ। আওয়ামীলীগ অফিসের বিপরীতে বর্তমান হাবিব জুয়েলার্সে ছিল তাদের পারিবারিক ধান ভাংগানোর মিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা খায়রুলের ছোট ভাই নয়ন তখন ৮ম শ্রেণীতে পড়াশুনা করছিলেন । যুদ্ধের বাস্তবতায় এ বয়সে  সংসারের অনের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল তখন তিনি ধান ভাংগানোর মিলে ছিলেন। বড় ভায়ের মৃত্যু সংবাদ পান দুপুর বেলায়। সাইকেল নিয়ে তখনি ছুটে যান বাসায় দেখেন রাজাকার ও পাক আর্মিরা বাসা ঘিরে রেখেছে। পিতা আব্দুল হাই তালুকদার তখন বাসায় ছিলেন না। মাওলানা মুসলে উদ্দিনের ছেলে রাজাকার হোসাইন তার পেন্টে লেগে থাকা শহীদ খায়রুলের রক্ত মাকে দেখিয়ে উল্লাস করে, চিৎকার করে গালি গালাজ করে।

ব্যাথিত অতিথ যেন বর্তমান  হয়ে দেখা দেয়। ৩ যুগ আগে ভাইকে হারানোর কথা বলতে গিয়ে নয়ন ভাই নিশ্চুপ হয়ে পড়েন। এ নীরবতার প্রভাব আমাদের উপরেও পড়ে। অজান্তেই যেন খায়রুল জাহান আমাদের আদরের ভাই হয়ে উঠেন।

অনেকটা সময় নীরবতার পর কষ্ট এবং ক্ষোভের সাথে নয়ন ভাই একটা বিষয়ে কথা বলেন। গুরুদয়াল সরকারী কলেজে যে স্মৃতি ফলক টি তৈরি হয়েছে সেখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের নাম আছে কিন্তু শহীদ খায়রুলের নামটি নেই । যে খায়রুল জাহানকে সরকার মরনোত্তর বীর প্রতীক খেতাবে ভূষীত করেছিলো। তার স্মৃতি রক্ষার্থে প্যারাভাঙ্গা গ্রামের সেই রণভূমিতে একটি স্মৃতি স্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। ময়মনসিংহ কারিগরী ছাত্রাবাসের নাম রাখা হয়েছে ‘ শহীদ খায়রুল ছাত্রাবাস’ সেখানে গুরুদয়াল কলেজের স্মৃতিফলকে শহীদ খায়রুলের নাম কেন নেই – আমাদের ও প্রশ্ন ।

–      ঊষসী, সেলিম পারভেজ সম্পাদিত, ১ম সংখ্যা সেপ্টেম্বর ২০০৮