লিওনার্দ ও নিকোলাস জার্মান দম্পতি জন বালাজ ও সুসান লোলের ফুটফুটে যমজ সন্তান। তবে তারা শুধু জার্মান দম্পতিরই সন্তান নয়, তাদের জন্মে অংশীদারিত্ব আছে এক ভারতীয় নারীরও। ভারতীয় নারীর জরায়ুতে তাদের বেড়ে ওঠা অর্থের বিনিময়ে। আইনগত দীর্ঘ ঝুটঝামেলা শেষে সম্ভবত আগামী বছরে লিওনার্দ ও নিকোলাস জার্মানি যেতে পারবে।

ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে গুজরাটের একটি ছোট শহর আনন্দের এক সন্তান জন্মদান ক্লিনিকে তাদের জন্ম। সেই থেকে কার্যত রাষ্ট্রবিহীন নোম্যান’স ল্যান্ডের অধিবাসী লিওনার্দ ও নিকোলাস। জার্মানি কিংবা ভারত সরকার কেউই তাদের নাগরিকত্বদানে আগ্রহী নয়। তারা রাষ্ট্রহারা। অবশ্য নিষ্পাপ দুই শিশুর জার্মান মা-বাবা মরিয়া ছিলেন সন্তানদের নাগরিকত্ব আদায়ে। তারা অব্যাহতভাবে ভারত ও জার্মান কর্তৃপক্ষকে চাপ দিয়েছেন শিশু দুটিকে নাগরিকত্ব প্রদানে।

গুজরাটের একটি ক্লিনিকে কয়েকজন সারোগেট মাদার

জার্মান দম্পতির দুঃখ-দুর্দশা আবারো তুলে ধরেছে কী ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয় বিদেশি নিঃসন্তান দম্পতিদের। যারা কি না ভারতে আসেন ভাড়া করা মায়ের জঠরে সন্তান জন্মদানের আশায়। আনন্দের আকাক্সক্ষা ইনফারটিলিটি ক্লিনিকের পরিচালক ড. নয়না প্যাটেল জানান, ‘আমি তাদের প্রতিনিধি মাতৃত্ব (ভাড়া করা গর্ভাশয়) বিষয়ক চুক্তি করার আগেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। তারা পরে একটি উপায় বের করার ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন।’ ডা. প্যাটেল প্রতিনিধি মাতৃত্বের মাধ্যমে নিঃসন্তান জার্মান দম্পতির সন্তান জন্মদানের চিকিৎসক ছিলেন।

‘প্রতিনিধি মাতৃত্ব’ চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক চমক লাগানো পদ্ধতি। এ প্রক্রিয়ায় জরায়ুর বাইরে শুক্রাণু-ডিম্বাণুর মিলন ঘটানো হয়, পরে তা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে প্রতিস্থাপন করা হয় ভাড়া করা এক নারীর জরায়ুতে।

জন্মদানের পর যমজ সন্তানদের জার্মানিতে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে বালাজ-সুসান দম্পতির। কেননা জার্মান আইনে মাতৃত্বের ক্ষেত্রে প্রতিনিধি মাতৃত্ব বা ভাড়া করা মাতৃত্বের স্বীকৃতি নেই। ভারতেও এ বিষয়ে কোনো আইন নেই। আর এ কারণেই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বিদেশি দম্পতির যমজ সন্তানদের পাসপোর্ট ইস্যু করতে নারাজ। ভারতের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী সেটি সম্ভব নয়। কেননা লিওনার্দ ও নিকোলাস জার্মান দম্পতির সন্তান।

ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট এ অচলাবস্থায় এগিয়ে এসেছেন। সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন দুই শিশুর জন্য ভ্রমণ সংক্রান্ত কাগজপত্র (ট্রাভেল ডকুমেন্ট) ইস্যু করতে। কিন্তু পাসপোর্ট নয়। অবশ্য ট্রাভেল ডকুমেন্টের মাধ্যমেই জার্মান দম্পতি তাদের শিশুদের নিজ রাষ্ট্রে নিতে সক্ষম হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সুপ্রিমকোর্ট সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো অবস্থাতেই দুই শিশুকে ‘পণ্য’ কিংবা ‘রাষ্ট্রহীন’ বলে অভিহিত করা যাবে না। কোর্টের নির্দেশে প্রাথমিক বাধা দূর হয়েছে বটে। তবে পাসপোর্ট ছাড়া দুই শিশুর আইনগত স্বীকৃতি বা জার্মানির নাগরিক হিসেবে সুযোগ-সুবিধা পেতে অসুবিধা হবে এমনটাই মনে করছেন সন্তানদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন জার্মান দম্পতি। শিশু দুটির যদি ভারতীয় পাসপোর্ট থাকতো তবে তারা জার্মান মা-বাবার দত্তক সন্তান বলে বিবেচিত হতো। নিশ্চিতভাবে ভোগ করতো সব নাগরিক সুযোগ-সুবিধা।

বছরখানেক আগে জাপানি এক দম্পতির ক্ষেত্রে এ ধরনের একটি সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল। ভারতীয় এক নারীর গর্ভাশয়ে মান ঝি নামের কন্যাশিশুটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার কয়েক মাস আগে জাপানি দম্পতির ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। সন্তান আগ্রহী জাপানি মা সিদ্ধান্ত পাল্টে ক্লিনিককে জানিয়ে দেন, তার এখন আর সন্তানের দরকার নেই। বিষয়টি ক্যাবল নিউজ নেটওয়ার্ক (সিএনএন) প্রচার করেছিল। মান ঝির বাবা ড. ইকুফুমি ইয়ামাদা এবং দাদি ইমিকো ইয়ামাদা অবশ্য জাপান থেকে তাকে নিয়ে যেতে ভারতে এসেছিলেন। কিন্তু ভারতীয় আইন সে ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ভারতীয় আইন মতে, শিশুর পাসপোর্ট নিতে হলে মাকে অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হবে। ঝামেলা এড়াতে মান ঝির বাবা নিজ সন্তানকে দত্তক নেয়ার প্রস্তাব করেন। তবে ভারতীয় আইনে তাও সম্ভব ছিল না। দত্তক নেয়ার ক্ষেত্রেও মায়ের উপস্থিতি আবশ্যক ছিল।

মর্মান্তিক এ বিষয়টি তখন আন্তর্জাতিক শিরোনাম হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য মান ঝিকে একটি জন্ম সনদ দেয়া হয় যাতে শুধু বাবার নাম উল্লেখ করা হয়। গত বছরের শেষদিকে মান ঝি জাপানের ওসাকার উদ্দেশে উড়াল দিতে সক্ষম হয়।

ডা. প্যাটেল স্ট্রেইট টাইমসকে বলেন, ভারতের নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫ সালে প্রণীত। তখন প্রতিনিধি মাতৃত্ব বা অন্য নারীর গর্ভাশয় ভাড়া করে সন্তান জন্মদানের বিষয়টি অজানা ছিল। এখন প্রতি বছর বহু বিদেশি এ পদ্ধতির মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের আশায় ভারতে আসছেন। তাদের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক আইন দরকার। তিনি আরো বলেন, জাপান, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমার কাছে এ ধরনের দম্পতি আসছেন। আমি তাদের সবাইকে আগে নিজ দেশের নাগরিকত্ব আইন ভালোভাবে পড়তে বলি। অগ্রসর হওয়ার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরির পরামর্শ দিই।

ডা. প্যাটেলের ক্লিনিক বন্ধ্যত্ব বিষয়ক চিকিৎসার জন্য ভারতে সবচেয়ে বিখ্যাত। প্রথমে এটির নাম ছিল ‘ক্রাডেল অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ বা বিশ্বের সূতিকাগার। ২০০৩ সালে ডা. প্যাটেল আন্তর্জাতিক পত্রিকার শিরোনাম হয়ে ওঠেন প্রতিনিধি মাতৃত্বের বিষয়টি সার্থকভাবে সম্পন্ন করে। এ সময় তিনি একজন স্থানীয় নারী জোগাড় করেছিলেন যিনি নিজ গর্ভাশয় ভাড়া দিয়েছিলেন তার বৃটেনে থাকা মেয়ের সন্তান ধারণের জন্য। সে ক্ষেত্রে ওই দাদি যমজ সন্তানের জন্ম দেন, যারা কি না তার জেনেটিক গ্রান্ড চাইল্ড।

ভারতজুড়ে ডা. প্যাটেলের ক্লিনিকের মতো অনেক ক্লিনিক সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিনিধি মাতৃত্বকে ‘গর্ভাশয় ভাড়া’ কিংবা ‘পুনরুৎপাদন পর্যটন’ শিল্প বিভিন্ন উপনামে ডাকা হয়। এ শিল্পসংশ্লিষ্টদের আন-অফিশিয়াল হিসাব মতে, ভারত প্রতি বছর এ খাত থেকে ৪৪ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার (৪৪৫ মিলিয়ন ডলার) আয় করছে। ডা. প্যাটেল গত পাঁচ বছরে ১৫০ নিঃসন্তান দম্পতিকে ভাড়া করা গর্ভাশয়ের মাধ্যমে মা-বাবা হতে সাহায্য করেছেন। এভাবে ১৮৫টি শিশুর জন্ম দেয়া হয়েছে, যাদের মধ্যে যমজ সন্তানও রয়েছে।

কিছু রাষ্ট্র গর্ভাশয় ভাড়া দিয়ে অর্থ রোজগারের বিষয়টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তবে ২০০২ সাল থেকে ভারতে বিষয়টি বৈধ। নিঃসন্তান দম্পতিদের পছন্দসই একটি পদ্ধতি এটি। কেননা এটি অ্যাডভান্স মেডিকেল সিস্টেম। অধিকাংশ চিকিৎসকই ইংরেজিভাষী। ভারতে এর খরচ যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিমা দেশের তুলনায় অনেক কম। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে প্রতিনিধি মাতৃত্বে খরচ প্রায় ১২ হাজার মার্কিন ডলার, যা কি না যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় পাঁচগুণ কম। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অঙ্গরাজ্যে আইনগত শর্ত আরোপ করা হয় যে, প্রতিনিধি মাতৃত্বের বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ করা যাবে না। ভারতে সে ধরনের বিধান বা শর্ত নেই। আর সে কারণে গর্ভাশয় ভাড়া দিতে রাজি দরিদ্র নারীদের লাইন পড়ে যায় এখানে।

ডা. প্যাটেল জানান, প্রতিনিধি মাতৃত্বের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো গুজরাটের আনন্দ বা এর আশপাশের এলাকার দরিদ্র রমণীরা। সূত্র মতে, গর্ভাশয় ভাড়া দিয়ে একজন নারী আড়াই লাখ থেকে সাড়ে তিন লাখ রুপি (সাড়ে সাত হাজার থেকে সাড়ে ১০ হাজার ডলার) আয় করেন। এ ধরনের সব নারীই দারিদ্র্য জর্জরিত। অর্জিত অর্থে কেউবা নিজের ছিন্ন কুঁড়েঘরকে ইটের বাড়ি বানাতে চান, কেউবা শিশুদের ভালো শিক্ষাদানে আগ্রহী। আবার কেউ কেউ অর্জিত অর্থ খরচ করেন কন্যার যৌতুকদানে। গর্ভাশয় ভাড়াদানকারী অধিকাংশ মা-ই গর্ভকালীন চেকআপের জন্য নিয়মিত পার্শ্ববর্তী প্রসূতি ক্লিনিকে যান। সমালোচকরা প্রতিনিধি মাতৃত্বকে বিদেশি দ্বারা উন্নয়নশীল দেশের নারীদের শোষণ বলে নিন্দা জানিয়েছেন। তাদের মতে, বিদেশিরা এ ধরনের মাতৃত্বের ক্ষেত্রে নিজ দেশের উচ্চ খরচ বহনে অক্ষম কিংবা অনিচ্ছুক।